Tuesday, November 14, 2017

প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ নিয়ে সরকার দলীয় নেতাদের বক্তব্য

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমঃ
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) স্বেচ্ছায় ছুটি নিয়েছেন এবং তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগও করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ নিয়ে বিএনপি মিথ্যাচার করছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো চাপ কিংবা উৎসাহ ছিল না। বিএনপি মিথ্যাচারে অভ্যস্ত, এটা তাদের সংস্কৃতি, তাই প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ করা নিয়ে সর্বত্রই মিথ্যাচার করছে। এটা তাদের চরিত্রে বহিঃপ্রকাশ।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফঃ
প্রধান বিচারপতি যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই উনি অবসরে গিয়েছেন। এখানে আমাদের কারও বলার কিছু নেই বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম।
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সাহেব অসুস্থ ছিলেন। মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি, উনি সর্বশেষ সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়েছেন। এবং সেখান থেকে কানাডায় গিয়েছেন। ওনার বরাত দিয়ে মিডিয়াতেও এসেছে, সিঙ্গাপুরে উনি ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত, প্রধান বিচারপতি এযাবৎকাল উনি যে অসুস্থ, যেটা মিডিয়াতে বহুবার এসেছে, এটাই সত্য।
হানিফ অভিযোগ করে বলেন, ‘একটা অসুস্থ মানুষকে সুস্থ বলে দাবি করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে বিএনপি শুরু থেকেই মিথ্যাচারে লিপ্ত ছিল।

সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরঃ
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিএনপি বলে, প্রধান বিচারপতিকে আমরা নাকি জোর করে পদত্যাগ করিয়েছি। প্রধান বিচারপতি কোথা থেকে আজ পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন? সিঙ্গাপুর থেকে। সিঙ্গাপুরে কি পুলিশ বাহিনী অথবা কোনো স্পেশাল ফোর্স ছিল যে তাঁকে জোর করে পদত্যাগ করিয়েছে? এটা বিশ্বাস করেন আপনারা? আপিল বিভাগের বিচারকেরা অলরেডি রাষ্ট্রপতিকে বলেছেন, তাঁর সঙ্গে আমরা কাজ করব না। সরকারের এখানে কী দোষ, আমি জানতে চাই।
আজ শনিবার বিকেলে গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ মাঠে গাজীপুর মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রমের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ওবায়দুল কাদের এ কথা বলেন।

সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি সাড়ে আট বছরে সাড়ে আট মিনিটের জন্যও রাস্তায় নামতে পারেনি। বাইরে আন্দোলনের ডাক দিয়ে নেতারা এয়ারকন্ডিশন ঘরে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখেন। বিএনপির নেতারা হিন্দি সিরিয়াল দেখেন, আর মোবাইলে খবর নেন পুলিশের গতিবিধি কী। এই হচ্ছে বিএনপি।

Monday, November 13, 2017

ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নে ক্রমধারার অপরিহার্যতা


কনসেপ্ট অব গ্রাজুয়্যলিটি হলো একটি সহজ কিন্তু গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর। এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও তাত্ত্বিক বিষয়। আমি এই প্রশ্নের এক ধরনের জবাব দিয়েছি এবং যে কেউ এর কোনো সম্ভাব্য ও যুক্তিসংগত উত্তর দিতে পারে।

আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিয়েছি এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পূর্ণ করেছি আর তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে কবুল করে নিয়েছি।’ [সূরা মায়েদা: ৩]

বিদায় হজ্বের সময়ে পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে দ্বীন বা জীবনাদর্শ হিসেবে ইসলাম কি কমপ্লিট ছিল না? ‘… আজ পরিপূর্ণ করা হলো …’ এর মানে নয় কি যে বিষয়টি ইতোপূর্বে কমপ্লিট ছিল না?

যদি তাই হয়, অর্থাৎ তৎপূর্বে তা পূর্ণ বা কমপ্লিট না হয়ে থাকে তাহলে এর প্রাথমিক পর্যায়ে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁরা কি অ-পূর্ণ ইসলামের উপর মৃত্যুবরণ করেছেন? আর যদি বলা হয় যে তাঁদের ইসলাম পূর্ণ ছিল অথচ তখনও ইসলামী বিধি-বিধান প্রবর্তন সমাপ্ত বা সুসম্পন্ন হয় নাই! তাঁরা তাঁদের সময়কালে যতটুকু পেয়েছিলেন তা তৎপরবর্তীর তুলনায় incomplete ছিল। 

ধরা যাক, কোনো একজন আমল করার সুযোগ পেয়েছেন শতকরা ৫০ ভাগ বিধি-বিধানের। বাদবাকি ৫০ ভাগের উপর আমল করার সুযোগ পাননি। এখন ঐ ৫০ ভাগকে তাঁর জন্য ১০০ ভাগ হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে? নাকি ঐ ৫০ ভাগ এবং পরবর্তী ১০০ ভাগ এই দুইটারই equal status? হতে পারে তাঁরা যতটুকু পেয়েছেন, ধরুন তা শতকরা ৫০ ভাগ, তার বাইরের অপর অংশটুকু তাঁদের জন্যে একটা special ফেভার হিসেবে exemption করা হয়েছে। যদি তা exemption না হয় তাহলে বলতে হবে যে আসলে দুটোই মূলত একই। শুধু প্রায়োগিক বিধি-বিধানের দিক থেকে কোনোটাকে কম expand করা হয়েছে আর কোনোটাকে more expand হয়েছে। কোনো ইলাস্টিককে যেমন আমরা ৫ সেন্টিমিটার লম্বা করতে পারি, আবার সেটিকে সর্বোচ্চ ১০ সেন্টিমিটারও লম্বা করতে পারি। উভয় অবস্থাতেই সেটি একই রাবার হিসেবে থাকছে। তাই না?

তাহলে which Islam is the complete Islam? আমরা দেখি ইসলামের ৩টা মেজর phase:
(১) প্রথম ১৩ বছরে মক্কার যে ইসলাম তা ছিল মূলত কনসেপচুয়্যল এবং বিধিবিধানের দিক থেকে almost the same
(২) মদিনার প্রথম period এ বিস্তারিত বিধিবিধানের প্রবর্তন মোটামুটি শুরু হয়েছে এবং
(৩) মাদানী যুগের শেষের দিকে তা complete হয়েছে।

বিধিবিধানের দিক থেকে এই ৩টা পর্যায় স্পষ্টতই ৩ প্রকারের। যারা মক্কী বা earlier মাদানী যুগে মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁরা তো পরবর্তী সময়ে প্রবর্তিত অনেকগুলো বিধি-বিধানের উপর আমল করার সুযোগ পাননি। তৎসত্ত্বেও তাঁদের ঈমান ও ইসলাম যদি complete-ই থাকে তাহলে তাঁরা কি কোনো special sanction বা exemption পেয়েছেন? অবশ্য এমন কোনো কথা কুরআন ও হাদিসের কোথাও নাই যে ঈমান, ইসলাম বা ইসলামের কোনো দিক থেকে উনাদের জন্য কোনো special sanction ছিল।

তাহলে, ইসলাম জিনিসটা কী? রেফারেন্সের দিক থেকে দেখলে এটাকে একটা concept দিয়েই সমন্বয় করতে হবে। ‘…আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বী-নাকুম …’ – এই আয়াতসহ কোরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহে বলা হয়েছে দ্বীন হলো ইসলাম। হাদিসে জিবরাইলে বলা হয়েছে ইসলাম হলো কলেমা, নামাজ, রোজা, যাকাত, হজ্ব এই পাঁচটা বিষয়ের সমষ্টি। সূরা আশ শূরার ১৩নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের সেই নিয়ম-বিধান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যার হুকুম তিনি নূহকে দিয়েছিলেন। আর যা এখন তোমার প্রতি আমরা অহীর সাহায্যে পাঠিয়েছি। আর যার হিদায়াত আমরা ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম এই তাকীদ সহকারে যে, কায়েম কর এই দ্বীনকে এবং ইহাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেও না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে মানুষের দ্বীন বা জীবন-ব্যবস্থা বরাবর একই ছিল। তাই বলা যায় যে history of Islam is the history of mankind দুনিয়াতে আল্লাহ তাআলা মানুষ পাঠানোর সাথে সাথে একটা জীবন বিধানও পাঠিয়েছেন। ইসলাম এই নামটা হযরত ইব্রাহীম (আ) দিয়েছেন- এই যা।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রাথমিক পর্যায়ের সাহাবীদের ক্ষেত্রে exemption-এর তত্ত্বটা খাটে না। কোরআন-হাদীসে এমন কোনো রেফারেন্স নেই। বরঞ্চ সবগুলো রেফারেন্স হচ্ছে এই মর্মে যে সবার একই মানদণ্ডে বিচার করা হবে। কাউকে বিশেষ কোনো সুবিধা বা রেয়াত দেয়া হবে না। রাসূল (স) তাঁর ফুফু সাফিয়া (রা) কে, তাঁর কন্যা ফাতিমা (রা) কে নাজাতের জন্য বেশি বেশি আমল করার কথা বলেছেন।

ইসলামের দুইটা দিক। একটা হলো এর conceptual দিক আর একটা হলো এর implementation এর দিক। concept টা হলো all the same এবং total এর মধ্যে কোনো বেশ কম করা যাবে না। Concept এ কোনো ধরনের compromise এর প্রস্তাবে রাসূল (স) দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন যে আমার এক হাতে চাঁদ ও এক হাতে সূর্য্ এনে দিলেও আমি তোমাদের (সমঝোতার) প্রস্তাব মেনে নিবো না।তাই, সূরা কাফেরুন এ যে সিঙ্গুলারিটির কথা বলা হয়েছে সেটি নিতান্তই conceptual Islam সম্পর্কিত।

অতএব, দ্বীন হিসেবে ইসলাম সর্বদাই সিঙ্গুলার। আর শরীয়াহ হিসেবে ইসলাম প্লুরাল ও ডাইভারসিফাইড। যদিও এই ডাইভারসিফিকেশনের মধ্যে একটা ইইউনিফিকেশান আছে, বাউন্ডারি আছে। মদিনা সনদ স্বাক্ষরের অব্যবহিত পরে তৎকালীন ইয়াসরিব শহরে যে শাসন-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে সেটা কি ইসলামী রাষ্ট্র ছিল না? অথচ, ফতেহ মক্কার পরে যে ইসলামী রাষ্ট্র, সেটার যে চরিত্র আর রূপ, সেটার সাথে প্রথম হিজরীর তৎকালীন ইয়াসরিব নগরের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার পার্থক্য অনেক। মনে করা হয়, Islamic state is a single entity, either it is established or it is notআমার বিবেচনায়, ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্র কোনো single entity নয়। এর বিভিন্ন পর্যায় আছে। রাসূল (স) বিদায় হজ্বে বলেছেন যে, আমি কী আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? সাহাবীরা বলেছেন, হ্যাঁ, আপনি পেরেছেন।

Political science এ যেটাকে utopia বলা হয়, ইসলামী রাষ্ট্র কি বাস্তবায়ন-অনুপযোগী ও কল্পনাপ্রসূত এমন একটি ঐশ্বরিক আদর্শ রাষ্ট্র? এককথায়, ইসলামী রাষ্ট্র কি একটা ইউটোপিয়া? বিষয়টা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। ইসলামিক utopia মানে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতির সর্বোচ্চ level যেটিতে আমরা পৌঁছার ও থাকার চেষ্টা করবো। আমরা যদি এ ধরনের কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে একে টেকসই অবস্থায় নিয়ে যেতে পারি তবুও মৌলিক গুণগত দিক থেকে সেটি তৎকালীন মদিনাতে গড়ে উঠা রাষ্ট্রের মত হবে না। কারণ, সেই রাষ্ট্রের Head ছিলেন একজন prophet এবং prophet Mohammad (sm), the best prophet, The best statesmanএই অর্থে কখনোই যেহেতু আমরা সেই মানের একটা আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করতে পারব না তাই বর্তমান প্রেক্ষিতে একে একধরনের utopia বলা যায়, যদিও সেটিকেই standard ধরে আমাদের এগুতে হবে।

Gradual implementation-কে আমরা যদি special sanction হিসেবে না ধরি তাহলে আল্লাহর রাসূল (স) যেভাবে তৎকালীন আরবে ইসলাম কায়েম করেছেন আমরাও আমাদের স্ব স্ব সমাজ ও দেশে সেভাবে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করব। এই সহজ কথাটার একটা ব্যাপক তাৎপর্য আছে। বিধি-বিধানের দিক থেকে মদিনার আদর্শ রাষ্ট্রকে পর্যায়ক্রমে গড়ে তোলা হয়েছে। যখনই নতুন কোনো বিধান দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট পূর্ববর্তীটা রহিত হয়ে গেছে। উপরের সর্বোচ্চ লেভেলে যেতে হলে আমাদেরকে মাঝখানের পথ পাড়ি দিয়েই যেতে হবে। প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, ইন্টারমিডিয়েট ও ফাইনাল- যতগুলো পর্যায় আছে বা ছিল এই সবগুলোকে একই ধারাবাহিকতায় পাড়ি দিয়ে উপরের লেভেলে পৌঁছতে হবে। সরাসরি jump করা যাবে না।

দেখা যাচ্ছে, ইসলাম কায়েমের একটা হলো deductive method আর একটা হলো inductive methodরাসূল (স) যেখানে রেখে গেছেন সেখান থেকে কুরআন হাদীস পুরোপুরি তথা অখণ্ডভাবে আমরা পেয়েছি। আমরা কী প্রথমেই সর্বশেষটি দিয়ে শুরু করব? আমরা যদি শুরুতেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিধানকে আমল করার কথা বলি তাহলে capacity’র বাইরে হওয়ার কারণে আমাদেরকে কিছু জিনিস ফেলে দিতে হবে। ফেলে দেওয়ার সময় হতে পারে যে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা ফেলে দেয়া হয়েছে আর কম গুরুত্বপূর্ণগুলোকে তুলে নেয়া হয়েছে। আর যদি মনে করা হয়, আমরা সাধ্য মোতাবেক বহন করব। তখন যত কমই পারি না কেন যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটাকেই আমরা প্রথমে কাঁধে তুলে নেব এবং ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির সাথে সাথে পুরো বোঝাটাই একদিন আপহোল্ড করে নিতে পারবো। একটা পাকা দালানের কাঠামো যেভাবে গড়ে ওঠে সেভাবেই যে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করতে হয়, হোক তা অ-ইসলামী বা ইসলামী। আল্লাহ রাসূল (স)ও তা-ই করেছেন। নয় কি?

Gradual implementation of Islam এ যদি রাসূল (স) এর জন্য কোনো special sanction না হয়ে থাকে তাহলে এখন কেন আমরা সেটা বাদ দিব? আর যদি রাসূল (স) এর জন্য গ্রাজুয়্যলিটির বিষয়টি কোনো special sanction বা privilege হওয়ার দাবি করা হয় তাহলে নিচের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে- নবীদেরকে আমরা যদি শিক্ষক মনে করি এবং আমাদেরকে যদি ছাত্র হিসেবে মনে করি তাহলে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে ভাল শিক্ষককে [মুহাম্মদ(স)] তাঁর সেরা ছাত্রদের [সাহাবীগণ] বোঝানো ও শেখানোর জন্য ক্রমধারা অবলম্বন করতে হয়েছে। আমরা তথা পরবর্তীদের কোনো শিক্ষক নাই অথচ ছাত্র হিসেবে আমরা অতি নিম্নমানের! এমতাবস্থায় ক্রমধারার এই সুবিধা আমাদের জন্য কেন প্রযোজ্য হবে না? আমরা এখন যে সমাজে বাস করছি এই সমাজটা যদি আন্দোলনের একটা উচ্চতর স্তরে না থেকে একটা নিম্নতর ধাপে থাকে তাহলে উচ্চতর ধাপের জন্য যা প্রযোজ্য সেসব বিধি-বিধানকে যদি আমরা সরাসরি obligatory মনে করে প্রয়োগের চেষ্টা করি তাহলে একটা category mistake সংঘটিত হবে যাতে সমাজে বিশৃংখলার সৃষ্টি হবে। যা ফিতনা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

Graduality-কেও আমরা mechanically গ্রহণ বা implement করতে পারবো না। সেটাকে যথাসম্ভব rationalize করতে হবে। সাহাবীরা এমনকি জানতেনও না যে পরবর্তী stepটা কি হবে! তাঁরা mentally ক্রমাগতভাবে তৈরি হচ্ছিলেন বটে। এক পর্যায়ে ওহীর সূত্রে রাসূল (স) যা কিছু বলেছেন, তাঁরা তা মেনে নিয়েছেন। বিদ্যমান পরিবেশ ও জনমানসকে যথাসম্ভব ready করেই কোনো নতুন বিধান দেয়া হয়েছে। আমরা পুরো জিনিসটাকে একসাথে পেয়ে গেছি। এতে আমাদের সুবিধা হয়েছে, আমরা জানি যে ultimately ব্যাপারটা বা চূড়ান্ত বিধিটা কি? অসুবিধাটা হয়েছে এই, মনে করা হচ্ছে এ সবগুলো একই সাথে বা এর চূড়ান্ত স্তরটিই শুধুমাত্র আমাদের জন্য সর্বাবস্থায় obligatory

আমরা একটা mixed society-তে বাস করছি। দারুল কুফর ও দারুল ইসলামের একটা মাঝামাঝি অবস্থায় আমরা বসবাস করছি। এখানে higher level এর কোনো কোনো বিষয় আমরা easily করতে পারছি। যেমন আমরা জুমআর নামাজ পড়তে পারছি। কিন্তু ঐ level-এর জন্য প্রযোজ্য অন্যান্য কোনো কোনো বিধি আমরা মানতে পারছি না। যেমন আমরা হদ’ [দণ্ডবিধি] কায়েম করতে পারছি না। যদি সাব্যস্ত করা হয় যে, আমরা মক্কি যুগে আছি তাহলে আমরা কি জুমআ বাদ দিব? যাকাত বাদ দিব? হিজাব বাদ দিব? আমরা কি সুদ গ্রহণ করব?

বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, mixed-society-status concept-কে যদি আমরা গ্রহণ করে নেই তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়ায় যে, রুখসত [সর্বনিম্ন অনুমোদিত সীমা] এবং আজীমত [সর্বোচ্চ মান]-এর ধারণাকে সামনে রেখে যেখানে আমাদের পক্ষে সম্ভব, যে বিষয়ে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদিত ক্ষমতা আছে যেখানে আমরা শরীয়াহর সেই হুকুমটাকেই আমল করবো যা উচ্চতর ধাপের। আমাদের লক্ষ্য হলো যথাসম্ভব উচ্চতর ধাপে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে উন্নীত করা। শর্ত হলো সম্ভাব্য সকল উপায়ে উক্ত উন্নততর আইনকে মেনে নেয়ার জন্য সমাজকে তৈরি করা। এতে সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টির আশংকা থাকে না। সামাজিক authority যেসব উন্নততর বিধানকে allow করে না সেগুলোর প্রযোজ্যতাকে আমরা নীতিগতভাবে স্বীকার করব, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়নকে স্থগিত রাখবো। ব্যক্তিগতভাবে মক্কীযুগে এবং প্রাথমিক মাদানী যুগে যেসব ইসলামী বিধি-বিধান বলবৎ ছিল যেমন নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি বিষয়গুলোকে always মেনে চলব। ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে ও আওতার মধ্যে আমরা আজিমতকে follow করব কিন্তু অন্যদের জন্য, সমাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আমরা রুখসাতকে allow করব। এ ক্ষেত্রে আমরা lowestকে approve করলেও মূল স্ট্রাকচারের highest নিয়মগুলোকে যুক্তিসংগত হিসেবে উপস্থাপন করা ও ক্রমান্বয়ে তা বাস্তবায়ন করার জন্য আমরা সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট থাকবো । এই লক্ষ্যে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে আমরা যথাসম্ভব তৈরি বা buildup করার চেষ্টা করবো। এক কথায় যাকে ইসলামী আন্দোলন বলা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখন আমরা কোন পর্যায়ে আছি? এ প্রশ্নের উত্তর নির্ণয়ের আগে ধর্ম ও ইসলাম নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি। ব্যক্তিজীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু ধর্মীয় বিষয় ও বৈশিষ্ট্য অন্তর্গত ও অপরিহার্যভাবে ইসলামের মধ্যে আছে বটে, যাকে আমরা ইবাদাত বলি। তৎসত্ত্বেও ইসলামের অপর বৃহৎ অংশ যাকে ফিকাহর ভাষায় বলা হয় মুয়ামালাত, তা ধর্মীয় চরিত্রের নয়; পুরোপুরিই বৈষয়িক। বিশেষ করে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদিতে ইসলামের বিধি-বিধানসমূহের সাথে ধর্ম বলতে যা বুঝানো হয় তার মিল নাই। আল্লাহ তায়ালা ইবাদতের জন্য মানুষ সৃষ্টি করেননি। এজন্য ফেরেশতারা যথেষ্ট ছিল। শুধু এ পৃথিবীকে নয়, পুরো বিশ্ব পরিচালনায় তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামকে এই দৃষ্টিকোণ হতে দেখে না।

তাঁরা মনে করে, ইসলাম অন্যতম একটা ধর্মমাত্র। হতে পারে তা উন্নততর বা শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইসলামকে বুঝা বা সত্যিকারের মুসলিম হওয়ার জন্য যে বিষয়গুলো জানা দরকার তার ন্যুনতম জ্ঞানও আমাদের দেশের জনসাধারণের মধ্যে নাই। তাঁরা ইলাহ এই পরিভাষাটির অর্থ বোঝে না, রব শব্দের অর্থ বোঝে না। তাঁরা কালেমা উচ্চারণ করে ঠিক মতো, কিন্তু এর মর্মার্থ বা কনসিকোয়েন্স সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না। মক্কার কাফের-মুশরিকেরা কালেমার যে implication পরিষ্কার করে বুঝতে পেরেছিল, আমাদের এখানে শিক্ষিত লোকেরাও সেগুলো বুঝে না। কালেমাকে তাঁরা পবিত্র একটা spell হিসেবে মনে করে। এর practical জিনিসগুলো বোঝে না। তাঁরা উলীল আমর সম্পর্কে শুনে নাই, বোঝে না। ইবাদাত সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখলেও সমগুরুত্বপূর্ণ তাগুত’- এই শব্দটি আদৌ শোনেনি!? নরম মাটির উপরে যদি একটা structure করতে হয় তাহলে প্রথমে ভালোভাবে piling করতে হবে। সূফী-দরবেশ দ্বারা ইসলাম প্রচার হলেও এদেশে কখনো ইসলামী রাষ্ট্র ছিল না। তাই এদেশের মানুষকে ভাল করে একটা তত্ত্ব হিসেবে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দিতে হবে, বোঝাতে হবে। concept হিসেবে ইসলাম clear হওয়ার পর তাঁদের সামনে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এজেন্ডা নিয়ে আসতে হবে।

ইসলাম নিয়ে যারা কাজ করে, ইসলামিক movement হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয় তাঁদের মধ্যেও অনেক সমস্যা আছে। এরা মনে করে যে তাঁরা নিজেরা সবকিছু ভাল করেই বোঝেন। তাঁদের দৃষ্টিতে একমাত্র সমস্যা হলো অন্যদেরকে বোঝানো, অধিকাংশ (?) মানুষকে কনভিন্স করে ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা! অথচ, ইসলামী অনেক কনসেপ্ট ও আন্ডারস্ট্যান্ডিং নিয়ে তাঁদের নিজেদের মধ্যেই গভীর মতানৈক্য রয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা তাত্ত্বিকের বুলি কপচানোর বাইরে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করা হয় না বিধায় বাহ্যত মনে হয়, কোনো সমস্যা নাই! কোনো কোনো সেক্টরে তাঁরা কোনো কাজই করেনি। ইসলাম তাঁদের কাছে এক সর্বরোগহরি বড়ি (panacea), কোনোমতে খেতে ও খাওয়াতে পারলেই কেল্লা ফতে! এরই ফলশ্রুতিতে তাঁরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে শাখা-প্রশাখা নিয়ে involve হয়েছেন ও হচ্ছেন। প্রায়োগিক বিষয়ে যে ধরনের understanding দরকার তা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায় না। ইসলামিক সংগঠনগুলোতে intellectual bankruptcy বা বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াপনা বলতে যা বোঝায় সেই জিনিসটা লক্ষ্যণীয় মাত্রায় বিদ্যমান! প্রচলিত ও জনপ্রিয় ধর্মীয় ভাবধারার মতো ইসলামী আন্দোলনের সংগঠনসমূহেও স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করা হয়! ভাবখানা এমন, ক্ষমতা পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে! এই হলো রাজনৈতিক ইসলাপন্থীদের স্ব-নির্মিত গোলক-ধাঁধাঁ!

এ বিষয়ে আর একটা পর্যবেক্ষণ হচ্ছে ইসলামিস্টরা সাধারণত এ দেশকে, দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে, দেশের মানুষকে আপন মনে করে না, own করে না। জন-বিচ্ছিন্নতাকেও তাঁরা খারাপ বা ক্ষতিকর মনে করে না। বরং এই স্বাতন্ত্র্যকে তাঁরা উপভোগ করেন! ইসলামপন্থীদের মনোভাব হলো, তাঁরা সাধারণ (পাপী!) মানুষের (পরকালীন) মুক্তি বা নাজাতের মহান দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। এ ধরনের মানস গঠনের কারণে তাঁরা সবসময়ে superiority complexity-তে ভোগেন ও একধরনের self satisfaction feel করেন। ফলে তাঁরা মানুষের কাছে যখন যান তখন নিজেদেরকে special status-এর মনে করেন এবং মানুষও তাঁদেরকে (পারলৌকিক বিবেচনায়) একধরনের special (religious) status দিয়ে থাকে। মিউচুয়্যাল এক্সক্লুশানের ভিত্তিতে এ ধরনের একটা সেক্যুলার ফরমেট এখানে কম-বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। এই ধারণা থেকে বের হয়ে এসে সঠিকভাবে ইসলামকে বুঝতে চাইলে deductive approach of understanding Islam এর ভুল পন্থা হতে সরে আসতে হবে। মনে করা হচ্ছে, ইসলামের কোনো একটি বিধান কৌশলে বা জোর করে চাপিয়ে দিতে পারলে কিছু না কিছু ইসলাম তো কায়েম করা গেল! ইসলামকে একটা জীবন-দৃষ্টি বা আদর্শ হিসেবে না দেখে বিধি-বিধানের একটা আঁটি বা সমষ্টি হিসেবে দেখাই হচ্ছে এই ভ্রান্ত ও প্রান্তিক মানসিকতার কারণ।

ইসলামের দুটি দিক, একটা হলো Islam in its core of beliefs and personal practices যেমন কালেমা, নামাজ, রোজা ইত্যাদি ন্যূনতম বিষয়গুলো। অন্যটা হচ্ছে এর implementary aspects that are socio-cultural-economic-politically concernedএগুলোর বাস্তবায়ন, উন্নয়ন ও প্রেক্ষিত ক্রমধারায় অগ্রসরমান। এসব বিষয়ে স্থানিক ও কালিক পরিক্রমায় উদ্ভূত সমস্যা ও উপযোগী সমাধান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কোনো কালবিশেষের নিরিখে কনক্লুসিভলি বলা সম্ভব নয়। সুন্নাহভিত্তিক মূলনীতির আলোকে এসব বিষয়ে যুগপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

প্লাটোর আদর্শ রাষ্ট্র সত্যিকারের আদর্শ রাষ্ট্র নয় এবং কখনো কোনো দেশে দার্শনিক-রাজা ছিল না। এই দৃষ্টিতে মদীনার সমাজ-রাষ্ট্র একটি বাস্তব সমাজ-রাষ্ট্র, প্লাটোনিক ইউটোপিয়া মাত্র নয়। একজন রাসূলের নেতৃত্বে একটা রাষ্ট্র সংগত কারণেই আমরা কখনো কায়েমে করতে পারবো না। এ দৃষ্টিতে মদীনার তৎকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখন আমাদের জন্য একটা কল্পরূপ বা ইউটোপিয়া বটে! ইসলামী রাষ্ট্রর শেষ বলে কোনো কিছু নেই। এমনও দেখা গেছে যে, কোনো সাহাবী ইসলাম গ্রহণ করার পর মারা গেছেন। কোনো আমল করার সুযোগ পাননি। তাহলে ওনাকে কি বিশেষ রেয়াত দেয়া হবে, না তাঁর জন্য যা প্রযোজ্য বা সম্ভাব্য ছিল কেবলমাত্র তাঁর ভিত্তিতেই তাঁর বিচার করা হবে? ইসলামকে যেহেতু আমরা মূলত একটা কনসেপ্ট হিসেবে মনে করছি, যেহেতু তিনি কনসেপ্টটাকে পুরোপুরিই গ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ ঈমান এনেছেন তাহলে তাঁর ইসলাম পরিপূর্ণ ছিল ধরে নেয়া হবে। আমরা কাফেরের যে সংজ্ঞাটা দিই সেটি হলো যে, ব্যক্তি জেনে-বুঝে ইসলামকে গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছে, regret করেছে।

Mixed society’র কনসেপ্ট অনুসারে আমরা যে সমাজে আছি দেখা গেল, কোনো দিক থেকে তা primary level-এর, আবার অন্য কোনো দিক থেকে তা intermediary level-এর অথবা advance level-এর। তাহলে আমরা কোন্ course of actionকে ওভারঅল ফলো করব? আমাদের পক্ষে যেসব rules-regulationগুলো adopt করা সম্ভব হচ্ছে সেসব rules-regulationগুলোকে আমরা adopt করব। বিদ্যমান সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে যেখানে আমাদের যেটা করা সম্ভব সেটি করবো, আপাতত ততটুকুই প্রযোজ্য মনে করব। যেটি করতে পারছি না সেটি করার অনুমোদন দেয়ার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রভাবিত, পরিচালিত ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে [গণতান্ত্রিক অথবা অন্য কোনো সম্ভাব্য উপায়ে] বাধ্য করবো। এ কাজে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও যৌক্তিকতাকে সর্বদা মেনে চলতে হবে। বুঝতে হবে, সমাজের মূলধারার সম্পৃক্ততাই হলো জিহাদ ও ফিতনার মাপকাঠি।

সমাজের মূলধারার সম্পৃক্ততা থাকা বা না থাকাই নির্ধারণ করবে গৃহীত কোনো বিশেষ কর্মধারা জিহাদ নাকি ফিতনা? জিহাদ ফরজ, ফিতনা হারাম। ব্যক্তি বিশেষ, একা একা জিহাদ করতে পারে না। দল বিশেষও জিহাদ করতে পারে না। এমনকি তা ইক্বামতে দ্বীনের কোনো সংগঠন হলেও! বৈধ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জিহাদ ঘোষণা ও পরিচালনা বাধ্যতামূলক। এ ধরনের কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতিতে প্রত্যেকের আত্মরক্ষার অধিকার সর্বদাই বলবৎ থাকে। এ ধরনের আত্মরক্ষামূলক ও ব্যক্তিগত প্রতিরোধে কেউ মারা গেলে প্রতিরোধকারী শহীদি মর্যাদা লাভ করবেন। যদিও এই সংঘর্ষ জিহাদ হিসেবে গণ্য হবে না। যেভাবে কোনো দূর্ঘটনায়, দুরারোগ্য ব্যাধিতে ও সন্তান প্রসবের সময় কেউ মৃত্যুবরণ করলে শহীদি মর্যাদা লাভ করবেন।

রাসূল (স) সর্বশেষে যা করতে বলেছেন তা হলো আমাদের জন্য উন্নততর আদর্শ ও মান এটি হলো একটা ধারণা। আর রাসূল (স) সর্বশেষে যা করতে বলেছেন আমাদের জন্য সেটি একমাত্র করণীয় এটি হলো সম্পূর্ণ পৃথক একটি ধারণা। এ দুটা কথার ইমপ্লিক্যশানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।

সাহাবীরা মনে করতেন যে, ঘুমিয়ে গেলে রোজা কায়েম হয়ে যায়। তৎসত্ত্বেও মানবীয় প্রবৃত্তির কারণে তাঁরা স্ত্রীদের সাথে সম্পর্ক করতেন। এরপর তাঁরা অপরাধ প্রবণতায় ভুগতেন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা কোরআনের আয়াত নাযিল করে জানালেন যে, ফজর পর্যন্ত তাঁদের জন্য অবকাশ আছে। এ ধরনের ভুল বুঝাবুঝি এখনও ব্যাপকভাবে হচ্ছে। কোনো বিষয়ে মনে করা হচ্ছে, ফাইনালি যা করতে বলা হয়েছে সেটিই আমাদের একমাত্র করণীয়। কিন্তু সেটি বাস্তবে করা সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে কি করা যায়? আমাদের এখন কি হবে? এহেন জটিল পরিস্থিতিতে সব অদ্ভূদ সমন্বয়, সোজা কথায় গোঁজামিলগুলো দেয়া হয়, বিভিন্ন রকমের প্রান্তিকতা গড়ে উঠে। নমনীয়তার প্রান্তিকতা ও কঠোরতার প্রান্তিকতা। কোনো কোনো বুনিয়াদী বিষয়ে [যেমন শাসন-কর্তৃত্ব সম্পর্কিত] নমনীয়তা ও আপসকামীতার নীতি অবলম্বন করা হয়। অথচ কোনো কোনো অ-বুনিয়াদী বিষয়ে [যেমন পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি] পূর্ণতার দাবি ও কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। এসবই অনাকাংখিত প্রান্তিকতার লক্ষণ।

এই তালগোলে ব্যাপারের পুরোটাই ঘটছে conceptual ambiguity and inconsistency-র কারণে। যদি মনে করা হয় যে আজকের দিনের মধ্যে আমাদেরকে ১০০ মাইল হেঁটে যেতে হবে যা আদৌ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তখন আমরা কি করব? হতাশ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে হয়তবা ৫-১০ মাইল হেঁটে বসে পড়বো নতুবা হতাশ হয়ে বসে থাকবো অথবা ভিন্ন কোনো সহজ পথে হাঁটার চেষ্টা করবো। যদি মনে করা হয় যে, এই ১০০ মাইল আমাদের সর্বমোট দূরুত্ব যাতে এই ১০টা মনযিল রয়েছে তাহলে প্রত্যেক যাত্রী সর্বোচ্চ গতিতে অগ্রসর হবে। ধারণা করা যায় যে, সবাই যার যার মতো করে কোনো এক সময় গন্তব্যে পৌঁছবে। এক একটা ব্যক্তির এক এক অবস্থা, এক একটা সমাজের এক এক অবস্থা, এক একটা এলাকার এক এক অবস্থা। বিশ্ব-আদর্শ হিসেবে ইসলাম, মোর স্পেসিফিক্যালি ইসলামী শরীয়াহ এক এক দেশে এক এক ভাবে প্রাধান্য ও প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার এই ক্রমধারা ও বৈচিত্র্যকে নির্ধারণ করতে হবে, বুঝতে ও বোঝাতে হবে, বাস্তবসম্মতভাবে জনসমাজকে আশ্বস্থ করতে হবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠা বিদ্যমান ধর্মীয় কাঠামোর সাথে এটি বিরোধপূর্ণ হওয়ায় বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে হবে।

যদি মনে করা হয় যে রসূল (স) চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদের যেটা আদেশ দিয়েছেন সেটা থেকে তৎপূর্ববর্তী কোনো স্তরে back করার সুযোগ আমাদের নাই তাহলে হযরত আয়েশা (রা)-এর মদ সংক্রান্ত প্রসিদ্ধ হাদীসটির কথা বলতে হয়। তিনি বলেছেন, ‘প্রথম অবতীর্ণ আয়াতেই যদি বলা হতো যে, তোমরা মদ পান করোনা, তাহলে তাঁরা অবশ্যই বলতো যে, আমরা কখনোই মদ্যপান ত্যাগ করবো না।’ – বুখারী, হাদীস নং ৪৭০৭।

আমরা জানি, মোট ৪ ধাপে মদ নিষিদ্ধ করা হয়। সাহাবীদের জন্য যদি ক্রমধারা দরকারী হয়, অন্যদের জন্য তা হবে না কেন? ব্যক্তি গঠনের জন্য ক্রমধারাকে অনুমোদন করা হলে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য সেটি কার্যকর হবে না কেন? অর্গানিক থিওরি অনুসারে ব্যক্তি বিশেষের মত সমাজেরও একটা স্বতন্ত্র সত্ত্বা রয়েছে। তাই না?

সূরা আল আলে ইমরানের ৭নং আয়াত অনুসারে কোরআনের আয়াতসমূহ দুই ধরনের: দ্ব্যর্থহীন ও দ্ব্যর্থবোধক আয়াত। হিদায়াতের জন্য দ্ব্যর্থহীন আয়াতসমূহই যথেষ্ট। সুস্পষ্ট আয়াতগুলোর মধ্যকার বিরোধ নিরসনে প্রচলিত পদ্ধতি হলো নাসেক্ব ও মানসুক্বের ধারণা। এই পদ্ধতি বা ধারণা একদিক থেকে সঠিক আবার অন্যদিক থেকে ভুল। সমাজ গঠনের ধাপ নির্ণয়ে আমাদেরকে অবশ্যই নাযিলের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করতে হবে। কোনো অগ্রসর সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা অতিক্রম করে আসা কোনো প্রাথমিক স্তরের বিধি-বিধানকে অনুমোদন করতে পারি না। সংশ্লিষ্ট সমাজ বা রাষ্ট্র যদি তৃতীয় স্তরে থাকে সেখানে দ্বিতীয় স্তরের বিষয়াদি কার্যকর থাকার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু যে সমাজ বা রাষ্ট্র বা জনপদ এখনো প্রাথমিক স্তর হতে উত্তরণ লাভ করতে পারে নাই সেখানে নাসেক্ব-মানসুক্বের কথা বলে অ-প্রযোজ্য উচ্চতর বা সর্বো্চ্চ ধাপ বাস্তবায়নের চেষ্টা করা ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়ে দেওয়ার মতো পণ্ডশ্রম নয় কি?

আমাদের এখানকার ইসলামী সংগঠনগুলো populist! তাঁরা মনে করেন, যদি এই এই বিষয়ে অপ্রচলিত কিন্তু সত্য কথাগুলো প্রকাশ্যে বলা হয় তাহলে মানুষ ভুল বুঝবে। অতএব সত্য কথা বলা যাবেনা! হক এবং হেকমতের মধ্যে যদি সামঞ্জস্যবিধান করা না যায় তাহলে বাস্তবে গিয়ে সব বরবাদ হয়ে যাবে। হকের দিক থেকে হবে একধরনের বরবাদী আর হেকমতের দিক থেকে হবে অন্যধরনের বরবাদী। হক হওয়া আর হক কায়েম হওয়া বা করা- এক জিনিস নয়। আল্লাহর রাসূল (স) জানতেন যে এরা মুনাফিক। তৎসত্ত্বেও তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেননি। আল্লাহ তাআলা জানেন যে তিনি কি কি বিষয় আরোপ করবেন, কি কি বিষয়কে নিষিদ্ধ করবেন। মানুষের মননশীলতায় ও বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্যতা (receptiveness) সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত কি করা হবে তা তিনি প্রকাশ (নাযিল) করেননি।

হেকমত অবলম্বন না করার পরিণতি হলো চরমপন্থা অবলম্বন করা। ফিতনাকে জিহাদ মনে করা! সবসময়ে হেকমতকে প্রাধান্য দেয়া হলো হীন আপসকামীতা যাকে আমরা apologetic trend বলে থাকি। কোন কোনো শুভাকাঙ্খী আমাকে বলেছেন, আপনি যে কাজ করছেন তাতে ইসলাম এই নাম নেয়ার দরকার কি? যেমন Center for Social & Cultural Studies (CSCS) এর নামে যা কিছু করা হয়েছে তা সবই ইসলাম-এর পক্ষে গেছে। ফোরামের নামের সাথে ইসলামনা লাগানোতে কোনো সমস্যা হয়েছি কি? কথিত এই ক্যাপসুল ফর্মূলাঅনুসরণ করে আমরা অনেক কিছু করতে পারি বটে কিন্তু আমরা যে মুসলিম, ইসলাম যে আমাদের জীবনাদর্শ, অপরাপর জীবনাদর্শগুলোকে যে আমরা বাতিল মনে করি- একে কি আমরা শেষ পর্যন্ত hide করতে পারি? অতি-হেকমতের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, মূল বিষয় [the basic claim] টাকেই negotiate করে ফেলা! রাসূল (স) এ ধরনের কোনো negotiate করেননি বলে তাঁকে জন্মভূমি ছেড়ে হিজরত করতে হয়েছিল!

হক্ব ও হেকমতের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। কিভাবে এটি সম্ভব? আমাদের প্রত্যেকের বিবেক আছে। Our conscience will say that. আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ফাআলহামা-হা ফুজু-রাহা ওয়া তাক্বওয়াহা।

লেখকঃ মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক
সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পরিচালক, সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র

ইসলাম ও রাষ্ট্র


ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বকে নিয়ে ইসলাম একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা। তবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাভাবিক পার্থক্য রক্ষা করা হয়েছে ইসলামে। রাষ্ট্রব্যবস্থাসহ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া সকল দেশের সকল সমাজের মানুষের জন্য পালনীয় প্রশস্ততা ইসলামে রয়েছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মুমিনের ধর্ম পালনের জন্য শর্ত বা মূল বিষয় বলে গণ্য করা হয়নি। রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইসলামের একটি অংশ। ইসলামে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান আছে। তবে ইসলাম শুধু রাষ্ট্র ব্যবস্থার নাম নয়।

ইসলামের আরাকান এবং অন্যান্য ফরজ ও নফল ইবাদত সাধ্যমত পালনের মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি নিজের জীবনে পরিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্ঠা করবেন। কোনো মুসলিম রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্বে থাকলে তিনি তার দায়িত্ব আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে পালন করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। এক্ষেত্রে তার নিজ জীবনের অন্যান্য কর্মের মতো রাষ্ট্রীয় কর্ম আল্লাহর হুকুম মতো পালন করা তার দায়িত্ব। অন্যান্য মুসলিমের দায়িত্ব রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি বা পরিবারের সকল ক্ষেত্রে সবাইকে আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্য দাওয়াত দেওয়া। যে কোনো ক্ষেত্রে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের (সা) নির্দেশ লঙ্ঘিত হলে সুযোগ ও সাধ্যমত কোরআন নির্দেশিত উত্তম আচরণ দ্বারা খারাপ আচরণের প্রতিরোধ পদ্ধতিতে দাওয়াত, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের মাধ্যমে তা সংশোধন ও পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন। তবে এ চেষ্টা সফল না হলে মুমিনের দ্বীন পালন ব্যাহত হবে কিংবা সমাজ ও রাষ্ট্রের পাপের কারণে ব্যক্তি মুমিন পাপী হবেনএরূপ চিন্তার কোনো ভিত্তি নেই।

ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি

ইসলাম সর্বকালের ও সর্বযুগের সমগ্র মানব জাতির জন্য স্থায়ী জীবন ব্যবস্থা এবং বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন ধর্ম। কোরআনে কারীম, হাদীসে রাসূল (সা) ও সাহাবীগণের জীবন পদ্ধতি থেকে আমরা দেখতে পাই, এতে দুটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে: (১) যুগ, সমাজ, সামাজিক রুচি ও আচার আচরণের পরিবর্তনের ফলে ইসলামের ধর্মীয় রূপে যেন পরিবর্তন না আসে। (২) যুগ, সমাজ, আচার-আচরণ ইত্যাদির পরিবর্তনের কারণে ইসলামের আহকাম পালনে যেন কারো কোনো অসুবিধা না হয়। সকল যুগের সকল দেশের মানুষেরা যেন সহজেই জীবনধর্ম ইসলাম পালন করতে পারে।

এ মূলনীতির ভিত্তিতে ইসলামে মানবজীবনের কর্মকাণ্ডকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে: (১) ইবাদত ও (২) মুয়ামালাত। মানুষকে জীবন ধারণ করতে জাগতিক ও জৈবিক প্রয়োজনে যা করতে হয় এবং বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী ও ধার্মিক-অধার্মিক সকলেই যা করেন তা মুয়ামালাত বা জাগতিক কর্ম বলে গণ্য। আর জাগতিক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে শুধু মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টির জন্য মানুষ যে কর্ম করে তা ইবাদত বলে গণ্য।

ইবাদত ও মুয়ামালাতের পার্থক্য নিয়ে বিস্তারিত জানতে আমার লেখা এহইয়াউস সুনানগ্রন্থটি পাঠ করতে পাঠককে অনুরোধ করছি। এখানে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়ইবাদতের ক্ষেত্রে ইসলামে বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি নিয়ম-পদ্ধতি ও বিধিবিধান প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) যে কর্ম যেভাবে করেছেন, অবিকল সেভাবে করার বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে মুয়ামালাত বা জাগতিক কর্মের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রশস্ততা দেওয়া হয়েছে। কিছু মূলনীতি প্রদান করা হয়েছে এবং ফরজ ও হারাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে সবই বৈধ বলে গণ্য হবে। মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে রাসূলূল্লাহ (সা) থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তা বৈধ বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ ইবাদতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) যা করেননি তা করা নিষিদ্ধ। আর মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা) যা নিষেধ করেছেন শুধু তাই নিষিদ্ধ, যা তিনি নিষেধ করেননি তা বৈধ।

চাষাবাদ, চিকিৎসা, বাড়িঘর তৈরি ইত্যাদি জাগতিক বিষয়ে যেমন প্রশস্ততা প্রদান করা হয়েছে, তেমনি প্রশস্ততা প্রদান করা হয়েছে ইবাদত পালনের জাগতিক উপকরণের ক্ষেত্রে। যেমন ইলম শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তবে শিক্ষার পদ্ধতি, উপকরণ ইত্যাদির বিষয় উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কেই বলতে পারেন না যে, সাহাবীদের যুগে ছাপানো বই, পরীক্ষা পদ্ধতি বা সনদ প্রদানের পদ্ধতি ছিল না, কাজেই এখন তা নিষিদ্ধ। বরং যতক্ষণ না শরীয়তে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যাবে ততক্ষণ তা বৈধ।

বিবাহ, পরিবার গঠন, আবাসন, চিকিৎসা ইত্যাদির মতো রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্র পরিচালনা ও এ বিষয়ক দায়িত্বাবলি মুয়ামালাত। এজন্য এ বিষয়ে ইসলামের মৌলিক নীতিমালার মধ্যে প্রশস্ততা প্রদান করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর খুঁটিনাটি বিষয়ে দেশ, যুগ, জাতি ও পরিবেশের আলোকে ভিন্নতার অবকাশ রাখা হয়েছে।

এ সকল মূলনীতির আলোকে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রকৃতি আলোচনার জন্য পৃথক গ্রন্থের প্রয়োজন। এখানে সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্র থিওক্র্যাটিকবা পুরোহিততান্ত্রিক নয়, বরং জনগণতান্ত্রিক। এখানে মোল্লা, পুরোহিত, ইমাম বা অন্য কোনো ধর্মীয় নেতাকে আল্লাহর নামেবা আল্লাহর খলীফাহয়ে শাসন করার ক্ষমতা বা সুযোগ দেওয়া হয়নি। ইসলামে কখনোই শাসককে আল্লাহর খলীফাহিসেবে গণ্য করা হয়নি, তাকে বিশেষ অধিকার, ক্ষমতা বা অভ্রান্ততা প্রদান করা হয়নি বা তাকে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে রাখা হয়নি। বরং শাসককে জনগণের প্রতিনিধি ও জনগণের কাছে জবাবদিহিতা রয়েছে বলে গণ্য করা হয়েছে।

কেবলমাত্র শিয়াসম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাসে ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রাজতান্ত্রিক ও পুরোহিততান্ত্রিক বলে দাবি করা হয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন, ইসলামের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব বা রাষ্ট্রক্ষমতা আলীর (রা) বংশধরদের পাওনা। আর রাষ্ট্রীয় নেতাবা ইমাম আল্লাহর খলীফা হিসেবে বিশেষ জ্ঞান, ক্ষমতা ও অধিকার সংরক্ষণ করেন। রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তাঁর মতামতই চূড়ান্ত। তাঁর অনুপস্থিতি বা অদৃশ্য থাকা অবস্থায় ফকীহতাঁর প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। কোরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে সাহাবীগণ ও পরবর্তী মূলধারার মুসলিম আলিমগণ এ মত প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বস্তুত রাসূলুল্লাহর (সা) আগমনের সময়ে পৃথিবীতে বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলির মধ্যে তিনটি মূল বিষয় দেখা যায়:

প্রথমত: রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস বংশ বা জবরদখল

রাজবংশের কেউ রাজা হবে এটাই ছিল সর্বজন স্বীকৃত রীতি। রাজতন্ত্রের বাইরে ক্ষমতা গ্রহণের একমাত্র উৎস ছিল অস্ত্র বা জবরদখল। রাজাকে হত্যা করে বা অস্ত্রের ক্ষমতায় রাজদণ্ড গ্রহণ করা।

দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রের মালিকানা বা সার্বভৌমত্ব রাজার

রাজ্যের সকল সম্পদ ও নাগরিক রাজার মালিকানাধীন। তিনি সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রের সম্পদ ও নাগরিকদের বিষয়ে তিনি ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন এবং তার সিদ্ধান্ত প্রশ্নাতীত।

এরূপ সর্বোচ্চ ক্ষমতা বুঝাতে ইংরেজিতে sovereignty শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শব্দটি প্রাচীন ফরাসী souverain, ল্যাটিন superanus/super শব্দ থেকে এসেছে। এর মূল অর্থ above বা ঊর্ধ্বে। যেহেতু রাজার ক্ষমতা সকলের ঊর্ধ্বে সেহেতু রাজাকে ইংরেজিতে sovereign বলা হয়। ইংরেজিতে sovereign অর্থই king বা রাজা। আরবি অভিধানেও sovereign অর্থ ملك (মালিক তথা রাজা)। আর sovereignty শব্দের অর্থ বাংলায় রাজত্ব এবং আরবিতে الملك (মুলক) বা السيادة (সিয়াদাত), অর্থাৎ রাজত্ব বা কর্তৃত্ব।

বাংলায় এর প্রতিশব্দ হিসেবে সার্বভৌমত্বশব্দটি ব্যবহার করা হয়। বাংলা এ শব্দটি সর্বভূমিথেকে গৃহীত। এর অর্থ বিশ্বজনীনবা universal হওয়া উচিত। ইংরেজি sovereign বা সবোর্চ্চ শব্দের মূল অর্থের সাথে বাংলা সর্বভূমি বা বিশ্বজনীন শব্দের মূল অর্থের মিল নেই। তবে প্রাচীন যুগে সারা বিশ্বে পরিচিতঅর্থে শাসক বা বড় পণ্ডিতকে সার্বভৌমউপাধি দেওয়া হতো। এভাবে রাজাকে সার্বভৌমবলার প্রচলন ঘটে। আর এ থেকেই রাজত্বকে সার্বভৌমত্ব বলা হয়।

তৃতীয়ত: রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি বা প্রতিভূ

প্রায় সকল সমাজেই রাজাকে কোনো না কোনোভাবে ঈশ্বরের পুত্র, প্রতিনিধি বা বংশধর বলে কল্পনা করে তাকে ঐশ্বরিক বা ধর্মীয় পবিত্রতা, অধিকার ও অভ্রান্ততা (infallibility) প্রদান করা হয়েছে। বিশেষত খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের শুরুতে বাইজেন্টাইন-রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা প্রদানের পর থেকে ইউরোপে থিওক্র্যাটিক শাসনের শুরু হয় এবং ধর্মের নামে বা আল্লাহর নামে শাসক ও পুরোহিতদেরকে আল্লাহর প্রতিনিধি ও প্রতিভূ হিসেবে বিশেষ পবিত্রতা প্রদান করা হয়। তাদের নির্দেশ আক্ষরিক অর্থে পালন করা ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তাদের নির্দেশ অমান্য করা ধর্মদ্রোহিতা বলে গণ্য হয়।

অন্যদিকে, রাসূলুল্লাহ (সা) রাষ্ট্রের বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন মূলনীতি প্রদান করেছেন। তাঁর দেওয়া মূলনীতির প্রধান দিকগুলো নিম্নরূপ:

প্রথমত: রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস হলো নাগরিকদের পরামর্শ

কোরআন কারীমে এবং হাদীস শরীফে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশ মুমিনকে দেওয়া হয়েছে। এ মূলনীতি হাতে-কলমে শেখানোর জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর পরে কাউকে রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য মনোনয়ন দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। যেন মুসলমানগণ পরামর্শ ব্যবস্থার বাস্তব প্রয়োগ করতে পারেন।

মুমিনদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِرَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَمْرُهُمْ شُورَىٰ بَيْنَهُمْ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ

যারা তাদের প্রতিপালকের আহবানে সাড়া দিয়েছে, নামাজ কায়েম করেছে, তাদের কর্ম তাদের মধ্যে পারস্পরিক পরামর্শভিত্তিক এবং তাদেরকে যা রিজিক প্রদান করেছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।”[1]

তাহলে, মুমিনদের সকল কর্ম হবে তাদের সকলের পরামর্শভিত্তিক। যে বিষয়ে আল্লাহর সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই, এরূপ যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলের পরামর্শ গ্রহণই মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি হলো এ জাতীয় বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। কারণ, এটি সকল নাগরিকের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট। শাসক, প্রশাসক, সরকার বা জনপ্রতিনিধি নির্বাচন, নির্বাচনের মেয়াদ, সরকার পরিচালনা পদ্ধতি, এ বিষয়ক নীতি নির্ধারণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হলো সংশ্লিষ্ট সকলেই পরামর্শ প্রদান করবেন। নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাধারণ-অসাধারণ সকলের পরামর্শ গ্রহণ এ নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত। কাউকে বাদ দেওয়ার কোনোরূপ নির্দেশনা নেই। যদি কেউ পরামর্শ দেন ও অন্যরা মেনে নেন তাহলেও অসুবিধা নেই।

কোরআন-হাদীসে সংশ্লিষ্ট সকলের পরামর্শ গ্রহণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে, তবে পরামর্শ গ্রহণের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। বরং অন্যান্য জাগতিক ও উপকরণ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির মতো এ বিষয়টিকে যুগ, জাতি ও পরিবেশের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মানুষদের অবস্থা অনুসারে সরাসরি সকল নাগরিকের, তাদের প্রতিনিধিদের, গোত্রপতিদের, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের বা সামাজিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে পরামর্শ গ্রহণ করা যেতে পারে। এরূপ পরামর্শ গ্রহণ মৌখিক হতে পারে বা গোপন ব্যালটে হতে পারে। এক্ষেত্রে পরামর্শ গ্রহণের কোনো একটি পদ্ধতিকে ইসলামী বা ইসলাম বিরোধী বলে গণ্য করার কোনো সুযোগ নেই।

সাহাবীগণ যুগ বা পরবর্তী যুগে ছিল না বলে কিংবা প্রাচীন ফিকাহ গ্রন্থে লেখা নেই বলে সার্বজনীন ভোট ব্যবস্থা, ৪/৫ বছর পর পর ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা বা পরামর্শ গ্রহণের অনুরূপ কোনো পদ্ধতিকে ইসলাম বিরোধী বলে চিন্তা করা আর মাদ্রাসার পরীক্ষা ব্যবস্থা, সনদ প্রদানের ব্যবস্থা, ছাপানো বই পড়ার ব্যবস্থা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যবহারকে ইসলাম বিরোধী বা নিষিদ্ধ বলে চিন্তা করা একই ধরনের অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি।

দ্বিতীয়ত: রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের

মালিকানা দুই প্রকার। (১) সকল কিছুর প্রকৃত মালিকানা মহান আল্লাহর। তিনিই মালিক, রাজা বা sovereign। (২) পাশাপাশি জাগতিকভাবে মানুষকে দুনিয়াতে তার সম্পদের মালিকানা প্রদান করা হয়েছে এবং মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের।

আমরা দেখেছি, প্রাচীন ব্যবস্থায় রাজা ছিলেন sovereign বা সার্বভৌম। রাজ্যের সকল সম্পদ ও নাগরিকের সর্বোচ্চ বা প্রশ্নাতীত মালিকানা (sovereignty) ছিল তার একার। তিনি নিজের প্রয়োজন, সুবিধা ও ইচ্ছামতো তা ব্যবহার করবেন, এতে কারো কোনো আপত্তি বা প্রশ্ন করার অধিকার ছিল না। পক্ষান্তরে ইসলামে রাষ্ট্রের মালিকানা নাগরিকদের। একজন মুমিন নিজের মালিকানাধীন জমিন যেমন আল্লাহর নির্দেশের আওতায় নিজের প্রয়োজন, সুবিধা ও ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারেন, তেমনি রাষ্ট্রের জনগণ রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ও সম্পদ আল্লাহর নির্দেশের আওতায় থেকে নিজেদের প্রয়োজন ও সুবিধা অনুসারে ব্যবহার করবেন।

নিজের মালিকানাধীন সম্পদ, অর্থ ও অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় রাষ্ট্রের বিষয়াবলিও আল্লাহর নির্দেশ মতো পরিচালনার করার বিষয়ে জনগণ দায়বদ্ধ। এ দায় পালনের জন্য শাসক হলেন জনগণের প্রতিনিধি। শাসক রাষ্ট্রের মালিক নন, বরং জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তাই তিনি জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। জনগণ তাকে যে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে, শাসন ও সংশোধন করতে পারে।

এজন্যই শাসক বা সরকার নির্বাচনে জনগণের পরামর্শ গ্রহণের নির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মধ্য থেকে তাদের পরামর্শে সরকার নির্বাচিত হবে। আর তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।

তৃতীয়ত: শাসকের কোনো অভ্রান্ততা বা পবিত্রতা নেই

ইসলামের দৃষ্টিতে শাসক কখনোই আল্লাহর খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত (successor/vicar) নন। অন্য সকল মানুষের মতোই তিনি আল্লাহর বিধান ও ব্যবস্থার অধীন। মহান আল্লাহ রাষ্ট্র পরিচালনা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যে মূলনীতি প্রদান করেছেন তা পালন করতে তিনি বাধ্য।

রাষ্ট্রপরিচালনা বিষয়ে ইসলাম কিছু মূলনীতি দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মৌলিক নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করা; জীবন, জীবিকা, ধর্ম, বাসস্থান ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; জনগণের পরামর্শ গ্রহণ করা, বৈষম্যহীন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, অপরাধীর সঠিক শাস্তি নিশ্চিত করা ইত্যাদি। বিচার ও শাস্তির ক্ষেত্রে ইসলামে কিছু শাস্তি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যেগুলো সমাজের অপরাধ দমন করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করে। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে শাসক, সরকার বা প্রশাসন প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী শাস্তির ব্যবস্থা করবেন।

এ সকল মূলনীতি ও বিধিবিধানের প্রয়োগ এবং ইসলামের নির্দেশনার ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে শাসকের নিজস্ব কোনো পবিত্রতা বা অভ্রান্ততা নেই। জনগণকে শাসন করা, নির্দেশ দেওয়া বা আল্লাহর বিধানের ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে তাঁর নিজের মতের কোনো বিশেষ মূল্য নেই। তার ব্যাখ্যা বা সিদ্ধান্ত ভুল বলে মনে হলে যে কেউ তার সমালোচনা এবং ভুল সংশোধন করতে পারেন।

অন্যান্য মুয়ামালাতের ন্যায় রাষ্ট্রনীতি ও আইন-বিচারের ক্ষেত্রে ইসলামে মূলনীতি দেওয়া হয়েছে এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রশস্ততা প্রদান করা হয়েছে। কয়েকটি অপরাধের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু শাস্তি প্রদানের প্রক্রিয়া কঠিন করা হয়েছে। নীতি, বিধান ইত্যাদির ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের ব্যাপারে কাউকে অভ্রান্ততা দেওয়া হয়নি। এজন্য মুসলিম দেশগুলোতে কখনোই ইউরোপের মতো স্বৈরাচার বা থিওক্র্যাসি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় আলেমগণ কখনো ধর্মের নামে ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। আলেমগণ কোরআন-হাদীসের নীতিমালা ব্যাখ্যা করেছেন, আর শাসকগণ তা প্রয়োগ করেছেন। উভয় বিভাগেরই স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা ছিল। ব্যাখ্যায় ভুল হয়েছে বলে মনে হলে শাসকগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সকল আলেমের পরামর্শ নিয়েছেন। অন্যদিকে, প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে ভুল হয়েছে মনে করলে জনগণ ও আলেমগণ প্রতিবাদ করেছেন। সকল স্বৈরাচারী শাসনের মধ্যেও শাসকের সমালোচনা, কমবেশি বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, গবেষণা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত ছিল। কখনোই কোনো মুসলিম রাষ্ট্রে ধর্মের নামে ভিন্নমতাবলম্বী বা ভিন্নধর্মীর উপর নিয়মতান্ত্রিক বা রাষ্ট্রীয় নির্যাতন করা হয়নি। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতক থেকে অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত ইউরোপ, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের যে কোনো অমুসলিম দেশের সাথে সে যুগের মুসলিম দেশগুলোর অবস্থা তুলনা করলে যে কোনো গবেষক নিশ্চিত হবেন যে, মুসলিম দেশগুলোতে সকল ধর্মের মানুষ সর্বোচ্চ নাগরিক অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করেছেন।

ইসলাম ও তন্ত্র

তন্ত্রবা  cracy একটি আধুনিক পরিভাষা। বাংলায় তন্ত্রশব্দটির অনেক অর্থ রয়েছে। যেমনশাস্ত্র, বিদ্যা, প্রাধান্য, রাজ্যশাসন পদ্ধতি ইত্যাদি। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য হলো রাজ্যশাসন পদ্ধতি’, যা ইংরেজি cracy শব্দের অনুবাদ হিসেবে ব্যবহৃত। ইংরেজি cracy শব্দটি গ্রীক Kratos শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ power, strength, rule (ক্ষমতা, শক্তি, শাসন) ইত্যাদি।

বিশ্বের অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন রাজ্যশাসন পদ্ধতিপর্যালোচনা করলে আমরা বলতে পারি, রাজ্যশাসন পদ্ধতি মূলত দুই প্রকারের হতে পারে:

(১) জনগণের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে

(২) শাসকের একচ্ছত্র ক্ষমতার ভিত্তিতে।

দ্বিতীয় পদ্ধতিতে অর্থাৎ শাসকের একচ্ছত্র অধিকার ও ক্ষমতার উৎস হতে পারে তার বংশ বা দখল কিংবা ঐশ্বরিক। শাসক নিজের বংশ বা দখলের অধিকারে রাষ্ট্রের সকল কিছুর মালিকানা দাবি করবেন, অথবা নিজেকে ঈশ্বরেরপ্রতিনিধি হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করবেন।

আধুনিক পরিভাষায় রাজ্যশাসনেরপ্রথম পদ্ধতিটি গণতন্ত্র’ (Democracy) এবং দ্বিতীয় পদ্ধতিটি স্বৈরতন্ত্র’ (Autocracy) নামে পরিচিত। আর যদি শাসক বা শাসকগোষ্ঠী তাদের ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব বা ধর্মীয় অভ্রান্ততা দাবি করেন তাহলে তা পুরোহিততন্ত্রবা যাজকতন্ত্র’ (Theocracy) নামে পরিচিত। এখন প্রশ্ন হলো, উপরে আলোচিত ইসলামের রাজ্যশাসন পদ্ধতিকে আমরা কোন প্রকারের বলে গণ্য করব?

আমরা অনেক সময় বলি, ইসলাম ইসলামই, একে কোনো তন্ত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কথাটির মধ্যে সত্যতা রয়েছে। তবে যে ব্যক্তি ইসলামকে ভালোভাবে জানেন না, তাকে ইসলামের বিষয় বুঝাতে হলে তাঁর ভাষায় বা পরিভাষায় অনুবাদ করেই তাঁকে বুঝাতে হবে। এছাড়া ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ধর্ম, যার মধ্যে বিশ্বাস, কর্ম, আচার-আচরণ, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামবললে এই সবকিছুর সমষ্টি বুঝায়। রাজ্যশাসন পদ্ধতি বিষয়ে ইসলামের দিক নির্দেশনার সমষ্টিকে আমরা সহজবোধ্যভাবে কী বলতে পারি? ইসলামের রাজ্যশাসন পদ্ধতি কি গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, নাকি পুরোহিততন্ত্র? কোনোটিই যদি না হয়, তাহলে এগুলোর কোনটির অন্তত সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী?

উপরের আলোচনা থেকে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি, ইসলামের রাজ্যশাসন পদ্ধতি গণতান্ত্রিক। কিন্তু ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে পাশ্চাত্য গবেষকগণ একে Theocracy বলে উল্লেখ করেছেন। Theocracy শব্দটি গ্রীক (theokratia) থেকে আগত। এর অর্থ government by a god বা একজন দেবতার সরকার। এ ব্যবস্থায় দেবতা, ঈশ্বর বা মহান স্রষ্টাকে একচ্ছত্র ক্ষমতা ও সবোর্চ্চ মালিকানার অধিকারী (sole sovereign) এবং সকল আইনকে ঈশ্বরের নির্দেশ বলে গণ্য করা হয়। স্বভাবতই দেবতা বা ঈশ্বর নিজে শাসন করেন না। কাজেই ঈশ্বরের নামে পুরোহিতগণ বা রাজাই শাসন পরিচালনা করেন। তবে তারা নিজেদেরকে ঈশ্বরের প্রতিনিধিবলে দাবি করেন এবং তাদের আদেশ-নিষেধকে অলঙ্ঘনীয় ঐশ্বরিক নির্দেশ বলে গণ্য করেন।

ইসলামে আল্লাহকে সর্বোচ্চ মালিকানার অধিকারী (sovereign) বলে বিশ্বাস করা হয়। তিনিই হুকুম, নিদের্শ বা বিধান প্রদানের অধিকারী। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, ইসলামী শাসনব্যবস্থা থিওক্র্যাটিক। থিওক্র্যাসির সাথে ইসলামের মৌলিক পার্থক্য হলো, থিওক্র্যাসিতে রাজা বা পুরোহিতগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তারা ধর্মের নামে বা ঈশ্বরের নামে যে ব্যাখ্যা, আইন বা বিধান প্রদান করবেন তা মান্য করা জনগণের ধর্মীয় দায়িত্বএবং অমান্য করা ধর্মদ্রোহিতা। থিওক্র্যাসি হলো ঈশ্বর বা ধর্মের নামে পরিচালিত স্বৈরতন্ত্র।

থিওক্র্যাসির মূল প্রেরণা বর্ণনা করে রাজা প্রথম জেমস (১৫৬৬-১৬২৫) বলেন, “The state of monarchy is the supreme-st thing upon earth: for kings are not only god’s lieutenants upon earth, and sit upon God’s throne, but even by God himself they are called gods.” অর্থাৎ, “রাজার অবস্থানই পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। কারণ, রাজাগণ পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি এবং ঈশ্বরের সিংহাসনে আসীন। শুধু তাই নয়, স্বয়ং ঈশ্বর তাদেরকে ঈশ্বর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।” (মাইক্রোসফট এনকার্টা)

পক্ষান্তরে ইসলামে আল্লাহর নির্দেশ, হুকুম বা বিধান সকল মানুষের জন্য উন্মুক্তভাবে প্রদান করা হয়েছে। রাজ্যশাসনবিষয়েও আল্লাহ মূলনীতি প্রদান করেছেন। এগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। এর প্রয়োগে, ব্যাখ্যা বা আইন প্রণয়নে রাজা বা যাজকগণের কোনোরূপ বিশেষত্ব নেই। বরং রাজ্যশাসন বিষয়ক ইসলামের নীতিমালা লিখিত সংবিধানেরমতোই স্বৈরতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের অধিকার রক্ষার অন্যতম মাধ্যম।

গণতন্ত্রের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখব, গণতন্ত্র নির্ধারিত কোনো সরকার ব্যবস্থা নয়। রাজ্যশাসন ব্যবস্থায় যে কোনোভাবে জনগণের অংশীদারিত্ব, পরামর্শ গ্রহণ ও জনগণের নিকট জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকলেই তাকে গণতন্ত্রবলা যায়। এ অর্থে মূলত ইসলামই সর্বপ্রথম একটি গণতান্ত্রিকরাষ্ট্রব্যবস্থা প্রদান করেছে। ইসলামের আগে গ্রীস ও রোমে গণতন্ত্রের কিছু চর্চা হয়েছিল। এরপর তা বিলীন হয়ে যায় এবং বিশ্বের সর্বত্র রাজতান্ত্রিক বা যাজকতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। রাসূলু্ল্লাহ (সা) সর্বপ্রথম পরামর্শভিত্তিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিকব্যবস্থা প্রদান করেন।

জনগণতান্ত্রিক এ নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন তৎকালীন প্রেক্ষাপটে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে খিলাফতে রাশেদার পর থেকেই কমবেশি বিচ্যুতি শুরু হয়। তারপরেও ইসলামের ইতিহাসের যে কোনো যুগের স্বৈরাচারী শাসকদের সাথে তৎকালীন ইউরোপের চার্চ ও খৃস্টান শাসকদের তুলনা করলে যে কোনো গবেষক নিশ্চিত হবেন, ইসলামের এ মূলনীতির প্রভাব সর্বদা বিদ্যমান ছিল।

রেফারেন্স সূরাঃ (৪২) শূরা: আয়াত ৩৮।

সূত্রঃ ইসলামের নামে জঙ্গীবাদ- ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...