১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সাল। একদিকে চলছে
বিশ্বযুদ্ধ, অন্যদিকে ভারতবর্ষের ওলামায়ে কেরামের উপর ইংরেজদের নির্যাতন।
এই আন্দোলনে ইংরেজরা পঞ্চাশ হাজারেরও
অধিক আলেমদের ফাঁসির কাষ্টে ঝুলিয়েছে। কালাপানি, সাইপ্রাস, আন্দামান ও মাল্টার
দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে হাজার হাজার আলেমওলামাকে। শুধু দিল্লিতেই সে সময় মাদরাসার সংখ্যা ছিল চার
হাজারেরও অধিক। ইংরেজরা সমস্ত মাদরাসা বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে দ্বীন রক্ষার্থে আলেমদের কুরবানীর সেই
স্বর্ণযুগেও কিছু দরবারী আলেম নিজেদের ইংরেজদের কাছে গিয়ে সপে
দিয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে
ব্রিটিশ সৈন্যরা অন্যায়ভাবে দুটি তুর্কি জাহাজ আটক করে। এর প্রতিক্রিয়া হয়
বিশ্বজুড়ে। যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তখন বিশ্ব দুইটি শিবিরে ভাগ হয়েছিল। একপক্ষে ছিল ভারত শাসক ব্রিটিশ আর
তাদের মিত্ররা। অন্যপক্ষে ছিল জার্মানি, তুরস্ক, হাঙ্গেরী ও অষ্টিয়া।
ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতাকামীর সংখ্যা কম ছিল না। যার ফলে ইতিহাসের পাতা উল্টালে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যেই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা কমবেশী লক্ষ্য করা যায়। সেবার শুরুটা হয়েছিল জার্মানিতে অধ্যায়নরত কিছু ভারতীয় ছাত্র ও স্বাধীনতাকামী কিছু বুদ্ধিজীবীর মাধ্যমে। তারা তুর্কি ও জার্মানের সাথে মিলে ভারতের ব্রিটিশ শক্তিকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিল।
এই পরিকল্পনা সফল করার জন্য আফগানিস্তানের সহায়তা জরূরী ছিল। তুরস্ক থেকে সৈন্যবাহী জাহাজ ভারত আসতে আফগানের করিডোর ব্যবহার করার বিকল্প ছিল না। কিন্তু আফগানেও তখন
ছিল বৃটিশপন্থী সরকার। তাই গোপনে তুর্কি ও জার্মানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাদের
সাথে নিয়ে কয়েকজন স্বাধীনতাকামী ভারতী আফগান সফরে আসলো। উদ্দেশ্য ছিল আফগান
সরকারকে বৃটিশ বিরোধী ভূমিকায় উদ্বুদ্ধ করা।
এ সময় শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান
রহ.কে তুর্কি ও আফগান সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ আলাপ আলোচনার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সক্রিয়তা টের পেয়ে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়ে যায় তাদের উপর। শায়খুল হিন্দ
ওবাইদুল্লাহ সিন্ধিকে পাঠিয়ে দেন কাবুলের পথে। এবং নিজে রওনা হন হিজাজের পথে।
কাবুলে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল আফগান সরকারের সহযোগিতা নিশ্চিত করা ও আফগান সীমান্তে
থাকা স্বাধীনতাকামীদেরকে সংগঠিত করে ভারতের আজাদী আন্দোলনের কাজে লাগানোর ব্যবস্থা
করা।
১৯১৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ওবাইদুল্লাহ
সিন্ধি রহ. কাবুল পৌঁছেন। কাবুল সরকারকে সহযোগিতায় রাজি করান। এবং তুর্কি ও
জার্মানি মিশনের সাথে কাজ করতে রাজি হন। ওবাইদুল্লাহ সিন্ধি সেখানে গিয়ে অনেক
স্বাধীনতাকামীদের দেখতে পান। এবং সেখানে একটি অস্থায়ী ভারত সরকার গঠন করেন।
তুর্কি- জার্মান মিশনের সমন্বয়কারী প্রতিনিধি রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে এই সরকারের
প্রেসিডেন্ট, বরকতুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী, এবং হযরত সিন্ধি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর
দায়িত্ব নেন।
১৮ই সেপ্টেম্বর শাইখুল হিন্দ মক্কা
পৌঁছেন। মক্কা মদিনা তখন ছিল তুর্কি খেলাফতের অংশ। তিনি গিয়ে হিজাজের গভর্নরের
গালিব পাশার সাথে সাক্ষাত করেন। গালিব পাশার তখন ধর্মীয় প্রভাব ছিল অনেক। তিনি
দুটি পত্র লিখেন। একটি পাঠানো হয় মদিনার গভর্নর বসরী পাশার কাছে আরেকটি আফগান
গোত্রপতি মুসলমানদের কাছে। এতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান ছিল।
ইতিহাসে এই চিঠিকে “গালিবনামা” বলা হয়। আরেকটি চিঠিতে ছিল শায়খুল হিন্দের প্রস্তাব
অনুযায়ী আফগান ভূখন্ডকে যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করার অনুরোধ। এই চিঠিকে “গালিবের
চুক্তিনামা” বলা হয়।
শায়খুল হিন্দ অতঃপর তুরস্কের
যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশার সাথে সাক্ষাতেরও পরিকল্পনা করেলেন। মদিনায় পৌঁছে জানতে
পারলেন তিনি তুরস্ক থেকে মদিনায় রওজার জিয়ারতে এসেছেন। সেখানেই সাক্ষাত হয়ে গেল।
তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সহায়তার আশ্বাস দিলেন ও একটি চুক্তি সাক্ষর করলেন।
তিনি শায়খুল হিন্দকে তিনটি চিঠি লিখে দিলেন।
একটি ছিল অস্থায়ী ভারত সরকার ও
তুর্কি সরকারের মধ্যকার চুক্তিনামা।
দ্বিতীয়টি মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে
শায়খুল হিন্দকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান।
তৃতীয়টি ছিল আফগান সরকারের প্রতি।
এবং সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়
আফগান সরকার সম্মত থাকলে তুর্কি বাহিনী সীমান্তে অবস্থান নিবে। ১৯ ফেব্রুয়ারী ১৯১৭
সালে সেই বাহিনী ভারতে প্রবেশ করবে এবং অভ্যুত্থান ঘটাবে। সেই সময় শায়খুল হিন্দ
আফগানিস্তান থেকে সামগ্রিক দিক নির্দেশনা দিবেন।
ওবাইদুল্লাহ সিন্ধির নেতৃত্বে এই
পত্র আফগান সরকারের নিকট পৌঁছানো হল। কিন্তু তিনি পররাষ্ট্র চাপের কথা তুলে প্রথমে
সম্মতি দিতে চাইলেন না। কিন্তু প্রশাসনের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ ও জনগণ স্বাধীনতাকামীদের
সমর্থন করছিল। শেষ নাগাদ চুক্তি হল আফগান সরকার নিরপেক্ষ থাকবে। তবে তুর্কি বাহিনী
আফিগান সীমান্ত দিয়েই ভারতে প্রবেশ করবে। আর যদি কোন আফগানী এই যুদ্ধে যেতে চায়
তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে কোন নিষেধ থাকবেনা। ইংরেজদের দেয়ার জন্য কৈফিয়তও প্রস্তুত
রাখা হল, “সীমান্তের স্বাধীনতাকামীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে আফগান সরকার”।
এরপর যেই কাজটি করা হল সেই নামেই এই
আন্দোলনের নামকরণ করা হয়। ইংরেজ বাহিনীর কড়া পাহাড়ার ফলে তথ্য ফাস হওয়া ভয় ছিল।
তাই নিরাপত্তার স্বার্থে ওবাইদুল্লাহ সিন্ধি রহ. একটি রেশমি রুমালে সুতা দিয়ে
আরবিতে পত্র লিখে শায়খুল হিন্দের কাছে তা পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। অনেকগুলো হাত
বদল হয়ে এই রুমালটি শেখ আব্দুর রহিমের হাতে পৌঁছে। তিনি হজে গিয়ে রুমালটি শায়খুল
হিন্দের হাতে দিবেন।
কিন্তু এর মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়।
আফগান আমির হাবিবুল্লাহ বিরাট অর্থের বিনিময়ে ইংরেজদের কাছে এই তথ্য বিক্রি করে
দেয়। খবর পাওয়া মাত্রই ব্রিটিশ গোয়েন্দা আব্দুর রহিমের বাড়ি তল্লাশি করে এই রুমাল
জব্দ করে। এরপর আব্দুর রহিম আত্মগোপনে চলে যান। কথিত আছে তিনি আর কখনো জনসম্মুখে
ফিরে আসেনি।
এই ঘটনার পর ইংরেজ সরকারের আলেম
ওলামাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। হেজাজ থেকে গ্রেফতার করা হয়
আন্দোলনের প্রধান নেতা শায়খুল হিন্দ ও তার ছাত্র হুসাইন আহমদ মাদানী। এবং তাদেরকে
মাল্টা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
তথ্যসুত্রঃ
উপমহাদেশে আলেম সমাজের বিপ্লবী ঐতিহ্য
(উর্দুঃ উলামায়ে হিন্দ কি শানদার মাযি)
চেপে রাখা ইতিহাস
তারিখে দেওবন্দ
উবাইদুল্লাহ সিন্ধির ডায়রী
No comments:
Post a Comment