Friday, February 14, 2020

খৃষ্টবাদের বিদাত ও একনায়কতন্ত্রিক ধর্মান্ধতা

ক্যাথোলিক পোপ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বিবাহিতরা পাদ্রী হতে পারবে না। অর্থাৎ ভ্যাটিকান তার হাজার বছরের সিদ্ধান্ত থেকে বের হতে পারছে না। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। 

ক)  একক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে ধর্ম চলছে। ইসলামে এটা ভাবাই যায় না। কাবা শরীফ ইসলামে অত্যন্ত সম্মানিত জায়গা, দেওবন্দ বা আজহার বড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, তবে কারো পক্ষেই একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা নাই। কোরআন-সুনানের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে পারলে বাংলাদেশের কোন প্রান্তিক অঞ্চল থেকেও কেউ এর বিরোধিতায় দাড়াতে এবং ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। 

খ) বিবাহিতরা পাদ্রী হতে পারবে না, এটা মূলত একটা বিদআত। এর সূচনা হয়েছে হাজার বছর আগে। এর আগে খৃস্টান ধর্মে এর প্রচলন ছিল না। ইসলামে এমন সার্বজনীন বিদআতের কথা ভাবাও যায় না। এত দীর্ঘমেয়াদীভাবে কোন বিদআত টিকে থাকে এবং তথাকথিত সংস্কারবাদী পোপ তাতে সম্মতি জানান - বুঝেন অবস্থা ! 

গ) সবচেয়ে বড় কথা বিবাহের মতো স্পষ্ট হালাল ও অধিকারের বিষয় পোপ বা গির্জা হারাম বানায় কীভাবে, মানুষ কীভাবে  এই এখতিয়ার পেল? দেখুন, গণতন্ত্রেরও ঠিক একই সমস্যা। তারা আইন প্রণয়ন করে। অবৈধ প্রতারক চক্র সংসদে বসে মানুষের বৈধ-অবৈধ ঠিক করে দেয় ; আঠারো বছরের আগে বিবাহ করা যাবে না। *

ঘ) আমরা অনেক সময় মনে করি, গির্জা বা খৃস্টান ধর্মীয় ব্যবস্থায় বোধহয় গণতন্ত্র নেই। আদতে সেখানেও 'গণতন্ত্র' আছে। পাদ্রী-বিশপরা পোপ নির্বাচিত করেন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পোপের স্বৈরতন্ত্রসহ  বাকীদের মতামত নেবার ব্যবস্থা আছে। তবে গির্জার মতো গণতন্ত্রেও মৌলিক কিছু সমস্যা আছে। বিদআতের কথাই ধরুন, কিছু একক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কীভাবে মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, গির্জার মতো আধুনিক গণতন্ত্রও এভাবে স্বৈরাচার জারি রেখেছে। **  

এই লোকগুলোই আবার ধর্মীয় আইনের কথা বলে ইসলামি শরিয়তের বিরোধিতা করেন। ট্র্যাম্প তার ভাষণে শরিয়া ল উচ্চারণ করতে গিয়ে কীভাবে মুখ ও উচ্চারণ বিকৃত করেছিলেন, সেটা ভুলতে পারি না !

ইফতেখার জামিল

Thursday, February 6, 2020

ইতিহাসে ফিকহ ও তুরাছের গুরুত্ব কেন বেশী

যারা আধুনিক আইন বা সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন, তাদের অধিকাংশের একটা বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তারা ইসলামি ফিকাহ জানেন না। ফিকাহ ইসলামি চিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দু ; ফিকাহের মানে শুধু কোরআন-হাদিস নয়, পাশাপাশি চৌদ্দশো বছরের অভিজ্ঞতা ও চর্চা। সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মোকাবেলা। এখানে কত বিষয়ের  পর্যালোচনা, আলোকপাত ও ব্যাখ্যা আছে, সেটা ফিকাহের কিতাবগুলোর বিষয়বস্তু দেখলেই বুঝা যাবে। আমাদের প্রচলিত আইন ও সমাজতত্ত্ব কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতার এমন অভিজ্ঞতার ওপরেই দাড়িয়ে আছে।

 তবে তলিয়ে দেখলে ধরতে পারবেন, পশ্চিমা সভ্যতায় ব্যাপক পরিসরে গ্রন্থ উৎপাদনের বয়স তিন থেকে চারশো বছর, তাই ক্লাসিক্যাল কাজকর্মের হিসেব করলে মুসলিম লেখাজোখার সংখ্যা অনেক বেশী। সমকালীন লেখাজোখার অবশ্যই গুরুত্ব আছে, তবে ক্লাসিকের স্বাদ ও গভীরতা অনেক বেশী। বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে হয়তো বড়জোর পাঁচ-দশটা বই ক্লাসিক্যাল অর্থে কিতাব হবার যোগ্যতা রাখে। বাকীগুলো নোট, নকল বা খাতা, ইসলামি ইতিহাসে এসব বিষয়েরও দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। 

পশ্চিমাদের রেনেসাঁ যুগে শিক্ষিতদের প্রায় সবাই ল্যাটিন জানতেন। আদতে ধারাবাহিকতাহীন কোন রেনেসাঁ সম্ভব হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, আরবি ছাড়া আপনি কি ইসলাম শিখতে ও ভালো মুসলমান হতে পারবেন না? অবশ্যই পারবেন। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা বা মুসলমানিত্বের কথা বলা হচ্ছে না। গবেষণা ও আত্মানুসন্ধানের প্রসঙ্গ আনা হচ্ছে। ক্লাসিক কিতাব তৈরি হতে সময় লাগে, সভ্যতাগত স্থিতিশীলতা লাগে, যার অনেককিছুই এখন অপ্রতুল। তাই চৌদ্দশো বছরের বিকল্প হাতছাড়া কেন করবেন? 

বলে রাখা ভালো, আমি ব্যক্তিগতভাবে মোটেই ইংরেজি বা পশ্চিমা শিক্ষার বিরুদ্ধে না। তবে ত্রিপল আইটির গবেষণা যেমন বলেছে, ইসলামি সভ্যতায় রাজনীতি বিষয়ক অমুদ্রিত প্রায় কয়েক শো গুরুত্বপূর্ণ বই আছে, মাকাসেদ বিষয়ক বই আছে কয়েক ডজন, নিজুত মানুষের হালাকাজাত অভিজ্ঞতার সঞ্চিত জ্ঞান অনেকটা গুপ্ত ধনের মতই , বরং তারচেয়েও বেশী পবিত্র, চিন্তার সাথে তো সম্পদের তুলনা হয় না। যদি মিসরের পিরামিডের রাজা-বাদশাদের মমি অত গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে আমাদের ক্লাসিক কিতাবগুলো কেন নয়?

ইফতেখার জামিল

Saturday, February 1, 2020

ফতোয়া আন্দোলন : নীরব বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই



ইমরান আব্দুল্লাহ:

একটি গ্রাম্য সালিশকে ফতোয়া আখ্যা দিয়ে ২০০১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি সব ধরনের ফতোয়াকেই নিষিদ্ধ বলে রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি গোলাম রব্বানির নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ। হাইকোর্টের এ বিচারপতির পক্ষ থেকে এটাই একমাত্র আঘাত ছিল না, বরং হাইকোর্টে থাকাকালীন তিনি আরও একাধিক মামলায় কুরআন-বিরোধী রায় দিয়েছেন। এমন একটি মামলা ছিল তালাক-পরবর্তী খরপোষ বিষয়ে। রায়টি আপিল বিভাগে বাতিল হয়ে যায়। ঠিক তেমনি ২০১১ সালে এসে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়টিও আপিল বিভাগে বাতিল হয়ে যায়।

কিন্তু এত সহজেই বাতিল হয়নি রায়টি। এজন্য ময়দানে যেমন আন্দোলন করতে হয়েছে, তেমনি কোর্টে লড়তে হয়েছে, দৃশ্যপটের আড়ালে লড়াই করতে হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও। বরং বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটাই সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। এ লড়াইটা না করলে আঁধারে তির ছোঁড়ার মতোই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেত আপিলের চেষ্টা। বু্দ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের গল্পটা এখানে একটু বলি।

বই লেখা

ফতোয়ার যে সংজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে বিচারক গোলাম রব্বানি ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় দিয়েছিলেন, সে সংজ্ঞাই ছিল ভুল। তিনি বলেছেন, ‘ফতোয়া’= হচ্ছে আইনগত কর্তৃপক্ষের আইনানুগ মতামত।’ অথচ শরিয়তে ফতোয়ার সাথে আইনগত কর্তৃপক্ষ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই এবং এটি কোনো বিচারিক রায়ও নয়। এক্ষেত্রে রব্বানি সাহেব জেনে বা না জেনে ফতোয়ার ভুল সংজ্ঞার আশ্রয় নিয়েছেন সকল ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করার জন্য। অন্যথায় ইসলামি বিচারব্যবস্থায় এ ধরনের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো প্রয়োজন হয় না; কেননা ‘হিদায়াহ’সহ ফিকহের বিশাল গ্রন্থগুলোর ‘আদাবুল কাযী’ অধ্যায়ে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো বিচারক শরিয়াহ পরিপন্থী কোনো রায় দিলে তা আপনাআপনিই বাতিল বলে বিবেচিত হবে।

ফতোয়া নিয়ে যেহেতু বিচারকদের মাঝেই জ্ঞানের কমতি আছে, এই কমতি দূর না করলে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেও লাভ হবে না। তাই আপিলের শুনানি শুরু হলে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি তৈয়ব সাহেবের উকিল মুজিবুর রহমান বললেন, ‘আপনারা ফতোয়া নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটি বই লিখে দেন। বইটি আমরা বিচারকদের হাতে দিই; যেন তারা বিষয়টা বুঝতে পারেন। তাদের সামনে যেন ফতোয়ার ধারণাটা স্পষ্ট হয়।’

ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের কাছে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুফতি তৈয়ব বলেন, লালবাগে মিটিং হলো বইটি কে লিখবে। একজন বড় মুফতিকে দায়িত্ব দেয়া হলো। কিন্তু দুদিন পর আরেক মিটিংয়ে তিনি জানালেন, বইটি এত কম সময়ে তিনি লিখতে পারবেন না। এদিকে শুনানি চলছে, হাতে সময়-ও নেই। উপায় না দেখে মুফতী আমিনী রহ. আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ.-কে বললেন, আপনি লিখে দেন। আবুল ফাতাহ সাহেব বললেন, আমি তো মুফতি না। আমিনী সাহেব ভরসা দিয়ে বললেন, কাজ করতে মুফতি হওয়া লাগে না। আপনি কাজ করুন, আমরা সাহায্য করব।

মুফতী তৈয়ব বলেন, আবুল ফাতাহ সাহেব মাত্র তিনদিনে ‘ফতওয়া ফিকহ হাদীস’ শিরোনামে বইটি লিখে শেষ করেন। বইয়ের কপি বিচারকদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এই বইটির মাধ্যমে তাঁরা ফতোয়া ফিকহ এবং হাদীস সম্পর্কে সুস্পষ্ট একটা ধারণা লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৬০ পৃষ্ঠার বইটি বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত হয়।’

এমিকাস কিউরিদের তথ্য সরবরাহ

২০১১ সালের পয়লা মার্চ থেকে আপিল শুনানি শুরু হলে সুপ্রিমকোর্ট ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীকে এই মামলার এমিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত করেন। নিযুক্ত এমিকাস কিউরিদের কেউ কেউ ফতোয়া, ফিকাহ, হাদিস সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, এগুলোর নির্ভরযোগ্যতা, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং আইনের সাথে এগুলোর সম্পর্ক জানতে চেয়ে শীর্ষ আলেম-উলামাদের কাছে চিঠি পাঠান। এই চিঠির উত্তরে এসব বিষয়ে দলিল-প্রমাণ, আলোচনা-বিশ্লেষণ সরবরাহ করেন শীর্ষ আলেমগণ। বিশেষ করে মারকাযুদ দাওয়াহ’র পক্ষ থেকে কয়েকজন এ কাজে এমিকাস কিউরিদের সহায়তা করেন।

সিনিয়র আইনজীবীদের পাশাপাশি আদালত ৫ জন শীর্ষ আলেমকেও এমিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত করেন। আলেম এমিকাস কিউরিদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন ফতোয়া পক্ষের হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মাওলানা নজরুল ইসলাম। তিনি আলেমদের কথা শুনেন এবং আদালতে একজনের কথা যেন আরেকজনের সঙ্গে মিলে না যায়, তা তিনি বুঝিয়ে দেন। অথবা আরও কিছু কথা যুক্ত করার মতো মনে হলে তাও বলে দেন। এমনভাবে তিনি আদালতে বক্তব্য দেয়ার জন্য প্রস্তুত করেন আলেমদের।

শেষকথা

হাইকোর্টে যুক্তি-তর্কের ওপর ভিত্তি করেই আলেমগণ বসে থাকেননি। বরং তারা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ দিয়ে বিচারকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতা বদলে দিতে চেয়েছেন। যেখানে যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, কাজে লাগিয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক এই কাজগুলো না করলে বিচারকরা হয়তো অন্যকিছু ভাবতেন। তখন ফতোয়ার পক্ষে রায় আসাটা অসম্ভব হয়ে যেত।


-ফাতেহ২৪

ফতোয়া আন্দোলন : আদালতে রায়ের মোকাবেলা



মুনশী নাঈম:

২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাবাজার পত্রিকায় নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নের আতিথা গ্রামে এক গৃহবধূকে ফতোয়া দিয়ে হিল্লা বিয়ে করতে বাধ্য করার বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার আদালত কেন ফতোয়া প্রদানকারী হাজি আজিজুল হকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না—এ বিষয়ে নওগাঁর জেলা প্রশাসক, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি এক স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমেটো) রুল জারি করেন। পরে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি দুই বিচারপতি ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে বলেন, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইনসংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

ইসলাম ও শরিয়াহর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক এ রায়ে চমকে ওঠেন এ দেশের ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী এবং উলামায়ে কেরাম। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। ঠিক সে সময় আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. হাইকোর্টের রায়দাতা দুই বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও নাজমুন আরা সুলতানাকে মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে ফতোয়া প্রকাশ করেন। এবং হাইকোর্টের ফতোয়া-নিষিদ্ধের রায়ের বিরুদ্ধে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে দুর্বার আন্দোলনের ডাক দেন। পুরো দেশ তখন আমিনী রহ.-এর এই সাহসী আহ্বানে সাড়া দিয়ে গর্জে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে হকপন্থী সমস্ত উলামায়ে কেরাম তাঁকে সমর্থন জানান।

৪ ফেব্রুয়ারি দিনের বেলা মুফতি আমিনী রহ.-কে লালবাগ থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপর এই দিনই রাতের বেলা দিনাজপুরের একটি জনসভা থেকে ফেরার পথে গাজিপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, আবদুল লতিফ নিজামি, মুফতি ইজহার , জুনায়েদ আল হাবীবসহ আরও অনেক নের্তৃবৃন্দকে।

এরপরই মূলত হাইকোর্টের ফতোয়া-নিষিদ্ধের রায়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু হয়। এসময় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে পাঁচটি আবেদন করা হয়। এর মধ্যে ২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি তৈয়বের পক্ষে মুজিবুর রহমান এবং কিছুদিন পর আবুল কালাম আজাদের পক্ষে আবদুর রাজ্জাকের আপিল দুটি গ্রহণ করা হয়। সেই আইনি লড়াইয়ের প্রক্রিয়া জানতে চেয়ে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের পক্ষ থেকে আমরা কথা বলেছি ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতী মুহাম্মদ তৈয়বের সঙ্গে।

যেভাবে আইনি লড়াই শুরু

আইনি লড়াইয়ের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল জানতে চাইলে মুফতী তৈয়ব বলেন, দেশজুড়ে তখন আন্দোলন চলছে। কিন্তু মুফতী আমিনী, শায়খুল হাদীসের মতো বড় বড় নেতা ময়দানে নেই। তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দেয়া হয়েছে। জেল থেকেই মুফতী আমিনী মাওলানা মুহিউদ্দিন খান সাহেবকে খবর পাঠালেন, ‘হাইকোর্টে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের মোকাবেলায় একটা আপিল করে রাখেন।’ যেহেতু ফতোয়া নিয়ে মামলা, খান সাহেব চাইছিলেন বড় কোনো মুফতি আপিলটা করুক। কিন্তু বড় বড় মুফতিদের তখন অনুরোধ করার পরও আপিল করতে কেউ রাজি হননি। কারণ সবাই ভয় পাচ্ছিলেন, এখানে মুফতী আমিনী জড়িত থাকার কারণে রাজনৈতিকভাবে হয়তো তাঁরা ফেঁসে যেতে পারেন। সবাই যখন নিরাপদ দূরত্বে নিজেকে সরিয়ে নিলেন, একদিন খান সাহেব আমাকে বললেন, তুমি ইফতা পড়োনি? আমি বললাম, আমি দু বছর আগে লালবাগে মুফতী আমিনী সাহেবের কাছেই ইফতা পড়েছি। খান সাহেব বললেন, তুমিই আপিল করো।

কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। আমার তো ইফতার সার্টিফিকেট নেই। আপিল করতে গেলে তো মুফতির সার্টিফিকেট দাখিল করতে হবে বিষয়টাকে অথেনটিক করার জন্য। তখনো লালবাগে ইফতা বিভাগে সার্টিফিকেট দেয়া শুরু হয়নি। কারও কোথাও দরকার হলে হাতে লিখে সত্যায়ন দেয়া হতো। মুফতী আমিনী সাহেবের সঙ্গে জেলে দেখা করে বললাম, খান সাহেব আমাকে আপিল করতে বলছেন। কিন্তু আমার তো মুফতির সার্টিফিকেট নেই। হুজুর তখন লালবাগ মাদরাসায় খবর পাঠালেন, ইফতা বিভাগের সার্টিফিকেট তৈরি করা হোক। দুদিনের মধ্যে খুব জলদি করে তৈরি করা হলো সার্টিফিকেট। এরপর লালবাগ মাদরাসার প্রথম সার্টিফিকেট তুলে দেয়া হয় আমার হাতে।

২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আমরা হাইকোর্টে আপিল করি। আমাদের উকিল ছিলেন হাইকোর্টের প্রভাবশালী প্রবীণ অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান। শুধু আপিলটুকুই করেছিলাম, শুনানির তারিখ-টারিখ কিছু পড়েনি। আপিলে বলা হয়,…এই ঘটনায় সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করা অযৌক্তিক। এটি ইসলামের বিধান ও বাংলাদেশের সংবিধানের ২ (ক), ৮(১), (১ক) ও ৪১ (১) অনুচ্ছেদের বিরোধী। এই রায় কুরআন-সুন্নাহর বিধানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে। কুরআনের বিধানের বিষয়ে হাইকোর্টের রায় দেয়ার অধিকার নেই।

এরপর আমার দেখাদেখি আপিল করেন জামায়াতে ইসলামীর আবুল কালাম আজাদ। তাঁর উকিল ছিলেন আবদুর রাজ্জাক।

জোট সরকারের আমলে

২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়। ক্ষমতায় আসে চারদলীয় জোট সরকার বিএনপি। মুফতী তৈয়বের কাছে প্রশ্ন রেখে বললাম, বিভিন্ন পত্রিকা লিখেছে, জোট সরকারের আমলে আপিল কোর্টে তোলার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। মুফতী তৈয়ব উত্তরে বলেন, পত্রিকাগুলো প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে। আমরা কয়েকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সরকার তা কোর্টে তুলতে দেয়নি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সঙ্গে মুফতী আমিনী এবং শায়খুল হাদীস সাহেব বারবার কথা বলেছেন, অনুরোধ করেছেন আপিলের শুনানির তারিখ দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি কথা কানেই তুলেননি বরং উল্টো আপিল তুলে নিতে চাপ দিয়েছিলেন। কারণ, বিএনপি ভাবছিল, হাইকোর্টে এখন যদি আবার ফতোয়ার মামলাটি তোলা হয়, ফতোয়ার পক্ষে রায় এলে সুশীল সমাজ ক্ষেপে উঠবে। বিপক্ষে রায় গেলে ক্ষেপে উঠবে তৌহিদি জনতা। তখন বিপদে পড়বে সরকার। তাই তারা আপিলের ফাইলটি একরকম ক্লোজড করে দিয়েছিল। মুফতি আমিনী রহ. তখন বলেছিলেন, আলেমদের সঙ্গে এই গাদ্দারি বিএনপির দীর্ঘ পতন ডেকে আনবে।

সরকার থেকেই যেহেতু আপিলের ফাইলটি খুলতে দেয়া হয়নি, তাই আদালতেও আমরা যেতে পারিনি। ফলত সবার মনে হয়েছে আমরা কোনো চেষ্টা করিনি।

চূড়ান্ত শুনানি

কখন আবার আপিলের ফাইলটি ওপেন হলো, জানতে চাইলাম। উত্তরে মুফতি তৈয়্যব বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে, ২০১১ সালের মার্চে আপিলের ফাইলটি ওপেন হয়। ২০০১ সালে যখন আপিল করি তখনই আমাদের আইনজীবী মুজিবুর রহমান বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন। তারপর কেটে গেছে নয় বছর। তিনি আরও দুর্বল হয়ে পড়লেন। তাই আমরা অ্যাডভোকেট মাওলানা নজরুল ইসলামকে উকিল হিসেবে নিয়োগ দিই। আমাদের এবং জামায়াতে ইসলামীর আপিল, দুটোর শুনানি একসঙ্গে হয়।

শুনাননি চলাকালীন আদালত ১০ অ্যাডভোকেট এবং পাঁচজন আলেমকে এমিকাস কিউরি হিসেবে মনোনীত করেন। তারা আদালতের বাইরে থেকে এই মামলায় বিচারকদের সাহায্য করেন। এমিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে আদালতে মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, ‘ফতোয়া নিষিদ্ধ করার অর্থ হলো কোরআন অচল করে দেয়া। এটি হতে পারে না । মুফতী কেফায়াতুল্লাহ বলেন, ‘ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে ইসলাম জানা সম্ভব হবে না । তাই ফতোয়া নিষিদ্ধ হতে পারে না।’ মাওলানা রুহুল আমীন বলেন, ‘এখন গ্রামাঞ্চলে যা চলছে সেটি ফতোয়া নয়। কারণ, কাউকে দোররা মারা, হাত কেটে দেয়া এগুলো ফতোয়ার মধ্যে পড়ে না। তিনি বলেন, ফতোয়া দিয়ে শাস্তি দেবার ক্ষমতা কেউ নিজের হাতে নিতে পারে না।’

সংক্ষিপ্ত এবং পূর্ণাঙ্গ রায়

দুই মাস ১২ দিন শুনানির পর ২০১১ সালের ১২ মে তৎকালীন বিচারপতি এ বি এম খাইরুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৬ বিচারকের বেঞ্চ ফতোয়া সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন।

ফতোয়ার রায়ের বেঞ্চে ছিলেন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী। এঁদের মধ্যে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মূল রায় লেখেন। তার সঙ্গে কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে পৃথক রায় দেন বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা। এই বেঞ্চের অন্য চার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

শুনানিতে আদালতের বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে টি এইচ খান, রফিকউল হক, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, মাহমুদুল ইসলাম, এম জহির, এ বি এম নুরুল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, তানিয়া আমীর এবং এস আই ফারুকীর বক্তব্য শোনেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া পাঁচজন আলেমের বক্তব্যও শোনেন আদালত। এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ওপর ভিত্তি করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নিম্নলিখিত রায় প্রদান করেন :

১. ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা শুধু ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে ফতোয়া দিতে পারবেন। এই ফতোয়া স্বেচ্ছায় গৃহীত হতে হবে। ফতোয়া মানতে কাউকে বাধ্য করা, জোর করা কিংবা অনুচিত প্রভাব প্রয়োগ করা যাবে না।
২. কোনো ব্যক্তির দেশে প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকার, সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুণ্ন বা প্রভাবিত করে, এমন ফতোয়া কেউ প্রদান করতে পারবে না।
৩. ফতোয়ার নামে কোনো প্রকার শাস্তি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না।
৪. তবে ঐ নির্দিষ্ট ফতোয়াটি (যা হাইকোর্ট অবৈধ বলেছেন) অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হলো।

এরপর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ফাতোয়া সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি।

‘একমাত্র সফল আন্দোলন’

এই ফতোয়া আন্দোলনকে বাংলাদেশের আলেমদের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সফল আন্দোলন বলা চলে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুফতী তৈয়্যব সাহেব বলেন, অবশ্যই বলা চলে। তবে এটা ছাড়াও আরও দুএকটা আন্দোলন আছে, যেখানে আমরা সফল হয়েছি। যেমন আগে আশকোনা হজক্যাম্প ছিল না। একেক বছর একেক জায়গায় হজক্যাম্প করা হতো অস্থায়ীভাবে। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলেও পড়তে হতো হাজিদের। হাজিদের দুর্ভোগ লাঘবে আমিনী রহ. স্থায়ী হজক্যাম্পের আবেদন করেছিলেন। কয়েকবছর আন্দোলনের পর আশকোনা হজক্যাম্প স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। কিন্তু ফতোয়া আন্দোলন ছিল সবচেয়ে বড় জয়। আদালত এখন ফতোয়া নিষেধ করেনি, বরং ফতোয়ার অপব্যবহার নিষেধ করেছে।

-ফাতেহ২৪

ফতোয়ার রাজনৈতিক লড়াই : ময়দানে রায়ের মোকাবেলা

জানুয়ারি ৩১, ২০২০

রাগিব রব্বানি:

২০০১ সালের পহেলা জানুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম রব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বেঞ্চ দেশে সবধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে আইন জারি করেন। ঘোষণায় বলা হয়, একমাত্র আদালতই অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইন সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতো পারবেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

হাইকোর্টের এই ঘোষণার পরপরই কিংবদন্তি ইসলামি রাজনীতিবিদ মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করেন। তাঁর প্রতিবাদের সূত্র ধরে দেশ জুড়ে গড়ে ওঠে দুর্বার আন্দোলন। আন্দোলন থামাতে মুফতী আমিনীসহ নেতৃস্থানীয় ওলামায়ে কেরামকে সরকার গ্রেপ্তার করে। আন্দোলন আরও প্রবল হয়ে ওঠে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশ ও বিডিআরের নির্বিচার গুলিতে শাহাদত বরণ করেন ছয়জন আন্দোলনকারী। এরই সূত্র ধরে দীর্ঘ ১০ বছর পর হাইকোর্টের এই রায়কে বাতিল ঘোষণা করে ফতোয়াকে বৈধতা দেওয়া হয়।

ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় এবং পরবর্তীতে তা বাতিল ঘোষণার মধ্যবর্তী সময়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে ওলামায়ে কেরামকে। ময়দানের এই লড়াইটা কেমন ছিল, কীভাবে গড়ে উঠেছিল দুর্বার সেই আন্দোলন, এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে কথা হয়েছিল ফতোয়া আন্দোলনের অন্যতম নেতা, ইসলামী ঐক্যজোটের বর্তমান মহাসচিব মুফতী ফয়জুল্লাহ’র সঙ্গে।

ফতোয়া নিষিদ্ধকারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া

ফতোয়া আন্দোলনের সূচনা কীভাবে এবং কখন হয়েছিল জানতে চাইলে মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, ২০০১ সালের পহেলা জানুয়ারি বিচারপতি গোলাম রব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বেঞ্চ ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় ঘোষণার পরপরই হজরত আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনী খবরটা জানতে পারেন। খবরটা জানামাত্রই একদিকে যেমন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, অপরদিকে পেরেশানও হন। আমরা যাঁরা তাঁর সহযোগী ছিলাম, আমাদেরকে তিনি নির্দেশ দিলেন ফতোয়া নিষিদ্ধকারীরা যে মুরতাদ, এই ব্যাপারে কিতাবাদি ঘেঁটে দলিলাদি যেন দ্রুত বের করি। আমরা হুজুরের নির্দেশ পালনে কিতাবাদি নিয়ে বসে যাই, আর হুজুর দেশের সমকালীন শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ শুরু করেন। প্রত্যেকের কাছে এই রায়ের ভয়াবহতা তুলে ধরে এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ চান। রায়দাতা দুই বিচারপতির মুরতাদ হয়ে যাওয়া মর্মে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার সম্মতিক্রমে একটি ফতোয়া প্রকাশের প্রস্তাবও পেশ করেন তিনি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য অধিকাংশের কাছ থেকে তিনি আশাব্যঞ্জক সাড়া পাচ্ছিলেন না। প্রত্যেকেই বলছিলেন, আদালতের বিরুদ্ধে এভাবে ফতোয়া প্রকাশ স্পর্শকাতর বিষয়। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু আমিনী রহ. নিজের কথায় অনড়। তিনি ফতোয়া জারি করবেনই। ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে কার্যত ওলামায়ে কেরামের মতামত প্রদানের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসবে, ইসলামপ্রশ্নে দেখা দেবে নানা সমস্যা, তাই এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যা-ই হোক, কোনো পরোয়া করতে রাজি হননি মুফতী আমিনী রহ.।

মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, রায় প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুফতী আমিনী রহ. দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন মুফতী এবং ইসলামী রাজনীতিবিদ হিসেবে ফতোয়া নিষিদ্ধকারী দুই বিচারপতিকে মুরতাদ ঘোষণা করে ফতোয়া জারি করেন। ফতোয়ার সরমর্ম ছিল এরকম—ফতোয়াকে যারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তারা আর মুসলিম থাকে না, মুরতাদ হয়ে যায়। ইসলামি আইন অনুযায়ী মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। হাইকোর্টের দুই বিচারপতি গোলাম রব্বানি এবং নাজমুন আরা সুলতানা ফতোয়াকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে মুরতাদ হয়ে গেছেন।

ফতোয়ার সঙ্গে এই দাবিও জানানো হয় যে, মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রেখে আইন পাশ করতে হবে এবং দুই বিচারপতিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিল করতে হবে।

ময়দানে রায়ের মোকাবেলা

মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, মুফতী আমিনী রহ. সাহস করে যখন এই ফতোয়া প্রকাশ করেন, দেশজুড়ে হইচই পড়ে যায়। তথাকথিত সুশীল ঘরানা উঠে পড়ে লাগে মুফতী আমিনী রহ.-এর পেছনে। কিন্তু তিনি নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন। আর ওলামায়ে কেরামও হুজুরের এ সাহসিকতা দেখে তাঁকে সমর্থন করেন। ফলে জানুয়ারি মাসেই দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম একত্রিত হন এবং ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিলের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। বৈঠকে খতিব আল্লামা উবায়দুল হক রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ., চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব ফজলুল করীম রহ.-সহ শীর্ষস্থানীয় সকলেই উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকেই ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়।

মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যাত্রা শুরু হয়। এবং পরবর্তী আন্দোলন এই ব্যানারেই পরিচালিত হয়। জনসমাবেশ থেকে ৩/৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল কর্মসূচি ঘোষিত হয়। আন্দোলনের এই স্পিরিট নষ্ট করতে ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমে মুফতী আমিনী রহ.-কে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর একে একে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, আল্লামা আবদুল লতিফ নেজামী, মুফতী ইজহারুল ইসলাম, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীবসহ নেতৃস্থানীয় অনেক আলেমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মুফতী ফয়জুল্লাহ জানান, এসব আলেমকে গ্রেপ্তারের পর আন্দোলনের নেতৃত্বের জায়গায় একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তবে সেটা তাৎক্ষণিকভাবেই পূরণ হয়ে যায় খতিব আল্লামা উবায়দুল হক রহ., আল্লামা মুহিউদ্দীন খান রহ., মুফতী ওয়াক্কাসসহ আমরা যাঁরা বাইরে ছিলাম তাঁদের তৎপরতার কারণে।

এদিকে নেতৃস্থানীয় আলেমদের গ্রেপ্তারের কারণে সারা দেশেই প্রতিবাদ হচ্ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেহেতু মুফতী আমিনী রহ.-এর এলাকা, প্রতিবাদটা সেখানেই বেশি হচ্ছিল। ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হরতাল কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশ ও বিডিআরের গুলিতে শাহাদত বরণ করেন ছয়জন আন্দোলনকারী। তারপর আন্দোলন আরও দুর্বার হয়ে ওঠে।

মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ তখন ফুরিয়ে এসেছিল। তারা দায়িত্ব ছাড়ার আগে আগেই মুফতী আমিনী ও শায়খুল হাদীস রহ. জামিনে মুক্তি পান। তারপর নির্বাচনের ডামাডোল। পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয় শহিদের বিচার, ক্ষতিপূরণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই ছয় শহিদের স্মরণে শহিদি মসজিদ নির্মাণ এবং ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শহিদ পরিবারগুলোকে একটি করে বাড়ি প্রদান করা ছাড়া তারা আর কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেনি। মুফতী আমিনী রহ.-সহ জোটভুক্ত দলের ওলামায়ে কেরামের বারংবার চেষ্টা ও অনুরোধের পরও ওই সরকার এসব দাবি বাস্তবায়ন করেনি। অবশেষে ২০১১ সালে দীর্ঘ দশ বছর পর ওলামায়ে কেরামের প্রচেষ্টায় এই রায় বাতিল করে আদালত ফতোয়া বৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করে।


-ফাতেহ২৪

ফতোয়া আন্দোলনে সুশীল, মিডিয়া ও এনজিওদের ভূমিকা


রাকিবুল হাসান:

ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের প্রতিবাদে আলেম এবং মাদরাসাছাত্রসহ সর্বস্তরের তৌহিদি জনতা যখন আন্দোলনে নেমে আসে, তাদের থামিয়ে দেবার জন্য শয়তানের অনকগুলো মাথা গজিয়ে ওঠে। এই জাগরণকে দুর্বল করে দেবার জন্য উঠেপড়ে লাগে শয়তানের মাথাগুলো। এদের মধ্যে অন্যতম হলো সুশীল শ্রেণি, মিডিয়া এবং এনজিও কিংবা মানবাধিকার সংস্থা। সবাই মিলে চেষ্টা করেছে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের পক্ষে একটা শিবির গড়ে তুলতে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা ধোপে টেকেনি।

মিডিয়ার দৌড়ঝাঁপ

ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের সঙ্গে এক আলাপে বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ফতোয়া আন্দোলনে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে বলেন, ‘ফতোয়া নিষিদ্ধের ক্ষেত্রটাই তৈরি করেছে মিডিয়া। প্রায় এক দশক ধরে তারা বিভিন্নভাবে ফতোয়াকে হেয় করেছে। ব্যভিচার, প্রেম, বিয়ে নিয়ে বিভিন্ন গ্রাম্য সালিশকে ফতোয়া আখ্যা দিয়ে তারা ফলাও করে নিউজ করেছে, স্টোরি করেছে। ‘ফতোয়াবাজ’ শিরোনামে একটি সংখ্যা-ও করেছিল বিচিত্রা ম্যাগাজিন। এভাবে তারা ফতোয়াকে নারী নির্যাতনের একটি হাতিয়ার হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে। আর ফতোয়াকে কলঙ্কিত করার এই প্রচেষ্টারই আইনি প্রতিধ্বনি ছিল ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়।’

মুফতি তৈয়ব সাহেব বলেন, ‘মিডিয়া বরাবরের মতোই সুশীল এবং এনজিওদের পক্ষ নিয়েছে। ফতোয়াবিরোধী নিউজ, নিবন্ধ, ফলোআপ প্রচার করেছে। তবে ফতোয়ার পক্ষে সবচে সরব ছিল মানবজমিন। তারা আলেমদের মতামত, সাক্ষাৎকার, নিবন্ধ ছেপেছে। নিউজ কাভারেজ এবং ফলোআপ করেছে। কাটতির জন্য হোক কিংবা অন্যকিছুর জন্য, তবুও আমাদের মতামত তুলে ধরেছে। এরপরে ইনকিলাবও আমাদের পক্ষে কথা বলেছে। ২০০১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছয়জন ছাত্র শহীদ হলে, ধারাবাহিকভাবে তাদের স্টোরি ছাপায় ইনকিলাব। ছয়দিনে ছয়জনের স্টোরি। পরে এগুলো সম্পাদনা করে একটা বইও করেছিলাম আমি।’

সুশীলদের ভূমিকা

সুশীলরা বরাবরই ছিল ফতোয়া নিষিদ্ধের পক্ষে। ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিলে আপিল শুনানির সময় তারা খুব চেষ্টা করেছে নিষিদ্ধের পক্ষে যুক্তি-তর্ক দাঁড় করাতে। তৎকালীন পত্র-পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতাগুলোতে সুশীলদের কলাম দেখলেই বিষয়টি টের পাওয়া যায়।

২০১০ সালের পয়লা জুন প্রথম আলোর এক নিবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমানের বক্তব্য কোট করা হয়। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘কতগুলো ভুল ধারণার ভিত্তিতে আপিল করা হয়েছে। মুসলিম শরিয়া আইন আমাদের আইনি ব্যবস্থার অংশ নয়। শরিয়া আইনের যুক্তির ওপর ভিত্তি করে তারা আরও যেসব যুক্তি দিয়েছে, সেগুলোও একই কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের আইনি কাঠামোতে কোনো আইনি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচার প্রশাসন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। অন্য কেউ এখানে আইনি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। এদিক থেকেও ফতোয়া দেওয়া আইন ও সংবিধানবিরোধী।’

তারপর মিজানুর রহমান ফতোয়ার ওপর আস্ত একটা অপবাদই চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফতোয়াগুলো একপেশে ও নারীবিরোধী হয়ে থাকে। অথচ আমাদের সংবিধানে বলা আছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আইনে কোনো বৈষম্য করা যাবে না।’

২০১৫ সালের ১১ মার্চ প্রথম আলোতে নিজের লেখা এক প্রবন্ধে মিজানুর রহমান খান আইনজীবী মাহমুদুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে লিখেছিলেন, ‘আজকের দিনে মুফতি বলে কিছু নেই। তাই ফতোয়াদানেরও কোনো প্রশ্ন নেই।’ পাশাপাশি তিনি সংবিধানের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ফতোয়া দেয়া যাবে না মর্মে কিছু প্রবন্ধ পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করারও আহ্বান জানান।’

ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি তৈয়ব বলেন, এই সুশীলদের ভয়েই বিএনপি আমাদের আপিলের ফাইল খুলতে দেয়নি। বরং আলেমদেরকে আপিল ফিরিয়ে নিতে চাপ দিয়েছে।

এনজিওদের লম্ফঝম্ফ

ফতোয়া আন্দোলনের শুরু থেকেই এনজিও এবং তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাগুলো ফতোয়াবিরোধী জনমত দেখানোর চেষ্টা করেছে। আলেমদের মতো তারাও মাঠে এসে হুংকার ছাড়তে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। মুফতি তৈয়ব বলেন, ‘২০০১ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে আমরা যেদিন ঢাকায় হরতাল পালন করি, ফতোয়াবিরোধী এক মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিল এনজিওজোট কিন্তু আমাদের হরতাল এত  কঠিন ছিল, তাদের সমাবেশে তেমন কেউ আসতেই পারেনি। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা সমাবেশ করেছে। কিন্তু আলেমদের আন্দোলনের প্রভাবে তাদের সমাবেশ কোনো উত্তাপ ছড়াতে পারেনি।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসময় আওয়াজ তুলে—বাংলাদেশে ফতোয়ার মাধ্যমে অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। তারা উদাহরণ হিসেবে কিছু গ্রাম্য সালিশ তুলে ধরে। যেগুলো মূলত কোনো ফতোয়াই ছিল না। এমনকি আপিলে ফতোয়া নিষিদ্ধের পক্ষে উকালতি করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসকের আইনজীবী ওবায়েদুর রহমান শুনানি শুরুর আগে ২০১০ সালের পয়লা জুন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ফতোয়ার ফলে মানবাধিকার ও আইন কীভাবে লঙ্ঘিত হয় এবং এর ফলে নারীরা যে নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে, তা শুনানিতে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

এনজিও ও মানবাধিকার কর্মীরা আসলে ফতোয়াকে নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছে। নারীর নিরাপত্তার জন্য ফতোয়াকে হুমকি হিসেবে উল্লেখ করতে চেয়েছে।

-ফাতেহ২৪

ফতোয়ার ছয় শহিদ : যাঁদের রক্তে অর্জিত হয়েছে ফতোয়ার হক

জানুয়ারি ৩১, ২০২০

রাগিব রব্বানি:

সেদিন ছিল ২০০১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। হাইকোর্টের ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিলের দাবিতে পল্টন ময়দানে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বানে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. সমাবেশে যোগদানের জন্য লালবাগে তাঁর নিজস্ব কার্যালয় থেকে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পল্টনের সমাবেশে তাঁর আর যোগ দেওয়া হয়নি। এই দিনই শায়খুল হাদিস আজিজুল হক রহ.-এর প্রোগ্রাম ছিল দিনাজপুরে। রাতের বেলা প্রোগ্রাম শেষে ঢাকা ফেরার পথে গাজিপুর থেকে তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়-বিরোধী আন্দোলনের মূল কাণ্ডারি ছিলেন এ দুজন। আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সরকার ভেবেছিল আন্দোলনের এই দুই প্রাণপুরুষকে গ্রেপ্তার করলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু ফল দাঁড়াল ঠিক এর বিপরীতটা। জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দিলে যেমন হয়, পুরো বাংলাদেশ সেভাবে গর্জে উঠল তাঁদের গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে। ৩-৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। চলতে থাকে সরকারের দমন-পীড়নও।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড়হুজুর ও জামিয়া ইউনুছিয়ার তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা সিরাজুল ইসলাম রহ. ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারির হরতালের পর ঘোষণা দেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক এবং মুফতী আমিনীকে মুক্তি না দিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাগাতার আন্দোলন চলবে। ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি হরতালের ঘোষণা দেন। ৫ ফেব্রুয়ারিও মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর।

৬ ফেব্রুয়ারি ভোর হবার আগে আগেই পুরো শহরে বিডিআর ও পুলিশের বিশেষ ফোর্স মোতায়েন করা হয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এবং ৬ ফেব্রুয়ারির ৬ শহিদের শাহাদতের প্রত্যক্ষদর্শী মুফতী এনামুল হাসানের সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। তিনি সেদিনকার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ফজরের আগে আগেই বিডিআর ও পুলিশের বিশেষ ফোর্সের উপস্থিতিতে পুরো শহর ছেয়ে যায়। জামিয়া ইউনুছিয়া থেকে নামাজের আগে আগেই অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। ফজরের নামাজের পর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবকয়টি মাদরাসার ছাত্র-উসতাদ এবং শহরের ধর্মপ্রাণ তৌহিদি জনতা হরতাল কর্মসূচি পালনের জন্য রাস্তায় নেমে আসেন।

মুফতী এনাম বলেন, ফজরের পর জামিয়া ইউনুছিয়া থেকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সহকারে আমরা শহরের প্রাণকেন্দ্র টিএ রোড হয়ে কালিবাড়ির দিকে যাই। কালিবাড়ি পৌঁছুতেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের বাধা দেয়। আমরা পুনরায় ফিরে আসি টি এ রোডে। এবং এখানেই অবস্থান করে হরতাল কর্মসূচি পালন করতে থাকি।

যেভাবে ঝরে পড়ে ছয়টি তাজাপ্রাণ

মুফতী এনাম বলেন, ধীরে ধীরে বেলা বাড়তে থাকে। পুলিশ এবং বিডিআর সদস্যরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আমাদের ঘিরে রাখে। আমাদের নানাভাবে বাধা দিতে থাকে, ফলে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও বিডিআর যাকে পারছে, গ্রেপ্তার করছে।

এদিকে সেসময়কার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর মাদরাসার বর্তমান শিক্ষক মাওলানা বোরহানুদ্দীন জানান, বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এবং বিডিআর সদস্যরা আন্দোলনরত জনতার অবস্থানকে ক্রমশ সংকুচিত করে আনছিল। বেলা ১০টার দিকে তারা একটা লাল ব্যানার টাঙিয়ে ঘোষণা করে আন্দোলনকারীরা এই ব্যানার অতিক্রম করে যেতে পারবে না। উত্তেজিত জনতা তখন ব্যানার অতিক্রম করে আর তখনই শুরু হয় পুলিশ ও বিডিআরের নির্বিচার গুলি বর্ষণ।

মুফতী এনামুল হাসান বলেন, সারা শহরেই তারা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি বর্ষণ ও নির্যাতন শুরু করে। আন্দোলনে মাদরাসাছাত্র ছাড়াও সর্বস্তরের তৌহিদি জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। অসংখ্য মানুষ আহত হচ্ছিলেন। দুপুর পর্যন্ত এই তাণ্ডব চালিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় প্রশাসন। ততক্ষণে ছয়টি তাজাপ্রাণ ঝরে পড়েছে। প্রশাসনের নৃশংসতার শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন জামিয়া ইউনুছিয়ার ছাত্র হাফেজ তাজুল ইসলাম ও হাফেজ সাইফুল ইসলাম। সাধারণ তৌহিদি জনতার মধ্য থেকে প্রাণ দিয়েছেন শহিত মুখলিসুর রহমান, শহিদ সুজন, শহিদ আলাউদ্দিন ও শহিদ উসমান। এ চারজনই ছিলেন সাধারণ মানুষ। ধর্মীয় অনুভূতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা এ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।

মাওলানা বোরহানুদ্দিন ও মুফতী এনাম জানান, প্রশাসনের এ নৃশংসতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৌহিদি জনতা থেমে থাকেনি, শহীদদের রক্ত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরদিন থেকে আবারও আরও জোরদার আন্দোলনে নামেন তাঁরা।

কেমন আছে ৬ শহিদের পরিবার?

মাওলানা বোরহানুদ্দীনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ৬ শহিদের পরিবারগুলো সম্পর্কে। তিনি জানান, ফতোয়া আন্দোলনের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে এবং মুফতী আমিনী রহ. তখন এমপি হন। তিনি ছয় শহিদের প্রত্যেকের পরিবারকে সরকারিভাবে একটি করে বাড়ির ব্যবস্থা করে দেন।

শহরের পনিয়াউট এলাকায় ৩২ শতাংশ জায়গার ওপর টিনশেড ঘর নির্মাণ করে ছয় পরিবারের প্রত্যেকের জন্য তিন রুমের বাসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শহিদ মুখলেস ছিলেন বিবাহিত। তাঁর শাহাদতের পর তাঁর স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় এবং তাঁর বাবাও মারা যান। ফলে তাঁর নামে বরাদ্দ বাসা ভাড়া দিয়ে ভাড়ার টাকা নিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী। শহিদ সুজন অবিবাহিত, তাঁর বাবাও মারা গেছেন। বর্তমানে তাঁর মা বাসাটি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। আর বাকি চার শহিদের পরিবার তাঁদের নামে বরাদ্দ বাসাগুলোতেই অবস্থান করছেন।

শহিদদের রক্তের বিচার হয়েছে?

ফতোয়া আন্দোলনে শাহাদতবরণকারী এই ছয় শহিদের রক্তের বিচার কি হয়েছে? জানতে চেয়ে কথা বলেছিলাম ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও ফতোয়া আন্দোলনের অন্যতম নেতা মুফতী মুহাম্মদ তৈয়বের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ফতোয়া আন্দোলনের সেই সময়টা ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্ত। নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট তখন আওয়ামী লীগের ইসলাম-বিরোধিতা ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের কারণে তৈরি ধর্মপ্রাণ মানুষের সিম্প্যাথিকে কাজে লাগিয়ে বিজয়ী হয়েছিল। নির্বাচনে তারা ওয়াদা দিয়েছিল ফতোয়া-বিরোধী রায় বাতিল করার পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয় শহিদের বিচার ও তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে একটি করে বাড়ি তৈরি করে দেবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মুফতী আমিনী রহ.-এর প্রচেষ্টায় ছয় শহিদের পরিবারকে একটি করে বাড়ি দিলেও তাদের পাঁচ বছরের শাসনামলে শহিদের বিচার তো দূরের কথা, ফতোয়া-বিরোধী রায়টা পর্যন্ত বাতিল করেনি বিএনপি-জামায়াত প্রভাবিত জোট।

মুফতী তৈয়ব জানান, মুফতী আমিনী ও শায়খুল হাদীস রহ. বারবার অনুরোধ এবং নিজেদের সর্বাত্মক চেষ্টা দিয়ে সরকারকে বলেছেন এইসব বিষয়ে, কিন্তু বিএনপি তাঁদের কথা কানেই তুলতে রাজি হয়নি। মুফতি আমিনী রহ. তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আলেমদের সঙ্গে বিএনপির এই গাদ্দারি খুব শিগগির তাদের দীর্ঘ পতন ডেকে আনবে।

মুফতী তৈয়ব বলেন, আজ হয়েছেও তাই। বিএনপির বর্তমান যে দুর্দশা, অদূর ভবিষ্যতে আর কখনও তারা ক্ষমতায় আসতে পারবে কি-না, সন্দেহ। তবে ছয় শহিদের রক্ত বৃথা যায়নি। তাঁদের শাহাদাতের হয়তো বিচার হয়নি, কিন্তু যে আওয়ামী লীগ ফতোয়া-নিষিদ্ধের রায় দিয়েছিল, সে আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করেছে।

একদিন হয়তো এভাবেই ছয় শহিদের রক্তের বিচার হবে এই মাটিতে। বিচার হবে ইসলামি আন্দোলন-সংগ্রামে বিগত দিনে আরও যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, পান করেছেন শাহাদতের অমীয় সুধা, তাঁদের তপ্ত খুনের। এমনটাই আশা ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতী মুহাম্মদ তৈয়বের।


-ফাতেহ২৪

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...