জন্ম ১৩১০ হিজরীর ১৩ই রবিউল আওয়াল দেওবন্দ
শহরের বিখ্যাত উসমানী পরিবারে। দারুল উলুম দেওবন্দের মক্তবে
পড়ালেখার হাতেখড়ি। মাত্র তিন বছর বয়সে মা মারা যান।
মাওলানা আশরাফ আলি থানভী রহ. ছিলেন তাঁর আপন মামা। যফর আহমদের অসাধারণ মেধায় মুগ্ধ হন থাওভী রহ.। ১২ বছর বয়সেই তাকে থানা ভবনে নিজ খানকায় তরবিয়তে নিয়ে আসেন। এবং অত্র খানকার মাদরাসায় এমদাদুল উলুমে মাধ্যমিক পর্যন্ত নিজ তত্ত্বাবধানে পড়ালেখা করান। এরপর তাকে
তিনি পাঠিয়ে দেন কানপুরের মাদরাসায় জামেউল উলুমে। কানপুরে ভাগ্নের পড়ালেখার সার্বিক দায়িত্ব মাওলানা ইসহাক বর্ধমানী রহ. এর নিকট অর্পণ করেন। উল্লেখ্য যে মাওলানা ইসহাক
জীবনের শেষ পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি এবং ইসলামিক স্টাডিস বিভাগের প্রধান
রূপে যোগদান করেছিলেন। এখানেই ১৯৩৮ খৃস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। ঢাকার প্রবীণ
আলেমদের মুখে মুখে এখনো তাঁর পান্ডিত্যের কথা শুনা যায়।
যফর আহমদ উসমানী মাত্র ১৬ বছর বয়সে দাওরায়
হাদিস সম্পন্ন করেন। এরপর থানভী রহ. তাকে মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুরে মাওলানা আহমদ আলী
সাহারানপুরীর খেদমতে পাঠিয়ে দেন। আলী সাহারানপুরী সে যুগের একজন সেরা হাদিস বিশারদ এবং বুজুর্গ ছিলেন। সেখানে দুইবছর থেকে উসমানী রহ. হযরতের কাছে পুনরায় বুখারী শরীফ পড়েন এবং সাথে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কিতাবাদী
পড়েন। পড়ালেখা শেষ হলে সেই
প্রতিষ্ঠানেই দরস দান শুরু করেন। দীর্ঘ সাত বছর মিশকাত পর্যন্ত বিভিন্ন কিতাবের দরস দিতে থাকেন। সে সময় মাওলানা বদরে আলম
মিরাঠি, মাওলানা যাকারিয়া, মাওলানা ইদ্রিস কান্ধলভীর মত কিংবদন্তিরা মাওলানা
উসমানী রহ. এর শাগরিদ ছিলেন।
সাত বছর পর মাওলানা থানভীর নির্দেশে
থানাভবন খানকায় ফিরে আসেন। এবং থানভী রহ. তাকে লেখালেখির দায়িত্বে নিয়জিত করেন। প্রথম প্রথম হযরত থানভীর মালফুজাল লিপিবদ্ধ
করতেন। এরপর থানভী রহ. এর পক্ষ থেকে ফাতওয়া লেখার দায়িত্বও পালন করা শুরু করেন। একই সময়
থানাভবনের নিকটবর্তী মাদরাসা এরশাদুল উলুমে বুখারী ও মুসলিম শরিফের দরসও আরম্ভ করেন।
১৩৩৯ হিজরী। উসমানী রহ. তখন দরস-তাদরিস ও তাসনিফাতের কাজে পুরোপুরি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এমন সময় বার্মা থেকে বড় ব্যবসায়ীদের একটি দল থানভী রহ. এর দরবারে আসলেন। তারা নিজ দেশে একটি দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চান। আর এরজন্য একজন যোগ্য ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় পারদর্শী একজন আলেমের খুবই প্রয়োজন। তখন ওলামায়ে কেরামের কাজের জন্য সময় অত্যন্ত নাজুক ছিল। এমন পরিস্থিতেও থানভী রহ. যফর আহমদ উসমানীকে বার্মা পাঠিয়ে দিলেন। তিনি গিয়ে রাজধানী রেঙ্গুনের উপকন্ঠে রান্ধের নামক
স্থানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এবুং সেখানে আড়াই বছর পর্যন্ত শিক্ষকতা
করেন। এসময়ে তিনি দরস ও তাদরীস ছাড়াও রেঙ্গুনসহ বার্মার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে দ্বীনী প্রতিষ্ঠান করেছেন এবং ওয়াজ
নসিহতের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামীক স্টাডিজ বিভাগের দায়িত্বে যফর আহমদ উসমানী
পূর্ব বাংলার মুসলমানদের
জন্য উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করার লক্ষ্যে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেসময় উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণার প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ
গুরুত্ব দেয়া হত। সূচনালগ্নেই সেখানে মাওলানা ইসহাক বর্ধমানী রহ. কে ইসলামী স্টাডিজ ও
আরবি বিভাগের প্রধান বানিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়। যিনি যফর আহমদ উসমানীর
পরামর্শদাতা মুরুব্বি ও শিক্ষক ছিলেন।
১৩৫৮ সালে ,আওলানা ইসহাকের ইন্তেকাল হলে যফর আহমদ
উসমানী রহ এর ডাক পড়ে উস্তাদের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য। এরপর থেকে ইংরেজদের শাসনমুক্ত হওয়ার আগ
পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে নিয়জিত ছিলেন। একই সময় তিনি বড় কাটারা মাদরাসায় বুখারী
শরীফ, মুয়াত্তা মালেক মসনবি শরীফ, বাইযাবী শরীফ কিতাবের দরস দিয়েছেন। তখনকার
সময়ে যারা উসমানী রহ. এর কাছে হাদিস পড়েছিলেন তারা পরবর্তীতে বেশ বড় মুহাদ্দিস
হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
১৯৪৮ সালে উপমহাদেশের
অন্যতম প্রাচীন দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলকাতা আলিয়া মাদরাসার একটি ভাগ নিয়ে আসা হয় রাজধানী ঢাকায়। এর প্রধান হওয়ার জন্য মাওলানা যফর আহমদ উসমানীকে অনুরোধ জানানো হয়। তিনি অনুরোধ রেখে দায়িত্বগ্রহণ করেন। মাওলানা উসমানী ঢাকা আলিয়ার প্রধান হিসেবে যোগ দেয়ার পর থেকে সেখানে দ্বীনী ইলম চর্চার একটি নতুন পরিবেশ তৈরী হয়। এবং এর মাত্র দুই বছর
পর তাঁরই হাত ধরে যাত্রা শুরু করে ঢাকার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লালবাগ জামেয়া
কুরয়ানিয়া আরাবিয়া।
যফর আহমদ উসমানী তখন মউলভি বাজার থাকতেন। নামাজ
পড়তেন ইমামগঞ্জ মসজিদে। তখন লালবাগ ও কাটারা মাদরাসার ছাত্রদের বুখারী শরিফের দরস বাদ ফজর তিনি সেই মসজিদেই করাতেন। এই দরসে মাদরাসার ছাত্ররা ছাড়াও ভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থী, বিভিন্ন বিভাগের প্রফেসর থেকে নিয়ে অনেক বড় বড় আলেমরা পর্যন্ত অংশগ্রহণ করতেন।
দেশভাগের আগ পর্যন্ত ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় গ্রীষ্ম ও শরতের ছুটিতে তিনি ভারতের সুরাট জেলার
ডাভেল মাদ্রাসায় নিয়মিত আমন্ত্রিত হতেন।
১৯৫৪ সালে আলিয়া মাদরাসা থেকে তিনি
অবসর গ্রহণ করেন। তখন করাচীতে অনেক বড় বড় মাদরাসা সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল। এসব মাদরাসার যেকোন একটিতে শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব নেয়ার জন্য তাঁর বন্ধুবান্ধব ও ভক্তরা অনুরোধ করতে থাকে। কিন্তু কারো কথা না শুনে তিনি করাচীর সিন্ধু গ্রামে গিয়ে টেন্ডু আল আহইয়ার মাদরাসায় শায়খুল
হাদিসের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লোভনীয় সব প্রস্তাবকে এড়িয়ে তিনি গ্রামের নিরিবিলি
পরিবেশকে বেছে নিলেন। আর বন্ধুবান্ধবদের বললেন, "বড় শহরের আরামদায়ক পরিবেশে কাজ করার তো লোক
অনেক আছে। গ্রামাঞ্চলে গিয়ে কাজ করার লোকের অভাব।"
এরপর জীবনের শেষ বিশ বছর তিনি
সেখানেই কাটিয়ে দেন।
মূল্যবান লিখনীঃ
তাঁর লিখনীর মধ্যে বহুল পরিচিত একটি কিতাব হচ্ছে ইলাউস সুনান। বিশ খন্ডের এই কিতাবটির পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয়
হাজার। ইলমে ফিকহের তরতীব অনুযায়ী হানাফী ফিকহের মাসায়েলসমূহ যেসব হাদিস থেকে প্রণয়ন করা হয়েছে সেই হাদিসগুলো সুবিন্যস্তভাবে ব্যাখ্যাসহ তিনি একত্রিত করেছেন। তিনি দীর্ঘ বিশ
বছর থানভী রহ এর তত্ত্বাবধানে থেকে রচনা তিনি এই মহামূল্যবান গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।
মিসরের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস যাহেদ
কাউসারী এই কিতাব সম্পর্কে বলেন, "এ যুগেও এমন হাদিস বিশারদ দুনিয়াতে আছেন ভেবে
অবাক হতে হয়। আমি তাঁর মেধা ও শ্রম দেখে রীতিমত আশ্চর্য হয়েছি। তাঁর সাফল্য সত্যিই ঈর্ষণীয়।"
সমকালীন আরেকজন মুহাদ্দিস আবুল ফাতাহ
আবু গুদ্দাহ রহ. ও ইলাউস সুনানের ভূমিকা লিখতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন। উল্লেখ্য যে, আবুল ফাতাহ আবু গুদ্দা
রহ. কিতাবটির ভূমিকার একটি ব্যাখ্যা লিখে "কাওয়াইদ ফি উলুমিল হাদিস" নামে প্রকাশ
করেছেন।
হযরত উসমানী রহ. এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা
হচ্ছে, আহকামুল কুরআন। পবিত্র কুরআনের যেসব আয়াত থেকে শরিয়তের বিধি-বিধান প্রমানিত
হয়েছে সেগুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বিস্তারিতভাবে নিয়ে এসেছেন তিনি এই কিতাবে। বিশেষত হানাফি
ফিকহের কোন মাসায়েল ঠিক কোন আয়াত থেকে প্রণীত সেগুলো দলিলসহ আলোচনার ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেয়া
হয়েছে।
আহকামুল কুরআন কিতাবটিও আদ্যোপান্ত থানভী রহ. এর একটি তত্ত্বাবধানে হওয়া একটি বিশাল খেদমত। তিনি মোট চারজন দক্ষ আলেমের মাধ্যমে এই কাজটি আঞ্জাম দিয়েছেন। এর মধ্যে
মাওলানা যফর আহমদ উসমানী রহ. এর কাজ ছিল সুরা নিসা পর্যন্ত।
ইলমে ফিকহের মধ্যে তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছ ইমদাদুল আহকাম। এটি সাত খন্ডে সমাপ্ত। এ পর্যন্ত প্রথম দুইটি
প্রকাশিত হয়েছে। বাকিগুলো প্রকাশিতব্য।
রাজনীতির ময়দানে যফর আহমদ উসমানীঃ
মাওলানা উসমানী এসব মহান দায়িত্ব ও
কাজ সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ার পর রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে
উলামায় কেরামের সাথে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৪৫ সালে কলিকাতার মুহাম্মদ আলী পার্কে ওলামা সমাবেশ
করে "জমিয়তে ওলামায় ইসলাম" প্রতিষ্ঠা করা হইয়েছিল। এই সংগঠনের মূল স্থপতিদের মধ্যে প্রথমসারির একজন ছিলেন যফর আহমদ উসমানী। মাওলানা ইউসুফ বিন্নুরী রহ. এর ভাষায়, মাওলানা উসমানীর প্রতিটি কাজ ছিল মুজাহিদসুলভ। বলতে গেলে জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রই তিনি জীহাদের ময়দানে কাটিয়েছেন।
সূত্রঃ আলোর কাফেলা
(মাওলানা মহিউদ্দিন খান রহ. এর প্রবন্ধ
থেকে)
No comments:
Post a Comment