ইমরান আব্দুল্লাহ:
একটি গ্রাম্য সালিশকে ফতোয়া আখ্যা দিয়ে ২০০১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি সব ধরনের ফতোয়াকেই নিষিদ্ধ বলে রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি গোলাম রব্বানির নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ। হাইকোর্টের এ বিচারপতির পক্ষ থেকে এটাই একমাত্র আঘাত ছিল না, বরং হাইকোর্টে থাকাকালীন তিনি আরও একাধিক মামলায় কুরআন-বিরোধী রায় দিয়েছেন। এমন একটি মামলা ছিল তালাক-পরবর্তী খরপোষ বিষয়ে। রায়টি আপিল বিভাগে বাতিল হয়ে যায়। ঠিক তেমনি ২০১১ সালে এসে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়টিও আপিল বিভাগে বাতিল হয়ে যায়।
কিন্তু এত সহজেই বাতিল হয়নি রায়টি। এজন্য ময়দানে যেমন আন্দোলন করতে হয়েছে, তেমনি কোর্টে লড়তে হয়েছে, দৃশ্যপটের আড়ালে লড়াই করতে হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও। বরং বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটাই সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। এ লড়াইটা না করলে আঁধারে তির ছোঁড়ার মতোই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেত আপিলের চেষ্টা। বু্দ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের গল্পটা এখানে একটু বলি।
বই লেখা
ফতোয়ার যে সংজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে বিচারক গোলাম রব্বানি ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় দিয়েছিলেন, সে সংজ্ঞাই ছিল ভুল। তিনি বলেছেন, ‘ফতোয়া’= হচ্ছে আইনগত কর্তৃপক্ষের আইনানুগ মতামত।’ অথচ শরিয়তে ফতোয়ার সাথে আইনগত কর্তৃপক্ষ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই এবং এটি কোনো বিচারিক রায়ও নয়। এক্ষেত্রে রব্বানি সাহেব জেনে বা না জেনে ফতোয়ার ভুল সংজ্ঞার আশ্রয় নিয়েছেন সকল ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করার জন্য। অন্যথায় ইসলামি বিচারব্যবস্থায় এ ধরনের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো প্রয়োজন হয় না; কেননা ‘হিদায়াহ’সহ ফিকহের বিশাল গ্রন্থগুলোর ‘আদাবুল কাযী’ অধ্যায়ে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো বিচারক শরিয়াহ পরিপন্থী কোনো রায় দিলে তা আপনাআপনিই বাতিল বলে বিবেচিত হবে।
ফতোয়া নিয়ে যেহেতু বিচারকদের মাঝেই জ্ঞানের কমতি আছে, এই কমতি দূর না করলে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেও লাভ হবে না। তাই আপিলের শুনানি শুরু হলে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি তৈয়ব সাহেবের উকিল মুজিবুর রহমান বললেন, ‘আপনারা ফতোয়া নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটি বই লিখে দেন। বইটি আমরা বিচারকদের হাতে দিই; যেন তারা বিষয়টা বুঝতে পারেন। তাদের সামনে যেন ফতোয়ার ধারণাটা স্পষ্ট হয়।’
ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের কাছে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুফতি তৈয়ব বলেন, লালবাগে মিটিং হলো বইটি কে লিখবে। একজন বড় মুফতিকে দায়িত্ব দেয়া হলো। কিন্তু দুদিন পর আরেক মিটিংয়ে তিনি জানালেন, বইটি এত কম সময়ে তিনি লিখতে পারবেন না। এদিকে শুনানি চলছে, হাতে সময়-ও নেই। উপায় না দেখে মুফতী আমিনী রহ. আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ.-কে বললেন, আপনি লিখে দেন। আবুল ফাতাহ সাহেব বললেন, আমি তো মুফতি না। আমিনী সাহেব ভরসা দিয়ে বললেন, কাজ করতে মুফতি হওয়া লাগে না। আপনি কাজ করুন, আমরা সাহায্য করব।
মুফতী তৈয়ব বলেন, আবুল ফাতাহ সাহেব মাত্র তিনদিনে ‘ফতওয়া ফিকহ হাদীস’ শিরোনামে বইটি লিখে শেষ করেন। বইয়ের কপি বিচারকদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এই বইটির মাধ্যমে তাঁরা ফতোয়া ফিকহ এবং হাদীস সম্পর্কে সুস্পষ্ট একটা ধারণা লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৬০ পৃষ্ঠার বইটি বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত হয়।’
এমিকাস কিউরিদের তথ্য সরবরাহ
২০১১ সালের পয়লা মার্চ থেকে আপিল শুনানি শুরু হলে সুপ্রিমকোর্ট ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীকে এই মামলার এমিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত করেন। নিযুক্ত এমিকাস কিউরিদের কেউ কেউ ফতোয়া, ফিকাহ, হাদিস সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, এগুলোর নির্ভরযোগ্যতা, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং আইনের সাথে এগুলোর সম্পর্ক জানতে চেয়ে শীর্ষ আলেম-উলামাদের কাছে চিঠি পাঠান। এই চিঠির উত্তরে এসব বিষয়ে দলিল-প্রমাণ, আলোচনা-বিশ্লেষণ সরবরাহ করেন শীর্ষ আলেমগণ। বিশেষ করে মারকাযুদ দাওয়াহ’র পক্ষ থেকে কয়েকজন এ কাজে এমিকাস কিউরিদের সহায়তা করেন।
সিনিয়র আইনজীবীদের পাশাপাশি আদালত ৫ জন শীর্ষ আলেমকেও এমিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত করেন। আলেম এমিকাস কিউরিদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন ফতোয়া পক্ষের হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মাওলানা নজরুল ইসলাম। তিনি আলেমদের কথা শুনেন এবং আদালতে একজনের কথা যেন আরেকজনের সঙ্গে মিলে না যায়, তা তিনি বুঝিয়ে দেন। অথবা আরও কিছু কথা যুক্ত করার মতো মনে হলে তাও বলে দেন। এমনভাবে তিনি আদালতে বক্তব্য দেয়ার জন্য প্রস্তুত করেন আলেমদের।
শেষকথা
হাইকোর্টে যুক্তি-তর্কের ওপর ভিত্তি করেই আলেমগণ বসে থাকেননি। বরং তারা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ দিয়ে বিচারকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতা বদলে দিতে চেয়েছেন। যেখানে যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, কাজে লাগিয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক এই কাজগুলো না করলে বিচারকরা হয়তো অন্যকিছু ভাবতেন। তখন ফতোয়ার পক্ষে রায় আসাটা অসম্ভব হয়ে যেত।
-ফাতেহ২৪
No comments:
Post a Comment