মুনশী নাঈম:
২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাবাজার পত্রিকায় নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নের আতিথা গ্রামে এক গৃহবধূকে ফতোয়া দিয়ে হিল্লা বিয়ে করতে বাধ্য করার বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার আদালত কেন ফতোয়া প্রদানকারী হাজি আজিজুল হকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না—এ বিষয়ে নওগাঁর জেলা প্রশাসক, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি এক স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমেটো) রুল জারি করেন। পরে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি দুই বিচারপতি ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে বলেন, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইনসংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
ইসলাম ও শরিয়াহর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক এ রায়ে চমকে ওঠেন এ দেশের ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী এবং উলামায়ে কেরাম। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। ঠিক সে সময় আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. হাইকোর্টের রায়দাতা দুই বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও নাজমুন আরা সুলতানাকে মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে ফতোয়া প্রকাশ করেন। এবং হাইকোর্টের ফতোয়া-নিষিদ্ধের রায়ের বিরুদ্ধে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে দুর্বার আন্দোলনের ডাক দেন। পুরো দেশ তখন আমিনী রহ.-এর এই সাহসী আহ্বানে সাড়া দিয়ে গর্জে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে হকপন্থী সমস্ত উলামায়ে কেরাম তাঁকে সমর্থন জানান।
৪ ফেব্রুয়ারি দিনের বেলা মুফতি আমিনী রহ.-কে লালবাগ থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপর এই দিনই রাতের বেলা দিনাজপুরের একটি জনসভা থেকে ফেরার পথে গাজিপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, আবদুল লতিফ নিজামি, মুফতি ইজহার , জুনায়েদ আল হাবীবসহ আরও অনেক নের্তৃবৃন্দকে।
এরপরই মূলত হাইকোর্টের ফতোয়া-নিষিদ্ধের রায়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু হয়। এসময় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে পাঁচটি আবেদন করা হয়। এর মধ্যে ২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি তৈয়বের পক্ষে মুজিবুর রহমান এবং কিছুদিন পর আবুল কালাম আজাদের পক্ষে আবদুর রাজ্জাকের আপিল দুটি গ্রহণ করা হয়। সেই আইনি লড়াইয়ের প্রক্রিয়া জানতে চেয়ে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের পক্ষ থেকে আমরা কথা বলেছি ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতী মুহাম্মদ তৈয়বের সঙ্গে।
যেভাবে আইনি লড়াই শুরু
আইনি লড়াইয়ের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল জানতে চাইলে মুফতী তৈয়ব বলেন, দেশজুড়ে তখন আন্দোলন চলছে। কিন্তু মুফতী আমিনী, শায়খুল হাদীসের মতো বড় বড় নেতা ময়দানে নেই। তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দেয়া হয়েছে। জেল থেকেই মুফতী আমিনী মাওলানা মুহিউদ্দিন খান সাহেবকে খবর পাঠালেন, ‘হাইকোর্টে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের মোকাবেলায় একটা আপিল করে রাখেন।’ যেহেতু ফতোয়া নিয়ে মামলা, খান সাহেব চাইছিলেন বড় কোনো মুফতি আপিলটা করুক। কিন্তু বড় বড় মুফতিদের তখন অনুরোধ করার পরও আপিল করতে কেউ রাজি হননি। কারণ সবাই ভয় পাচ্ছিলেন, এখানে মুফতী আমিনী জড়িত থাকার কারণে রাজনৈতিকভাবে হয়তো তাঁরা ফেঁসে যেতে পারেন। সবাই যখন নিরাপদ দূরত্বে নিজেকে সরিয়ে নিলেন, একদিন খান সাহেব আমাকে বললেন, তুমি ইফতা পড়োনি? আমি বললাম, আমি দু বছর আগে লালবাগে মুফতী আমিনী সাহেবের কাছেই ইফতা পড়েছি। খান সাহেব বললেন, তুমিই আপিল করো।
কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। আমার তো ইফতার সার্টিফিকেট নেই। আপিল করতে গেলে তো মুফতির সার্টিফিকেট দাখিল করতে হবে বিষয়টাকে অথেনটিক করার জন্য। তখনো লালবাগে ইফতা বিভাগে সার্টিফিকেট দেয়া শুরু হয়নি। কারও কোথাও দরকার হলে হাতে লিখে সত্যায়ন দেয়া হতো। মুফতী আমিনী সাহেবের সঙ্গে জেলে দেখা করে বললাম, খান সাহেব আমাকে আপিল করতে বলছেন। কিন্তু আমার তো মুফতির সার্টিফিকেট নেই। হুজুর তখন লালবাগ মাদরাসায় খবর পাঠালেন, ইফতা বিভাগের সার্টিফিকেট তৈরি করা হোক। দুদিনের মধ্যে খুব জলদি করে তৈরি করা হলো সার্টিফিকেট। এরপর লালবাগ মাদরাসার প্রথম সার্টিফিকেট তুলে দেয়া হয় আমার হাতে।
২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আমরা হাইকোর্টে আপিল করি। আমাদের উকিল ছিলেন হাইকোর্টের প্রভাবশালী প্রবীণ অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান। শুধু আপিলটুকুই করেছিলাম, শুনানির তারিখ-টারিখ কিছু পড়েনি। আপিলে বলা হয়,…এই ঘটনায় সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করা অযৌক্তিক। এটি ইসলামের বিধান ও বাংলাদেশের সংবিধানের ২ (ক), ৮(১), (১ক) ও ৪১ (১) অনুচ্ছেদের বিরোধী। এই রায় কুরআন-সুন্নাহর বিধানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে। কুরআনের বিধানের বিষয়ে হাইকোর্টের রায় দেয়ার অধিকার নেই।
এরপর আমার দেখাদেখি আপিল করেন জামায়াতে ইসলামীর আবুল কালাম আজাদ। তাঁর উকিল ছিলেন আবদুর রাজ্জাক।
জোট সরকারের আমলে
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়। ক্ষমতায় আসে চারদলীয় জোট সরকার বিএনপি। মুফতী তৈয়বের কাছে প্রশ্ন রেখে বললাম, বিভিন্ন পত্রিকা লিখেছে, জোট সরকারের আমলে আপিল কোর্টে তোলার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। মুফতী তৈয়ব উত্তরে বলেন, পত্রিকাগুলো প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে। আমরা কয়েকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সরকার তা কোর্টে তুলতে দেয়নি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সঙ্গে মুফতী আমিনী এবং শায়খুল হাদীস সাহেব বারবার কথা বলেছেন, অনুরোধ করেছেন আপিলের শুনানির তারিখ দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি কথা কানেই তুলেননি বরং উল্টো আপিল তুলে নিতে চাপ দিয়েছিলেন। কারণ, বিএনপি ভাবছিল, হাইকোর্টে এখন যদি আবার ফতোয়ার মামলাটি তোলা হয়, ফতোয়ার পক্ষে রায় এলে সুশীল সমাজ ক্ষেপে উঠবে। বিপক্ষে রায় গেলে ক্ষেপে উঠবে তৌহিদি জনতা। তখন বিপদে পড়বে সরকার। তাই তারা আপিলের ফাইলটি একরকম ক্লোজড করে দিয়েছিল। মুফতি আমিনী রহ. তখন বলেছিলেন, আলেমদের সঙ্গে এই গাদ্দারি বিএনপির দীর্ঘ পতন ডেকে আনবে।
সরকার থেকেই যেহেতু আপিলের ফাইলটি খুলতে দেয়া হয়নি, তাই আদালতেও আমরা যেতে পারিনি। ফলত সবার মনে হয়েছে আমরা কোনো চেষ্টা করিনি।
চূড়ান্ত শুনানি
কখন আবার আপিলের ফাইলটি ওপেন হলো, জানতে চাইলাম। উত্তরে মুফতি তৈয়্যব বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে, ২০১১ সালের মার্চে আপিলের ফাইলটি ওপেন হয়। ২০০১ সালে যখন আপিল করি তখনই আমাদের আইনজীবী মুজিবুর রহমান বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন। তারপর কেটে গেছে নয় বছর। তিনি আরও দুর্বল হয়ে পড়লেন। তাই আমরা অ্যাডভোকেট মাওলানা নজরুল ইসলামকে উকিল হিসেবে নিয়োগ দিই। আমাদের এবং জামায়াতে ইসলামীর আপিল, দুটোর শুনানি একসঙ্গে হয়।
শুনাননি চলাকালীন আদালত ১০ অ্যাডভোকেট এবং পাঁচজন আলেমকে এমিকাস কিউরি হিসেবে মনোনীত করেন। তারা আদালতের বাইরে থেকে এই মামলায় বিচারকদের সাহায্য করেন। এমিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে আদালতে মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, ‘ফতোয়া নিষিদ্ধ করার অর্থ হলো কোরআন অচল করে দেয়া। এটি হতে পারে না । মুফতী কেফায়াতুল্লাহ বলেন, ‘ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে ইসলাম জানা সম্ভব হবে না । তাই ফতোয়া নিষিদ্ধ হতে পারে না।’ মাওলানা রুহুল আমীন বলেন, ‘এখন গ্রামাঞ্চলে যা চলছে সেটি ফতোয়া নয়। কারণ, কাউকে দোররা মারা, হাত কেটে দেয়া এগুলো ফতোয়ার মধ্যে পড়ে না। তিনি বলেন, ফতোয়া দিয়ে শাস্তি দেবার ক্ষমতা কেউ নিজের হাতে নিতে পারে না।’
সংক্ষিপ্ত এবং পূর্ণাঙ্গ রায়
দুই মাস ১২ দিন শুনানির পর ২০১১ সালের ১২ মে তৎকালীন বিচারপতি এ বি এম খাইরুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৬ বিচারকের বেঞ্চ ফতোয়া সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন।
ফতোয়ার রায়ের বেঞ্চে ছিলেন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী। এঁদের মধ্যে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মূল রায় লেখেন। তার সঙ্গে কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে পৃথক রায় দেন বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা। এই বেঞ্চের অন্য চার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
শুনানিতে আদালতের বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে টি এইচ খান, রফিকউল হক, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, মাহমুদুল ইসলাম, এম জহির, এ বি এম নুরুল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, তানিয়া আমীর এবং এস আই ফারুকীর বক্তব্য শোনেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া পাঁচজন আলেমের বক্তব্যও শোনেন আদালত। এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ওপর ভিত্তি করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নিম্নলিখিত রায় প্রদান করেন :
১. ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা শুধু ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে ফতোয়া দিতে পারবেন। এই ফতোয়া স্বেচ্ছায় গৃহীত হতে হবে। ফতোয়া মানতে কাউকে বাধ্য করা, জোর করা কিংবা অনুচিত প্রভাব প্রয়োগ করা যাবে না।
২. কোনো ব্যক্তির দেশে প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকার, সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুণ্ন বা প্রভাবিত করে, এমন ফতোয়া কেউ প্রদান করতে পারবে না।
৩. ফতোয়ার নামে কোনো প্রকার শাস্তি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না।
৪. তবে ঐ নির্দিষ্ট ফতোয়াটি (যা হাইকোর্ট অবৈধ বলেছেন) অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হলো।
এরপর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ফাতোয়া সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি।
‘একমাত্র সফল আন্দোলন’
এই ফতোয়া আন্দোলনকে বাংলাদেশের আলেমদের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সফল আন্দোলন বলা চলে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুফতী তৈয়্যব সাহেব বলেন, অবশ্যই বলা চলে। তবে এটা ছাড়াও আরও দুএকটা আন্দোলন আছে, যেখানে আমরা সফল হয়েছি। যেমন আগে আশকোনা হজক্যাম্প ছিল না। একেক বছর একেক জায়গায় হজক্যাম্প করা হতো অস্থায়ীভাবে। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলেও পড়তে হতো হাজিদের। হাজিদের দুর্ভোগ লাঘবে আমিনী রহ. স্থায়ী হজক্যাম্পের আবেদন করেছিলেন। কয়েকবছর আন্দোলনের পর আশকোনা হজক্যাম্প স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। কিন্তু ফতোয়া আন্দোলন ছিল সবচেয়ে বড় জয়। আদালত এখন ফতোয়া নিষেধ করেনি, বরং ফতোয়ার অপব্যবহার নিষেধ করেছে।
No comments:
Post a Comment