ছোট্ট একটা কথা বলবো। তবে মূল কথাটি বলার আগে দুটো পয়েন্ট সংক্ষেপে বলে নিতে হবে।
১
বর্তমান রাজনীতিতে আলোচিত, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের মূলধারার চিন্তাটা কি?
চারদলীয় জোট গঠনের পর থেকে জোটের রাজনীতিতে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা একটি ধারাতেই হাটছিল। এবং গত দুই দশকের কর্মপন্থার ধারাবাহিকতায় জোটবদ্ধ রাজনীতিতে ইসলামপন্থীরা শক্তিশালী একটা ধারা হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছিল। জোটবদ্ধ রাজনীতিতে আসার পেছনে মূল চিন্তাটা ছিল, "বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামবিরোধী শক্তির মোকাবেলা করতে হলে কোন একটা বড় শক্তির সাথে থাকাটা প্রয়োজন।"
এই নীতির উপর ভিত্তি করে ২০০১ সালে গঠন করা হয় চার দলীর জোট। এর পর থেকে জোটের রাজনীতিতে ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস জোটে থেকেই তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছিল। শত প্রতিকূলতার মাঝেও ধারাবাহিকভাবে নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করে আসছিল।
এই জোটবদ্ধ ইসলামী রাজনৈতিক ধারার দলগুলো
আরেকটি বড় সফলতা হচ্ছে, রাজনৈতিক ধারার বাইরে এসেও অরাজনৈতিকভাবে একটা দীর্ঘ সময় যাবৎ ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলামবিদ্বেষী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া।
হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আসার আগে তারা ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে সামাজিক আন্দোলন দাড় করিয়ে ইসলামের উপর আসা বিভিন্ন আঘাতকে প্রতিহত করেছে। পাশাপাশি তাদের জোটবদ্ধ রাজনীতির প্রভাবও রাষ্ট্রে পড়েছে। সংসদে তাদের উপস্থিতি আন্তর্জাতিক কোন চাপকে আমলে নিয়ে ইসলামবিরোধী কোন আইন পাশ করতে দেয়নি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, বিএনপি জোট সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক চাপ থাকার পরও নারী উন্নয়ন নীতিমালায় কুরআন সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক চারটি ধারা সংশোধনের কথা।
এসব কিছুর ধারাবাহিকতায় মাঠে আসার প্রয়োজন পড়ে হেফাজতে ইসলামের। ২০১৩ সালে হেফাজতের ব্যানারে বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতাদের অরাজনৈতিক প্লাটফর্মে এসে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল রাষ্ট্রীয় মদদে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের নামে ইসলামবিদ্বেষী চক্রের উত্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। আর শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে মাঠে আসা হেফাজতকে তান্ডবকারী আখ্যা দিয়ে তাদেএ কঠোরভাবে দমন করেছিল আওয়ামীলীগ। অন্যদিকে সেকুলারিজমের নাম ধারণ করে যে শক্তিটি ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানো শুরু করেছিল তাদেরকে দিয়েছিল রাষ্ট্রীয় সহায়তা।
এভাবেই তারা নিকট অতীতে আওয়ামীলীগ নিজ দলকে ধর্ম বিরোধী বলে প্রমাণ করেছে। আজ হেফাজতের ডাকে সাড়া দিয়ে সরকারী বাধা পেরিয়ে বিশাল জনসমুদ্রের প্রদর্শনীর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দাবী তুলে ধরেছে। তারা ইসলামবিদ্বেষীদের দমনে হেফাজতের সাথে একমত। আর এটা খুব স্পষ্ট বিষয় যে হেফাজতের নেতৃত্ব জোটের রাজনীতি করা ইসলামী দলগুলোর নেতৃবৃন্দের হাতেই ছিল। যার বাড়তি সুবিধা হেফাজত সাংগঠনিকভাবে পেয়েছে।
কিন্তু এরপরও কেন সেই ইসলামী সংগঠনগুলো নির্বাচনের সময় এসে অবমূল্যায়নের শিকার হচ্ছে? আসছি সে আলাপে। আগে আরো কিছু হালত বলি আমাদের।
আমরা কি তৃণমূলের জায়গা থেকে হেফাজতের সেই মূলধারার চিন্তার সাথে একমত থাকতে পেরেছি?
আজকে নতুন নতুন তর্কে জড়িয়ে আমরা অনেক সময় দ্বিধায় পড়ে যাই যে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে আওয়ামীলীগকে প্রতিপক্ষ ভাবাটা ঠিক হবে কিনা৷ আসলে ইসলামপন্থীদের বিভক্ত করার পাশাপাশি আমাদের এই দ্বিধান্বিত হওয়াটাও আওয়ামী সরকারের একটা সফলতা। একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায়, আওয়ামীলীগ ৫ই মেয়ের রাতেও যেভাবে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছিল, সেই থেকে ক্ষমতায় থাকার পুরোটা সময় জুড়ে তারা হেফাজতকে নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া অব্যহত রেখেছে। শুধু সেই প্রক্রিয়ায় সময়ে সময়ে কিছু কৌশলগত পরিবর্তন এসেছে। শেষ পর্যন্ত আমরা দেখতে পেয়েছি আওয়ামীলীগ সফলভাবে হেফাজতের একটা পক্ষকে বের করে তাদের পক্ষে এনে হেফাজতকে দুইভাগ করতে সক্ষম হয়েছে। পয়েন্ট হচ্ছে,
এখন আপনাকে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে ভাবতে হবে আওয়ামীলীগের এই ডিভাইডেড এন্ড রুল প্রক্রিয়া যদি সফল না হত তাহলে হেফাজতের সেই ঐক্যবদ্ধ শক্তিটা কোন পক্ষে থাকতো। নাহলে ইসলামপন্থীদের সিদ্ধান্তগুলোর কোন ধারার উপরে ভিত্তি করে নেওয়া হচ্ছে সেটা আপনি বুঝতে ব্যর্থ হবেন।
২
চলমান রাজনৈতিক সংকট কি সিদ্ধান্ত নিতে বলে?
এবার একটু চলমান রাজনীতির সংকট উত্তরণে জনগণের চাহিদাটা বুঝার চেষ্টা করি। আওয়ামীলীগ ইসলামের পক্ষে না বিপক্ষে সেদিকে না গেলাম, তারা গত দশ বছরে যা করেছে এতে কি আপনি মনে করেন যে এই দলটি সুশাসনের পক্ষে আছে?
আর সব নাগরিক অধিকারের কথা নাহয় বাদই দিলাম। যারা অন্যায়গুলোর প্রতিবাদ করছিল তাদের বেচে থাকার অধিকারটুকু কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বৈরতন্ত্র কায়েমের এক দানবীয় দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে এই সরকার। এসব কারণেই দেশে এখন স্বৈরাচার সরকার পতনের আন্দোলন তীব্রভাবে দাড়াতে চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে গেলে এই বাস্তবতাকে পাশ কাটানোর কি কোন সুযোগ আছে?
এবার মূলকথাটা বলি। এসব ফ্যাক্ট আমলে নিলে এ কথা মানতেই হবে যে,
স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে ইসলামপন্থীদের আওয়ামী বিরোধী ধারাটি শামিল হওয়াটাই প্রত্যাশিত ছিল। এবং তা একই সাথে রাজনৈতিক ও ইসলামিক কারণে।
এ কথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় আওয়ামীলীগ যদি বিভিন্ন টোপ দিয়ে ইসলামপন্থীদের বিভক্ত করতে না পারতো তাহলে জোটবদ্ধ রাজনীতির সেই ধারাবাহিকতার কারণেই আজকে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হত ইসলামপন্থীদের৷ একইসাথে ইসলামপন্থীদের "কতিপয় ওলামারা" যদি সে টোপ না গিলে নিজেদের নীতি নৈতিকতার উপর অনড় থাকতে পারতেন তাহলে যেকোন শক্তিই সামনে আসুক, মূল্যায়ন করতে বাধ্য হত ইসলামপন্থীদেরকে।
কিন্তু বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই বলতে হচ্ছে, বিভক্তিটা হয়ে গেছে। আর রাজনৈতিক দলগুলোও দেখে ফেলেছে যে, এই শক্তিকে কিছু টাকা হলেই বিভক্ত করা যায়। অবমূল্যায়নের জন্য এর থেকে বড় কিছু ঘটার কি প্রয়োজনীয়তা আছে?
বিএনপি ইসলামী দলকে অবমূল্যায়ন করার পেছনে কারণ আরো আছে। আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গত কয়েক মাসে ইসলামপন্থীদের শক্তিশালী কোন ভূমিকা নেই। আছে একটি "শোকরানা মাহফিলের" কলংক।
তাছাড়া যেই ইসলামী দলগুলো তাদের সাথে আছে তারা যতগুলো আসন চাইছে অতগুলো আসনে ভোটে জিতে আসার সক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে বিএনপির। আমি মোটেও ইসলামী দলের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিনা। বলতে চাইছি যে, ইসলামী দলগুলোর সাথে সাংগঠনিক দূরত্বের কারণে বিএনপির এই সংশয় আসাটা অস্বাভাবিক না।
পক্ষান্তরে ঐক্যফ্রন্ট বিএনপিকে অস্তিত্ব সংকট থেকে বাচিয়ে এনেছে। তাই তাদেরকে মূল্যায়ন করাটাই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত। যেই সিদ্ধান্তকে জোটে থাকা ইসলামী দলগুলোও যৌক্তিক বলে মেনে নিয়েছে।
তাই আমি বলতে চাচ্ছি, এতসব বাস্তবতাকে এড়িয়ে গিয়ে ইসলামী দলগুলোর প্রতি সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে আপনি যখন শুধু বিএনপির অবমূল্যায়নকেই দোষারোপ করেন, তখন ব্যাপারটা সত্যিই খুব "হাইস্যকর" হয়ে ওঠে। এখন সময়টা হাসাহাসির না৷ সামনে নির্বাচন, আরো সিরিয়াস হোন।