'কোন কোন মুহাদ্দিসা এলেমের জগতে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হইছিলেন যে, ওনাদের জামাই ওনাদের ছাত্রত্ব গ্রহণ করছিলেন, এবং বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ও বিচার-সংক্রান্ত প্রশ্নে অন্যদেরও ওনাদের কাছে যাইতে বলতেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। মুয়াজ ইবনে হাবিব আল জুহানির বরাতে হিশাম ইবনু সাঈদ বয়ান করেন: মুয়াজ তার বউরে জিগেশ করছিলেন: 'বাচ্চারা কোন বয়সে এবাদত শুরু করবে?' তার বউ উত্তরে বলেন: নবি সা. থেকে আমাদের এক লোক বয়ান করেন যে, নবিজিকেও এই প্রশ্ন করা হইছিল। তখন উনি বলছিলেন: 'শিশু যখন ডান-বামের তফাত বুঝবে, তখন তারে এবাদতের আদেশ দাও।'
আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাব ইবনে জাময়াও তার বউ কারিমা বিনতে মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ আল কিন্দিয়ার থেকে হাদিস বর্ণনা করছেন। ইসহাক ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবু তালহাও তার বউ উম্মে ইয়াহইয়া হুমাইদা বিনতে উবাই ইবনে রাফিয়া আল আনসারিয়া যুরাকিয়া থেকে হাদিস বয়ান করছেন।
ফাতেমা বিনতে মুনযির ইবনে যুবাইর ইবনুল আওয়ামরে তাবেয়িদের মধ্যে বেশ বড় মাপের স্কলার ও আইন-বিশেষজ্ঞ হিশাবে দেখা হইত। উনি অনেক হাদিস জানতেন, এগুলার বড় অংশ উনি শিখছিলেন ওনার দাদি আসমা বিনতে আবু বকরের কাছে। অনেক বড় বড় ইমাম ওনার থেকে হাদিস বয়ান করছেন, এদের মধ্যে, 'সিরাতে ইবনে ইসহাক'র লেখক মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকও আছেন। তার সনদে যেসব হাদিস বড় বড় হাদিসের কিতাবে পাওয়া যায়, সেসবের বেশিরভাগই উনার জামাই হিশাম ইবনে উরওয়া ইবনে যুবাইর উনার কাছ থেকে শুনে বয়ান করছেন, যেই হিশাম আবার ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, শু'বা, সুফিয়ান সাওরিসহ অনেক বড় বড় ইমামদের ওস্তাদ।
'তুহফাতুল ফুকাহা'র লেখক মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে আবি আহমদ আল সমরকন্দী রহ. এর মেয়ে ফাতেমা অনেক উঁচা দরজার বিখ্যাত স্কলার ও আইনজ্ঞ ছিলেন। হানাফি ফেকাহর বিখ্যাত কিতাব 'বাদাইয়ুস সানায়ে'র লেখক আলাউদ্দিন আবু বকর ইবনে মাসুদ আল কাসানি ছিলেন উনার জামাই। ইবনে আদম বয়ান করেন: 'আমার বাবার কাছে শুনছি যে, উনি (ফাতেমা) হানাফি ফেকাহর মাসালাগুলা খুব ভাল জানতেন। উনার জামাই কাসানি রহ. মাঝেমাঝে কোন ফতোয়ার ব্যাপারে সন্দেহে পইড়া গেলে, বা ভুল কইরা ফেললে, উনি (ফাতেমা) তারে ঠিক মাসালাটা কারণসহ বুঝায়ে বলতেন।'
নবম শতকের একজন উদাহরণ হলেন ফাতেমা বিনতে ইয়াহইয়া। আল শাওকানি উনার ব্যাপারে বলেন: 'এলেমের জন্য উনি খুব মশহুর ছিলেন। বিচার সংক্রান্ত অনেক মাসালায় উনার আব্বার সাথে বিতর্ক হইছিল উনার। তার আব্বা ইমাম ছিলেন, এবং উনি নিশ্চিতভাবে বলছিলেন যে, ওনার মেয়ে মাসালা বের করার জন্য 'ইজতেহাদ' করতেছেন। এই কথা প্রমাণ করে যে, জ্ঞানের জগতে ওনার স্থান অনেক উঁচা ছিল। নাইলে একজন ইমাম কোন অযোগ্যর ব্যাপারে এমন কথা বলতেন না।' উনার আব্বা উনারে আল মুতাহহার ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সুলাইমান ইবনে মুহাম্মদের কাছে বিয়া দিছিলেন।
আল মুতাহহার বিচার-সংক্রান্ত অনেক জটিল মাসালার ফয়সালার জন্য ফাতেমার কাছে লোকজনরে পাঠাইতেন। যখন উনার এবং উনার ছাত্রদের কাছে জটিল কোন মাসালা আসত, উনি বউয়ের কাছে গিয়া সেই মাসালার সমাধান জিগেশ করতেন। ওনার ছাত্ররা তখন বলাবলি করত: 'এই মাসালা তো আপনার না ওস্তাদ, এই মাসালা পর্দার ওইপাশ থেকে আসছে।'
~
[আল মুহাদ্দিসাত: দ্য উইমেন স্কলারস ইন ইসলাম, আকরাম নদভি; পৃ: ১৪২-১৪৪]
শাফেয়ি মাযহাবের বিখ্যাত ইমাম ছিলেন তাকিউদ্দিন সুবকি রহ. (মৃ. ৭৫৬)। উনি ছিলেন দামেশকের বিচারক। ওনার ছেলে তাজ সুবকি রহ. (মৃ. ৭৭০)-ও ছিলেন শাফেয়ি মাযহাবের বিখ্যাত ইমাম এবং ওই সময়ের একজন বিখ্যাত ইতিহাস বিশারদ। বাবার পরে উনি দামেশকের বিচারক হইছিলেন। ইসলামি আইনের শাফেয়ি ট্রাডিশনে এই 'সুবকি ফ্যামিলি'র অবদান অনেক।
তো, তাজ সুবকি ওনার বিখ্যাত বই 'তাবাকাতে শাফেয়িয়া আল কুবরা'-য় খুব ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা লিখছেন। সেই ঘটনার মূল চরিত্র এক ইয়েমেনি নারী, যার বিস্ময়কর জ্ঞান, শক্ত মনোবল আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি ইসলামের ইতিহাসে এখনও উজ্জ্বল। এই নারীর নাম ফাতিমা বিনতে ওবাইদুল্লাহ। উনি ইসলামি ফেকাহর অন্যতম ইমাম, ইমাম শাফেয়ি রহ.-এর মা।
এখন আমরা যাদের 'সিঙ্গেল মাদার' বলি, ইসলামের ইতিহাস এই 'সিঙ্গেল মাদার'দের অদ্ভুত সব জীবনসংগ্রামের কাহিনীতি ভরপুর। হাদিস ও ফেকাহর বিখ্যাত তিন ইমাম— ইমাম বুখারি, ইমাম মালেক এবং ইমাম শাফেয়ি— তিনজনের মা-ই ছিলেন 'সিঙ্গেল মাদার'। জন্মের পরেপরেই ইমাম শাফেয়ি রহ.-র বাবা মারা যান। উনার আম্মা উনারে নিয়া নানাবাড়ি ইয়েমেনে চলে যান। ওনার আব্বা ছিলেন খুবই গরিব। কিন্তু ওনার আম্মা, ফাতেমার মনোবল ছিল খুবই শক্ত। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার পরেও, ছেলের উচ্চশিক্ষার জন্য কীভাবে উনি মক্কায় যান, শুদ্ধ আরবি, কবিতা ও আর্চারি শেখানোর জন্য হুজাইল নামের বিখ্যাত বেদুইন গোত্রে ছেলেরে পাঠান, হাফেজ, মুহাদ্দিস ও ফকিহ বানান, ছেলের ভবিষ্যতের জন্য বাকি জীবন সিঙ্গেল মাদার হিশাবেই কাটায়ে দেন— সে এক আশ্চর্য সুন্দর কাহিনী।
যাহোক, এই মহান নারী খালি যে একজন সফল মা ছিলেন, তা না। উনি ওইসময়ের একজন সেরা ফকিহও ছিলেন বটে। ওনার ফিকহি ইনসাইটেরই একটা ঘটনা তাজ সুবকি বয়ান করছেন তার বইতে।
ঘটনাটা এমন: একবার মক্কায় একটা বিচারের কাজে সাক্ষী হওয়ার জন্য ফাতেমা বিনতে ওবাইদুল্লাহ আর উনার বান্ধবী বিশর আল মিরিসির আম্মা— এই দুইজনকে ডাকা হইল। শাফি মাযহাব-মতে, যদি কাজি সাহেবের মনে সাক্ষীদের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে, তাইলে উনি সাক্ষীদের আলাদা আলাদা কক্ষে নিয়া সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারবেন, বরং এইটাই বেটার। তো, ওই মজলিশে কাজি আলাদাভাবে দুইজনের সাক্ষ্য নিতে চাইলেন। ফাতেমা বিনতে উবাইদুল্লাহ শান্ত গলায় বললেন: আপনার এইটা করার কোন অধিকার নাই কাজী সাহেব। কারণ আল্লাহ কুরানে বলছেন: 'যদি তাদের (নারী সাক্ষীদের) একজন কোন কথা ভুলে যায়, তাইলে অন্যজন তা স্মরণ করায়ে দেবে' (সুরা বাকারা, ২৮২)। কাজি সাহেব এই দলিলের পরে আর উনাদের আলাদা করেন নাই, একসাথেই সাক্ষ্য গ্রহণ করছেন।
সুবকি এই ঘটনায় মুগ্ধ হয়ে লেখেন: 'এইটা আসলে খুব সুন্দর দলিল, শক্তিশালী অর্থ, অসাধারণ যুক্তি-তর্ক। যদিও ওনার ছেলের মাযহাবমতে, আলাদা আলাদা করে সাক্ষ্য নেওয়া উচিত, যদি সন্দেহ থাকে। কিন্তু নারী সাক্ষীর ক্ষেত্রে এরকম করা যাবে না, এইটাই ছিল উম্মে শাফেয়ির মত। এই দলিলে কোন সমস্যা নাই।'
ফাতেমা বিনতে উবাইদুল্লাহ। ফকিহ, মুহাদ্দিস, একজন সফল 'সিঙ্গেল মাদার'। যে ইমামের নাম আজ লাখ লাখ মানুশ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, সেই ইমাম শাফিরে 'শাফি' করে তুললেন তো আপনিই। তবু ইতিহাসে আপনার নামটা পাইতে আমার ৫ টা কিতাব ঘাঁটতে হইছে। উইকিপিডিয়ায় আপনার নাম নাই, তাজ সুবকি আপনার নাম লেখেন নাই, আকরাম নদভিও লেখছেন 'মাদার অব ইমাম শাফি'। ফাতিমা বিনতে উবাইদুল্লাহ, নারী দিবসে আপনারে সশ্রদ্ধ সালাম।
তুহিন খান
No comments:
Post a Comment