রাগিব রব্বানি:
২০০১ সালের পহেলা জানুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম রব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বেঞ্চ দেশে সবধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে আইন জারি করেন। ঘোষণায় বলা হয়, একমাত্র আদালতই অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইন সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতো পারবেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
হাইকোর্টের এই ঘোষণার পরপরই কিংবদন্তি ইসলামি রাজনীতিবিদ মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করেন। তাঁর প্রতিবাদের সূত্র ধরে দেশ জুড়ে গড়ে ওঠে দুর্বার আন্দোলন। আন্দোলন থামাতে মুফতী আমিনীসহ নেতৃস্থানীয় ওলামায়ে কেরামকে সরকার গ্রেপ্তার করে। আন্দোলন আরও প্রবল হয়ে ওঠে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশ ও বিডিআরের নির্বিচার গুলিতে শাহাদত বরণ করেন ছয়জন আন্দোলনকারী। এরই সূত্র ধরে দীর্ঘ ১০ বছর পর হাইকোর্টের এই রায়কে বাতিল ঘোষণা করে ফতোয়াকে বৈধতা দেওয়া হয়।
ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় এবং পরবর্তীতে তা বাতিল ঘোষণার মধ্যবর্তী সময়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে ওলামায়ে কেরামকে। ময়দানের এই লড়াইটা কেমন ছিল, কীভাবে গড়ে উঠেছিল দুর্বার সেই আন্দোলন, এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে কথা হয়েছিল ফতোয়া আন্দোলনের অন্যতম নেতা, ইসলামী ঐক্যজোটের বর্তমান মহাসচিব মুফতী ফয়জুল্লাহ’র সঙ্গে।
ফতোয়া নিষিদ্ধকারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া
ফতোয়া আন্দোলনের সূচনা কীভাবে এবং কখন হয়েছিল জানতে চাইলে মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, ২০০১ সালের পহেলা জানুয়ারি বিচারপতি গোলাম রব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বেঞ্চ ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় ঘোষণার পরপরই হজরত আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনী খবরটা জানতে পারেন। খবরটা জানামাত্রই একদিকে যেমন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, অপরদিকে পেরেশানও হন। আমরা যাঁরা তাঁর সহযোগী ছিলাম, আমাদেরকে তিনি নির্দেশ দিলেন ফতোয়া নিষিদ্ধকারীরা যে মুরতাদ, এই ব্যাপারে কিতাবাদি ঘেঁটে দলিলাদি যেন দ্রুত বের করি। আমরা হুজুরের নির্দেশ পালনে কিতাবাদি নিয়ে বসে যাই, আর হুজুর দেশের সমকালীন শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ শুরু করেন। প্রত্যেকের কাছে এই রায়ের ভয়াবহতা তুলে ধরে এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ চান। রায়দাতা দুই বিচারপতির মুরতাদ হয়ে যাওয়া মর্মে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার সম্মতিক্রমে একটি ফতোয়া প্রকাশের প্রস্তাবও পেশ করেন তিনি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য অধিকাংশের কাছ থেকে তিনি আশাব্যঞ্জক সাড়া পাচ্ছিলেন না। প্রত্যেকেই বলছিলেন, আদালতের বিরুদ্ধে এভাবে ফতোয়া প্রকাশ স্পর্শকাতর বিষয়। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু আমিনী রহ. নিজের কথায় অনড়। তিনি ফতোয়া জারি করবেনই। ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে কার্যত ওলামায়ে কেরামের মতামত প্রদানের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসবে, ইসলামপ্রশ্নে দেখা দেবে নানা সমস্যা, তাই এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যা-ই হোক, কোনো পরোয়া করতে রাজি হননি মুফতী আমিনী রহ.।
মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, রায় প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুফতী আমিনী রহ. দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন মুফতী এবং ইসলামী রাজনীতিবিদ হিসেবে ফতোয়া নিষিদ্ধকারী দুই বিচারপতিকে মুরতাদ ঘোষণা করে ফতোয়া জারি করেন। ফতোয়ার সরমর্ম ছিল এরকম—ফতোয়াকে যারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তারা আর মুসলিম থাকে না, মুরতাদ হয়ে যায়। ইসলামি আইন অনুযায়ী মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। হাইকোর্টের দুই বিচারপতি গোলাম রব্বানি এবং নাজমুন আরা সুলতানা ফতোয়াকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে মুরতাদ হয়ে গেছেন।
ফতোয়ার সঙ্গে এই দাবিও জানানো হয় যে, মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রেখে আইন পাশ করতে হবে এবং দুই বিচারপতিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিল করতে হবে।
ময়দানে রায়ের মোকাবেলা
মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, মুফতী আমিনী রহ. সাহস করে যখন এই ফতোয়া প্রকাশ করেন, দেশজুড়ে হইচই পড়ে যায়। তথাকথিত সুশীল ঘরানা উঠে পড়ে লাগে মুফতী আমিনী রহ.-এর পেছনে। কিন্তু তিনি নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন। আর ওলামায়ে কেরামও হুজুরের এ সাহসিকতা দেখে তাঁকে সমর্থন করেন। ফলে জানুয়ারি মাসেই দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম একত্রিত হন এবং ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিলের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। বৈঠকে খতিব আল্লামা উবায়দুল হক রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ., চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব ফজলুল করীম রহ.-সহ শীর্ষস্থানীয় সকলেই উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকেই ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়।
মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যাত্রা শুরু হয়। এবং পরবর্তী আন্দোলন এই ব্যানারেই পরিচালিত হয়। জনসমাবেশ থেকে ৩/৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল কর্মসূচি ঘোষিত হয়। আন্দোলনের এই স্পিরিট নষ্ট করতে ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমে মুফতী আমিনী রহ.-কে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর একে একে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, আল্লামা আবদুল লতিফ নেজামী, মুফতী ইজহারুল ইসলাম, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীবসহ নেতৃস্থানীয় অনেক আলেমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মুফতী ফয়জুল্লাহ জানান, এসব আলেমকে গ্রেপ্তারের পর আন্দোলনের নেতৃত্বের জায়গায় একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তবে সেটা তাৎক্ষণিকভাবেই পূরণ হয়ে যায় খতিব আল্লামা উবায়দুল হক রহ., আল্লামা মুহিউদ্দীন খান রহ., মুফতী ওয়াক্কাসসহ আমরা যাঁরা বাইরে ছিলাম তাঁদের তৎপরতার কারণে।
এদিকে নেতৃস্থানীয় আলেমদের গ্রেপ্তারের কারণে সারা দেশেই প্রতিবাদ হচ্ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেহেতু মুফতী আমিনী রহ.-এর এলাকা, প্রতিবাদটা সেখানেই বেশি হচ্ছিল। ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হরতাল কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশ ও বিডিআরের গুলিতে শাহাদত বরণ করেন ছয়জন আন্দোলনকারী। তারপর আন্দোলন আরও দুর্বার হয়ে ওঠে।
মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ তখন ফুরিয়ে এসেছিল। তারা দায়িত্ব ছাড়ার আগে আগেই মুফতী আমিনী ও শায়খুল হাদীস রহ. জামিনে মুক্তি পান। তারপর নির্বাচনের ডামাডোল। পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয় শহিদের বিচার, ক্ষতিপূরণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই ছয় শহিদের স্মরণে শহিদি মসজিদ নির্মাণ এবং ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শহিদ পরিবারগুলোকে একটি করে বাড়ি প্রদান করা ছাড়া তারা আর কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেনি। মুফতী আমিনী রহ.-সহ জোটভুক্ত দলের ওলামায়ে কেরামের বারংবার চেষ্টা ও অনুরোধের পরও ওই সরকার এসব দাবি বাস্তবায়ন করেনি। অবশেষে ২০১১ সালে দীর্ঘ দশ বছর পর ওলামায়ে কেরামের প্রচেষ্টায় এই রায় বাতিল করে আদালত ফতোয়া বৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করে।
-ফাতেহ২৪
No comments:
Post a Comment