Sunday, May 28, 2017

কায়রোর দিনলিপি (৫)

গতকাল দ্বিতীয় তারাবীহ পড়েছি কায়রোর সর্বপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী আযহার মসজীদে। গিয়ে দেখি মসজীদের ভেতর কানায় কানায় পরিপূর্ণ। নামাজ পড়তে হয়েছে মসজীদ চত্বরে। কায়রোর রাতের হিমেল হাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়ে মিসরী ক্বারিদের তিলাওয়াত শোনার মুগ্ধতা বর্ণনা করার মত শক্তিশালি লিখনীর যোগ্যতা অর্জন করতে আমার আরো হাজার বছরের সাধনা প্রয়োজন। তাই সে অনুভূতি ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হলাম।

বিস্ময়ের ব্যাপার হল, চারপাশে ঘেরা সুবিশাল দেয়ালগুলো এই হাজার বছরের ঐতিহ্যের ভারে একটুও নুয়ে পড়েনি। এখনো সিনা টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে।
বলা হয়ে থাকে এই মসজিদটি নির্মাণের সময় এমন কিছু একটা করা হয়েছিল যাতে তার দেয়ালের উপর কোন ধরণের পাখি না বসতে পারে। সে তেলেসমাতির প্রভাব নাকি এখনো অক্ষুণ্য রয়েছে।

আল্লামা তাকি উসমানী সাহেবের লেখা থেকে সংক্ষিপ্ত যে ইতিহাসটুকু জানতে পারলাম তা হচ্ছেঃ
কায়রোতে সুপ্রসিদ্ধ জামেয়া বলে যে জামেয়াতুল আযহারকে আমরা চিনি তা গড়ে উঠেছিল এই আযহার মসজিদকে কেন্দ্র করে।
৯৭০ সাল অর্থাৎ আজ থেকে এক হাজার সাতচল্লিশ বছর আগের কথা। মুঈয লি দিনীল্লাহ তখন ফাতেমী খেলাফতের চতুর্থ খলিফা। তিনি নিজ গোলাম জাওহার আস সিকিল্লিকে আযাদ করে। এবং সেনাপতি বানিয়ে প্রেরণ করে মিসর ও উত্তর আফ্রিকা অভিযানে। জাওহার সিকিল্লি সফলভাবে সে অভিযান সম্পন্ন করলে খলিফা তাকে কায়রো নগরী আবাদ করার নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য ছিল কায়রোকে ফাতেমী খেলাফতের রাজধানী বানানো। তাই ঠিক তখনই নগর নির্মাণের সূচনালগ্নে খলিফা এই আযহার মসজিদের ভিত্তি স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবং আদর্শগত জ্ঞানচর্চার লক্ষ্যে নিজ পৃষ্ঠপোষকতায় অনন্য এক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।

তবে এরপর থেকে আযহার দেখেছে আরো বহু শতাব্দী। জগতের তাবৎ ঘটনার সাক্ষী হয়ে হাজার বছর ধরে টিকে থাকা এই আযহারকে জানতে হলে ইতিহাসের আরো কিছু পাতা উল্টাতে হবে

Saturday, May 27, 2017

কায়রোর দিনলিপি (৪)

রমজানে তারাবীহ 


-"রামাদান কারীম"
-"রামাদান কারীম"
-না না, কেউ "রামাদান কারীম" বললে তার উত্তরে বলতে হয় "আল্লাহু আকরাম"। কি বলতে হয়?
-"আল্লাহু আকরাম"

আজকে কায়রোর প্রথম রোজা চলছে। প্রথমদিন মারকাযে গিয়ে পড়া শুনানো শুরু করলাম ক্বারী শায়খ ঈদ আযহারীর কাছে। উস্তাদজী প্রথম সাক্ষাতে কুশল বিনিময়ের এই ব্যাপারটা শিখিয়ে দিলেন। আর পড়া শোনার সময় তাজভীদে তো এমন এমন সূক্ষ্মতর কিছু বিষয় ধরলেন, মনে হল যে এখনো অনেক কিছুই শেখা বাকি।

ইফতারের সময় হয়ে এসেছে প্রায়। ইফতার করেই তারাবীহর জন্য বের হব। বড় কোন মসজিদে তারাবীহ পড়তে চাইলে ইফতারের পরপরই রওনা দিতে হয়। গতকাল আমরা প্রথম তারাবীহ পড়েছিলাম আব্বাসিয়ার মসজিদ, মসজিদে রহমানুর রহীমে। এটি কায়রোর একটু বেশী সুন্দর মসজিদগুলোর একটি। গুগলকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় "জুমার নামাজ আদায়ের জন্য কায়রোতে বেস্ট মসজিদ কোনটি?" আল্লামা গুগল এই মসজিদে রহমানুর রহিমের নাম বলে।
ছবি যেটা এখানে আপলোড দিলাম তা দেখে আমার নিজের কাছেই মনে হচ্ছে যে সৌন্দর্যের দশভাগের একভাগও ফুটে ওঠেনি এতে। এরপরও সাধ্যমত দেখানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস। এখানে শাফেয়ী মাযহাবের অনুসরণ করা হয়।

ইমাম সাহেব প্রতি দুই রাকাত পড়াতে সময় নিয়েছেন ২০ মিনিট করে। আর তিলাওয়াত তো, আল্লাহু আকবার, এতদিন তো তাদের তারাবীহর কথা লোকমুখে শুনে এসেছিলাম। আজকে নিজ থেকে স্বীকারোক্তি দিচ্ছি, সত্যিই, এই তিলাওয়াত শুনতে শুনতে যদি একটারাত মুগ্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায়, জীবন স্বার্থক।

আজ দুপুরে রাস্তায় বের হয়ে চোখে পড়েছে হরেকরকম ইফতারের সমাহার। হোটেল মালিকরা বিভিন্ন আইটেম সাজিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় আছে। আর খাবারের গুণগত মানে এলাকায় যেসব হোটেলের নামযশ আছে, তাদের দোকানের সামনে ইতিমধ্যেই লম্বা লাইন পড়ে গেছে। মহিলা আর পুরুষরা দুই লাইনে দাঁড়িয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু খরিদ করছে।

রমজান নিয়ে এলাকাবাসীর প্রস্তুতিও ব্যাপক। শিশু কিশোর থেকে নিয়ে শুরু করে একেবারে বয়সের ভারে কুজো হয়ে পড়া বৃদ্ধা বুড়িমা, সকলেরই এই প্রস্তুতিতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। এলাকার ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে দশ টাকা করে চাদা তুলে রঙ বেরঙের কাগজ, বাতিসহ রাস্তা সাজানোর নানান সামগ্রী কিনে এনেছে। আমাদের ফ্ল্যাট থেকেও তিনটা পিচ্চি এসে চাদা নিয়ে গেছে।

রোজার শুরুর দিকে শহরের বেশিরভাগ কর্মস্থলের কর্মচারীরা, বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে এসেছে দোকানপাট বন্ধ করে গ্রামে চলে যায় পরিবারের সাথে কয়েকটি রোজা কাটানোর জন্য। এদিকে সুপারশপগুলোতে রাতভর ভীড় লেগে থাকে সেহরী ও ইফতারের কেনাবেচায়। চারিদিকে উৎসবের এই আমেজের মধ্যে মিশরী শিশুদের কন্ঠে মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসে রমজান নিয়ে গাওয়া কোরাসের সুর। সে যেন এক ভিন্ন আবেশ তৈরী করে।



Wednesday, May 24, 2017

কায়রোর দিনলিপি (৩)

অবশেষে কাগজপত্র হাতে পেলামঃ

চারদিন মিশরীয় রোদে পুড়ে পুড়ে এম্বাসীতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত লেটারগুলো হাতে পেলাম। এখন তাহরীর স্কয়ারের কড়া রোদে দাড়িয়েও ভেতরে অনাবিল শান্তির সুবাতাস বয়ে যাচ্ছে। শাব্বির মামা আর আব্দুল্লাহ ভাইকে বিশেষ ধন্যবাদ দিতেই হবে। উনারা না থাকলে আরো কয়দিন যে এই কড়া রোদে কাঠখড় পুড়িয়ে এম্বাসীতে যাওয়া লাগতো কে জানে।

আলহামদুলিল্লাহ, বাকিসব কাগজপত্রও প্রস্তুত। আগামীকাল ইনশাল্লাহ, আল আযহার শরিফে ভর্তির জন্য নাম জমা দিতে যাচ্ছি। ভাগ্য ভাল থাকলে এক মাস, আর খারাপ থাকলে দুই মাস, আরো বেশী খারাপ থাকলে বড়জোর তিনমাস অপেক্ষা করতে হবে নাম আসার জন্য। সবার কাছে বিশেষভাবে দুয়া চাচ্ছি।

এখন আপাতত ক্বিরাতের উপর ইজাযা নিতে একটা মারকাযে ভর্তি হয়েছি। রমজান এলে সাধারণত এইধরনের মারকাযগুলোতে বেশ ভীড় লেগে যায়। মিশরীরা এমনিতেও তিলাওয়াতের ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস। আর রমজানে এই সিরিয়াসনেস কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আমি সপ্তাহে দুইদিন শুনানোর সুযোগ পেয়েছি। তবে আমার যেহেতু তাড়াহুড়ো নেই এবং ভর্তির আগ পর্যন্ত সময় আছে তাই যে কয়টা ক্বিরাতের উপর ইজাযাহ নেয়া যায় নিয়ে ফেলবো ভাবছি। আর এ সময়ের ভেতর মিসরটাকে ভালভাবে পড়তে হবে। এখানে তো মিসরকে পড়ার জন্য রীতিমত ভার্সিটিগুলোতে বিশেষ ফ্যাকাল্টি পর্যন্ত আছে। তারা একে কুল্লিয়াতুল আছার বলে। এর মধ্যে ফারাও সভ্যতা ও ইসলামী সভ্যতার আলাপ বেশ গভীরভাবে আছে। এবং গ্রীক ও রোমান সভ্যতার প্রাসঙ্গিক ব্যাপারগুলোও চলে আসে। তো সব মিলিয়ে এই ইজিপ্টলজি এক বিশাল জিনিষ।

কায়রোতে আসার পর থেকে নিজের কাজ নিয়েই এতদিন ব্যস্ত সময় কাটলেও অনেক কিছুই দেখা হয়ে গেছে। মিশরীদের হরেকরকম খাবারের এক্সপেরিমেন্ট করার ফিরিস্তি ইতিমধ্যেই অনেক লম্বা হয়ে গেছে। প্রত্যেকটি আইটেম স্বতন্ত্র পোষ্টের দাবী রাখে। সেগুলো নিয়ে পরে কখনো আলাপ হবে।

আসার পরদিনই যুবায়ের ভাই নিয়ে গিয়েছিল মুজ্জামায়। ওরা বলে মুগাম্মা। মিসরীদের কাছে জিমের উচ্চারণ "গ" আর ক্বফের উচ্চারণ "আ"। তাই তাদের আঞ্চলিকতাটা ধরতে ভালই কষ্ট হয়। তবে এদের আম্মিয়ার সাথেও ফুসহার ভাল একটা যোগাযোগ আছে। ব্যাপারটা ড. শহিদুল্লাহ ফজলুল বারি রহ. ক্লাসে আমাদেরকে বলেছিলেন। হুজুরের কথা মনে পড়তেই এখন শুধু দুয়া আসে। রাহিমাহুল্লাহু তায়ালা।

তো আমি ছিলাম মুজ্জামার সামনে। সেই বিশাল দালানটি দাঁড়িয়ে আছে তাহরীর স্কয়ারের দিকে মুখ করে। মুজাম্মা থেকে তাসজিল নিতে হয়। মানে হচ্ছে মিসরে আসার পরদিনই সর্বপ্রথম আমি যে জায়গায় গিয়েছিলাম সেটা ছিল তাহরীর স্কয়ার। এখানে তাহরীরের চত্বরের ছবি তোলা নিষেধ। পুলিশ দেখতে পেলে নাকি খবর আছে। তাও আজ দুপুরে লুকিয়ে এই ছবিটা তুলে ফেলেছি। কিন্তু প্রথমদিন সাহস পাইনি।সেদিন অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। যতক্ষণ তাকিয়ে থাকলে স্মৃতিপটে নিখুঁতভাবে সে দৃশ্যধারন করে রাখা যায় তার চেয়েও বেশিক্ষণ।
এরপর যখন মুজাম্মায় ঢুকার জন্য লম্বা লাইনে দাড়িয়েছিলাম তখন পেছন ফিরে তাহরীরে কিছু একটা খুজছিলাম। তাহরীরে ঠিক মাঝখানে কি শাপলার মত কিছু একটা আছে? আরে ধুর! যত্তসব হেফাজতী সেন্টিমেন্ট!

কায়রো শহরের মাইদানুল জাইশে যে বাসায় উঠেছি তার পেছনের রাস্তাটাই ১২০০ বছর পুরোনো ফাতেমী খেলাফতের প্রাচীন সব ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আছে বিশাল এলাকা জুড়ে পুরাতন সব কেল্লা। হাজার বছর আগে যে বাজার থেকে আজীজে মিসর নবী ইউসূফ আ কে ক্রয় করেছিল সে বাজারটি এখন বেশ জমজমাট। এগুলো সময় নিয়ে দেখতে হবে। জানতে হবে। আসলেই জানার ও দেখার অনেক অনেক কিছু ধারণ করে রেখেছে এই হাজার বছরের এই শহর।

Sunday, May 21, 2017

কায়রোর দিনলিপি (২)

ব্যাচেলর লাইফের অভিজ্ঞতাঃ

জীবনে প্রথমবারের মত মাছে মসলা মাখানো সহ ব্যাচেলর লাইফে অর্জন করা আবশ্যক এমন অনেক অভিজ্ঞতাই হয়েছে গত এক সপ্তাহে। তবে আফফান ভাই আর কামরুল ভাইয়ের মত পাকা হাতের রাঁধুক থাকতে রান্নাঘরের এসিস্টেন্ট হিসেবে আমার কাজকাম খুব একটা কষ্টসাধ্য হয়নি। আর যুবায়ের ভাই তো চা আর বাকরখানিতেই দিব্যি তার দিবারাত্রি পার করছেন।

কায়রোতে এত সস্তাদরে এত সুস্বাদ মাছ পাওয়া যাওয়াটা আমাদের বাঙালীদের জন্যে সৌভাগ্যের বটে। তাই রাতবিরাতে ব্যাচেলরদের এহেন রান্নাবান্নার চিত্র আপনার জিভেজল নিয়ে আসলেও সেই "জল"এর জন্য আপনি কোনভাবেই আমাদেরকে দোষারোপ করতে পারেননা।

সুন্দরী এই মাছখানার নাম না জেনে শুধুমাত্র এর স্বাদ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার ব্যাপারটা প্রথমে আমাদেরকে খানিকটা দুঃখ দিয়েছে। এবং যখন তার মায়াবী চাহনীমাখা চোখ বিশিষ্ট এইটুকুন মাথার বিশাল অংশজুড়ে থাকা মগজের স্বাদ জিহ্বায় লাগলো তখন সে দুঃখের কথা বিশেষ মনে থাকেনি।

Sunday, May 14, 2017

কায়রোর দিনলিপি (১)

প্রথম চব্বিশঘণ্টাঃ
গতকাল এয়ারপোর্ট থেকে আসার পথে কোন এক জায়গায় মোবাইলটা হারিয়ে ফেলা ছাড়া বাকি অনুভূতিগুলো ভালই ছিল।
এই যেমন গতরাতের ডিনারে সাত পাউন্ডের সুস্বাদু "হাওয়াশী" খাওয়া থেকে নিয়ে শুরু করে আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের সাহায্যে অল্প সময়ের ভেতরই পুরো কায়রো শহর ঘুরে আসা তাও আবার মাত্র দুই পাউন্ডে। মিসরী এক পাউন্ড এখন আমাদের দেশের চার, সাড়ে চার টাকার মত। সে হিসেবে তো সবকিছুই বেশ কম। 
শহরটাও দেখতে সুন্দর। দুপুরের কড়া রোদটুকু বাদ দিলে বাকি সময়ে ঘুরেফিরে বেশ সুখের একটা অনুভূতি হবে। বিশেষ করে মাগরিবের পরের মৃদু বাতাস গায়ে মাখিয়ে ঘুরলে তো কথাই নাই। মজার ব্যাপার হল, এত রোদেও শরীর একদম ঘামেনা। শুধু চেহারাটা একটু কালা হয়া যায়, এই আর কি... 

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...