হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর যুগে মিসর ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থার অধীনে আসে। এর আগ পর্যন্ত মিসরে রোমান শাসকদের রাজত্ব ছিল। রোমানদের পূর্বে শাসক ছিল টলেমীয় আলেকজান্ডারগণ। তাদের আগে ছিল পারসিক এথনীয়গণ। তাদের আগে গ্রীক শাসকগণ। এবং তাদেরও আগে শাসন করেছে ফেরাউনরা। প্রায় পাচ হাজার বছর ধরে ইতিহাসের সব ক্ষমতাধর মহানায়কেরা নিজেদের সভ্যতা কায়েম করেছে মিসরের মাটিতে। এবং সেকালের বহু নিদর্শন মিসর এখনো ধারণ করে রেখেছে। হাজার হাজার বছরের সেসব ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে থাকতে পেরেছে বলেই আজও মিসর এক রহস্যময় আকর্ষণ নিয়ে টিকে আছে।
ফেরাউনদের যুগেরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পর মিসরে মুসলমানদের আগমণ ঘটে। বিশ্বের দুই পরাশক্তি রোম-পারস্যকে কুপোকাত করে মিসর অভিযানে এসেছিল আমর ইবনুল আসের বাহিনী। সে সময় মুসলমানদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ঠিক কতখানি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং প্রাচ্যবিদদের ভাষায় বলতে গেলে, "পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য সব দেশ বিজয় করে মুসলমানরা কতটা "হিংস্র" হয়ে উঠেছিল" সেসব বুঝার জন্য মুসলমানদের মিসর বিজয়ের প্রেক্ষাপট জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সময় তখন ৬৬১ খৃষ্টাব্দ। হযরত ওমর রা. এর খেলাফতকাল। তিনি সিরিয়া বিজয়ের পর সেনাপ্রধান আমর ইবনুল আস রা. কে ৩৫০০ সৈন্য বাহিনীসহ মিসর অভিযানে পাঠান। মুসলমানরা তখন মিসরে প্রবেশ করেছিল সিনাই অঞ্চল দিয়ে। যেটি একালে এসেও মিসরের সীমান্তের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল বলে বিবেচিত হয়।
সেনাপ্রধান আমর ইবনুল আস রা. আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কিছু দূরে সর্বপ্রথম তাবু স্থাপন করে সেনানিবাস তৈরী করললেন। তাবুর সেই নগরীকে ফুসতাত বলা হত।
আলেকজান্দ্রিয়া তখন প্রায় ১৫০০ বছরের পুরোনো রাজধানী।
ওদিকে মুসলমান সৈন্যদের আগমনের খবর পেয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার শাসক মুকাওকাস দুইজন গণ্যমান্য ক্যাথলিক নেতাদের পাঠান হযরত আমর রা. এর সাথে সাক্ষাত করতে। এরপর আমর রা. তাদের সাথে যেই আচরণ করলেন তা ছিল জীহাদের পূর্বে প্রতিপক্ষকে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার সুযোগ উন্মোচন করার নববী আদর্শের নমুনা। কারণেই প্রথমেই হেদায়েতে দাওয়াত ও তা গ্রহণ না করলে কর প্রদান করে সন্ধিচুক্তি প্রস্তাবনার নির্দেশ জীহাদের অভিযানে পাঠানোর পূর্বে রাসুলুল্লাহ সা. সাহাবীদের করেছেন বলে বিভিন্ন হাদিসে উল্লেখ আছে।
আমর রা. প্রথমে পাদ্রিদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। বেশ নম্রতার সাথে দাওয়াত দেওয়ার পর তাদের নিকট দুইটি প্রস্তাব রাখলেন:
১ যে ব্যক্তি আমাদের দাওয়াতকে গ্রহণ করবে সে আমাদের মধ্যে একজন বলেই গণ্য হবে।
২ আর যে ব্যক্তি দাওয়াতকে গ্রহণ করবেনা আমরা তার প্রতি কর প্রদানের প্রস্তাব পেশ করবো। এবং তার প্রতিরক্ষা দায়িত্ব গ্রহণ করবো।
ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তাদেরকে তিনদিন সময় দেওয়া হল। এবং পাদ্রিরা আরো একদিন বাড়িয়ে, মোট চারদিন সময় চেয়ে নিয়ে ফিরে গেল।
পাদ্রিদের মুখ থেকে সবকিছু শুনে মুকাওকাস সকলকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার হুকুম দিল। কিন্তু যখন তারা ভেবেচিন্তে দেখলো মুসলমানদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে পেরে ওঠার কোন সম্ভবনাই নেই তখন তারা জনগণকে চোরাগোপ্তা হামলার প্রতি উৎসাহিত করতে লাগলো। তবে জনগণ ততক্ষণে বাস্তবতা উপলব্ধি করে ফেলেছে। তারা মুকাওকাসের হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে জানিয়ে দিল "যে বাহিনী সবেমাত্র বিশ্বের দুই পরাশক্তি পারস্য(ইরান) এর কিসরা ও রোমের কায়সারকে হারিয়ে মিসর বিজয়ের অভিযানে এসেছে তাদের সাথে যুদ্ধে যাওয়াটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। আমরা সন্ধিচুক্তি করতে চাই"।
এরপরও রাজা মুকাওকাসের একনিষ্ঠ কিছু অন্ধ অনুসারী তখন মুসলমানদের উপর হামলা করার দুঃসাহস দেখাতে গিয়ে সদলবলে করুণভাবে নিহত হয়েছিল।
চতুর্থ দিন কথা অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কাউকে আসতে না দেখে মুসলমানরা যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে আইনে শামস কুয়াটি ঘেরাও করে। আইন শামস হল সেই অঞ্চল যাকে এখন মানুষ কায়রো বলে চেনে। তবে কায়রো নগরী তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
মুসলমানরা কেবলমাত্র কুয়া ঘেরাও করার পরই আইনে শামসের রাজা এর ভয়াবহতা টের পেয়ে যায়। সাথে সাথে সে আমর ইবনুল আস রা. এর দরবারে এসে সন্ধি চুক্তি করে ফেলে। এবং তাদের দেখাদেখি আলেকজান্দ্রিয়ার রাজা মুকাওকাসও সন্ধিচুক্তি করে ফেলে। তবে অনেক ইতিহাসবিদরা বলেছেন আলেকজান্দ্রিয়া বিজয় করতে আমর রা. কে সংক্ষিপ্ত একটি যুদ্ধের অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছিল। এছাড়া পুরো মিসরই বিনাযুদ্ধে সন্ধিচুক্তি মেনে নিয়েছিল।
আমর ইবনুল আস রা: তখন সন্ধিনামায় লিখেছিলেন:
"এই হচ্ছে মিসরবাসির প্রতি আমরের নিরাপত্তানামা। তাদের কোন ধর্মীয় স্থাপনায় হস্তক্ষেপ করা হবেনা। ধর্মীয় এবং নাগরিক কোন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেনা। এই সন্ধিনামায় যারা একাত্মতা প্রকাশ করবে তারা কর আদায় করবে।"
এভাবেই উভয় ধর্মের লোকদের ধর্মীয় সহাবস্থান মেনে নেওয়ার মাধ্যমে সেই যুগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সূচনা হয়েছিল তা মিসরে আজও বহাল আছে। জনসংখ্যার পঁচাশি ভাগ মুসলমান হলেও পনেরো ভাগ খৃষ্টানদের সাথে তাদের অসাম্প্রদায়িক আচরণের কোন নজির নেই।
মুসলমানদের এ ধরণের বিজয় প্রমাণ করে শত্রুর ভেতরে আল্লাহ তায়ালা সে যুগে মুসলমানদের কি পরিমাণ প্রভাব সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। কিসরা কায়সারের সাম্রাজ্য ধুলিস্যাত করে মুসলমানদের যে প্রতাপ তৈরী হয়ে গিয়েছিল এতে মুসলমানরা পারতো কোন সুযোগ না দিয়ে সরাসরি যুদ্ধ লিপ্ত হতে। কিন্তু নববী আদর্শ থেকে তারা সেই সময়ও একচুল এদিক সেদিক নড়েননি। প্রথমে হেদায়েতের দাওয়াত দিয়েছেন। দাওয়াত গ্রহণ করতে না চাইলে নিজ ধর্মে বহাল থেকেও শুধু মাত্র কর আদায় করে সন্ধি চুক্তির সুযোগ প্রদান করেছেন। তারা চাইলেই পারতেন এই মিসরবাসীকে তখনই তরবারির জোর দেখিয়ে মুসলমান বানিয়ে ফেলতে। অথবা কালিমা না পড়ার অপরাধে জবাই করে কতল করে ফেলতে।
কিন্তু তারা তো এসবের কোনটাই করেন নি। কোন ধরণের রক্তপাত ছাড়াই কেবলমাত্র সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে একটি দেশকে ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থার ছায়াতলে তারা নিয়ে এসেছিলেন। মুসলমানদের দেড় হাজার বছর পুরোনো একটি দেশ বিজয়ের ঘটনা আজকের প্রেক্ষাপটেও আমাদের জন্য কতটা শিক্ষণীয় হয়ে আছে।
-আশরাফ মাহদি
শিক্ষার্থী - আলআযহার ইউনিভারসিটি
No comments:
Post a Comment