রাকিবুল হাসান:

ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের প্রতিবাদে আলেম এবং মাদরাসাছাত্রসহ সর্বস্তরের তৌহিদি জনতা যখন আন্দোলনে নেমে আসে, তাদের থামিয়ে দেবার জন্য শয়তানের অনকগুলো মাথা গজিয়ে ওঠে। এই জাগরণকে দুর্বল করে দেবার জন্য উঠেপড়ে লাগে শয়তানের মাথাগুলো। এদের মধ্যে অন্যতম হলো সুশীল শ্রেণি, মিডিয়া এবং এনজিও কিংবা মানবাধিকার সংস্থা। সবাই মিলে চেষ্টা করেছে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের পক্ষে একটা শিবির গড়ে তুলতে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা ধোপে টেকেনি।

মিডিয়ার দৌড়ঝাঁপ

ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের সঙ্গে এক আলাপে বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ফতোয়া আন্দোলনে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে বলেন, ‘ফতোয়া নিষিদ্ধের ক্ষেত্রটাই তৈরি করেছে মিডিয়া। প্রায় এক দশক ধরে তারা বিভিন্নভাবে ফতোয়াকে হেয় করেছে। ব্যভিচার, প্রেম, বিয়ে নিয়ে বিভিন্ন গ্রাম্য সালিশকে ফতোয়া আখ্যা দিয়ে তারা ফলাও করে নিউজ করেছে, স্টোরি করেছে। ‘ফতোয়াবাজ’ শিরোনামে একটি সংখ্যা-ও করেছিল বিচিত্রা ম্যাগাজিন। এভাবে তারা ফতোয়াকে নারী নির্যাতনের একটি হাতিয়ার হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে। আর ফতোয়াকে কলঙ্কিত করার এই প্রচেষ্টারই আইনি প্রতিধ্বনি ছিল ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়।’

মুফতি তৈয়ব সাহেব বলেন, ‘মিডিয়া বরাবরের মতোই সুশীল এবং এনজিওদের পক্ষ নিয়েছে। ফতোয়াবিরোধী নিউজ, নিবন্ধ, ফলোআপ প্রচার করেছে। তবে ফতোয়ার পক্ষে সবচে সরব ছিল মানবজমিন। তারা আলেমদের মতামত, সাক্ষাৎকার, নিবন্ধ ছেপেছে। নিউজ কাভারেজ এবং ফলোআপ করেছে। কাটতির জন্য হোক কিংবা অন্যকিছুর জন্য, তবুও আমাদের মতামত তুলে ধরেছে। এরপরে ইনকিলাবও আমাদের পক্ষে কথা বলেছে। ২০০১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছয়জন ছাত্র শহীদ হলে, ধারাবাহিকভাবে তাদের স্টোরি ছাপায় ইনকিলাব। ছয়দিনে ছয়জনের স্টোরি। পরে এগুলো সম্পাদনা করে একটা বইও করেছিলাম আমি।’

সুশীলদের ভূমিকা

সুশীলরা বরাবরই ছিল ফতোয়া নিষিদ্ধের পক্ষে। ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিলে আপিল শুনানির সময় তারা খুব চেষ্টা করেছে নিষিদ্ধের পক্ষে যুক্তি-তর্ক দাঁড় করাতে। তৎকালীন পত্র-পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতাগুলোতে সুশীলদের কলাম দেখলেই বিষয়টি টের পাওয়া যায়।

২০১০ সালের পয়লা জুন প্রথম আলোর এক নিবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমানের বক্তব্য কোট করা হয়। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘কতগুলো ভুল ধারণার ভিত্তিতে আপিল করা হয়েছে। মুসলিম শরিয়া আইন আমাদের আইনি ব্যবস্থার অংশ নয়। শরিয়া আইনের যুক্তির ওপর ভিত্তি করে তারা আরও যেসব যুক্তি দিয়েছে, সেগুলোও একই কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের আইনি কাঠামোতে কোনো আইনি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচার প্রশাসন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। অন্য কেউ এখানে আইনি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। এদিক থেকেও ফতোয়া দেওয়া আইন ও সংবিধানবিরোধী।’

তারপর মিজানুর রহমান ফতোয়ার ওপর আস্ত একটা অপবাদই চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফতোয়াগুলো একপেশে ও নারীবিরোধী হয়ে থাকে। অথচ আমাদের সংবিধানে বলা আছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আইনে কোনো বৈষম্য করা যাবে না।’

২০১৫ সালের ১১ মার্চ প্রথম আলোতে নিজের লেখা এক প্রবন্ধে মিজানুর রহমান খান আইনজীবী মাহমুদুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে লিখেছিলেন, ‘আজকের দিনে মুফতি বলে কিছু নেই। তাই ফতোয়াদানেরও কোনো প্রশ্ন নেই।’ পাশাপাশি তিনি সংবিধানের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ফতোয়া দেয়া যাবে না মর্মে কিছু প্রবন্ধ পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করারও আহ্বান জানান।’

ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি তৈয়ব বলেন, এই সুশীলদের ভয়েই বিএনপি আমাদের আপিলের ফাইল খুলতে দেয়নি। বরং আলেমদেরকে আপিল ফিরিয়ে নিতে চাপ দিয়েছে।

এনজিওদের লম্ফঝম্ফ

ফতোয়া আন্দোলনের শুরু থেকেই এনজিও এবং তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাগুলো ফতোয়াবিরোধী জনমত দেখানোর চেষ্টা করেছে। আলেমদের মতো তারাও মাঠে এসে হুংকার ছাড়তে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। মুফতি তৈয়ব বলেন, ‘২০০১ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে আমরা যেদিন ঢাকায় হরতাল পালন করি, ফতোয়াবিরোধী এক মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিল এনজিওজোট কিন্তু আমাদের হরতাল এত  কঠিন ছিল, তাদের সমাবেশে তেমন কেউ আসতেই পারেনি। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা সমাবেশ করেছে। কিন্তু আলেমদের আন্দোলনের প্রভাবে তাদের সমাবেশ কোনো উত্তাপ ছড়াতে পারেনি।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসময় আওয়াজ তুলে—বাংলাদেশে ফতোয়ার মাধ্যমে অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। তারা উদাহরণ হিসেবে কিছু গ্রাম্য সালিশ তুলে ধরে। যেগুলো মূলত কোনো ফতোয়াই ছিল না। এমনকি আপিলে ফতোয়া নিষিদ্ধের পক্ষে উকালতি করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসকের আইনজীবী ওবায়েদুর রহমান শুনানি শুরুর আগে ২০১০ সালের পয়লা জুন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ফতোয়ার ফলে মানবাধিকার ও আইন কীভাবে লঙ্ঘিত হয় এবং এর ফলে নারীরা যে নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে, তা শুনানিতে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

এনজিও ও মানবাধিকার কর্মীরা আসলে ফতোয়াকে নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছে। নারীর নিরাপত্তার জন্য ফতোয়াকে হুমকি হিসেবে উল্লেখ করতে চেয়েছে।

-ফাতেহ২৪