Wednesday, April 8, 2020

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব
তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা
যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে
ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হতে পারে
অথবা কাজের সুযোগ কমে যাওয়ার কারণে হতে পারে
অথবা চাকরি থেকে অব্যহতির কারণে হতে পারে
আর এখন থেকেই সামর্থ্যবানদের উচিত
তাদের খরচ বহন করা
আমি এটাকে সদকা বলবো না, বরং নিজ ভাইয়ের জন্য খরচ করা বলবো
কেননা আমরা সবাই ভাই ভাই
এবং একে অন্যের দায়িত্বশীল
সামর্থ্যবানরা যাতে এই হুকুমকে নিজেদের ইচ্ছাধীন মনে না করে
যে সে মন চাইলেই নিজ অভাবগ্রস্থ ভাইয়ের খরচ বহন করলো
আর মন না চাইলেই কিছু না করে বসে থাকলো
এই মুহূর্তে প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য
নিজ ক্ষতিগ্রস্থ ভাইদের জন্য খরচ বহন করা
অতি আবশ্যকীয় একটি ফরজ

সামর্থ্যবানদের প্রতি শায়খুল আযহারের আহ্বান

Tuesday, March 17, 2020

হিজরতপূর্ব ও পরবর্তী মদিনাঃ একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা

হিজরতের পর মদিনায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবর্তন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সামাজিক অবকাঠামো কেন্দ্রিক আলোচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তবে এ আলোচনা শুরু করার আগে হিজরতপূর্ব মদিনা বাসিন্দা কারা ছিল এ প্রশ্নের উত্তর খোজা জরুরী।

হিজরতের আগে মদিনা কাদের বাসভূমি ছিল, এ নিয়ে আধুনিক ইতিহাসবিদদের মাঝে মতবিরোধ দেখা যায়। বিশেষত, মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে গিয়ে ইতিহাস নিয়ে ইহুদিবাদী ইতিহাসবিদদের স্বেচ্ছাচারিতার ক্ষেত্রে। অতএব জ্ঞানগত মোকাবেলায় নির্ভরযোগ্য সূত্রে এর মীমাংসা জেনে রাখা প্রয়োজন।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আলি কাযী অনুসন্ধান করে দেখিয়েছেন, প্রথমদিকে সীমিত পরিসরে বসতি গড়ে উঠেছিল পূর্বপুরুষদের প্রাচীন ধর্মানুসারী কিছু মানুষের। মদিনা তখন তার প্রাচীন নাম ইয়াসরিব হিসেবেই পরিচিত ছিল। তখনো আউস ও খাযরাজ গোত্রের বসবাস শুরু হয়নি। নূহ আ এর যুগের তুফানের পর সর্বপ্রথম সেখানে সোয়াল ও ফালেহ গোত্রের আগমন ঘটে। পরবর্তীতে দাউদ আ. এর সাথে যুদ্ধে পরজিত হয়ে তারা এ অঞ্চল ত্যাগ করলে এরপর ইয়াসরিবে আসে আমালেকা গোত্রের লোকেরা। এক পর্যায়ে আমালেকাদের বসতি বিস্তৃত হয়ে পড়ে মক্কা-মদিনার পুরো অঞ্চলজুড়ে। ইহুদিদের বসতি তখনও শুধু সিরিয়ার কিছু অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সত্তর খৃষ্টাব্দে রোমানদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইহুদিরা সিরিয়া থেকে নির্বাসিত হয়ে মদিনায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। মূলত খ্রিষ্টীয়সনের প্রথম শতাব্দিতে তারা আরবে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছিল। অতএব মদিনা ইহুদিদের আদি বসতভূমি বলে যে দাবী করা হয় তা নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্রের বিচারে অমূলক বলেই প্রমাণিত। 

মদিনায় ইহুদিদের বসতি গড়ে তোলার বিশেষ কারণ ছিল। পূর্বের ধর্মগ্রন্থ নিয়ে পড়াশোনা করে তারা জানতে পেরেছিল এই ভূমিতেই আগমন ঘটবে শেষ নবীর। শুধু তাই নয়, এই ভূমি হবে মুহাজিরদের ভূমি। ধর্মগ্রন্থে যাদের বিশেষ মর্যাদার কথাও বলা আছে। প্রথমদিকে সবাই মদিনায় এসে বসবাস শুরু করলেও কিছুদিন পর তারা ইয়ামেন ও তার আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে তাদের তিনটি গোত্র মদিনায় থেকে যায়। বনু কায়নুকা, বনু নাযির ও বনু কুরাইযা।

এরপর এ অঞ্চলে ইহুদিদের সংখ্যা তেমন না বাড়লেও সঙ্গত কিছু কারণে আরবে তাদের শেকড় মজবুত হতে থাকে। 
কারণগুলো হচ্ছে,
এক, প্রাচীন ও পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুকরণ ব্যাতীত আসমানী কিতাবের ভিত্তিতে তখন ইহুদি ধর্মই একমাত্র ধর্ম হিসেবে অবশিষ্ট ছিল। তাহরিফ ও পরিবর্তনের পরও তাদের মাঝে আসমানী কিতাবের জ্ঞান চর্চা ও আলেম তৈরীর সংস্কৃতি জারি ছিল। 
দুই, সমাজে ইহুদিদের আচার-ব্যবহারের প্রচলন ঘটায় এর দ্বারা প্রচ্ছন্নভাবই অনেকে প্রভাবিত হতে থাকে।
তিন, পরস্পরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে।
চার, ইহুদিদের গড়ে তোলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করার মাধ্যমে, যেখানে তারা ধর্মীয় শিক্ষা দিতো ও শিক্ষার্থীদের মাঝে ইহুদী ধর্মের দাওয়াত প্রদান করতো।
পাচ, ইহুদিরা মদিনায় কিছু ধর্মীয় উপাসনালয় ও প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছিল। সেখানে তাদের একনিষ্ঠ ইবাদতের দ্বারা মানুষ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হতো। ইবাদতের পাশাপাশি তারা সেসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে থাকা লোকজনদের নিয়ে সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পরামর্শ সভার আয়োজন করতো। এতে সমাজের সকল স্তরের লোকদের মাঝেই ইহুদি ধর্মের প্রতি সহানুভূতি ও সুধারণা তৈরী হতো।

কিন্তু এতকিছুর পরও তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পায়নি। যার ফলে আউস ও খাযরাজ গোত্রের কাছে ইহুদীরা সংখ্যালঘু হিসেবেই বিবেচিত হত। ইহুদিদের আগমনের আগে থেকেই আউস ও খাযরাজ গোত্র এ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল। সাধারণত ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে তখন গোটা আরব জাতি কুরাইশদের অনুসরণ করতো। আউস ও খাযরাজও এর ব্যাতিক্রম ছিল না। এবং কাবার রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে কুরাইশদের তারা বিশেষ সম্মানের নজরেও দেখতো। আর সে কারণেই বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে মদিনায় যখন ইহুদিরা কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার চেষ্টা চালায় তখন সামাজিকভাবে পরস্পরের লড়াই দৃশ্যমান হতে থাকে। 

ইহুদিদের সাথে মদিনার মুশরিকদের বিবাদে জড়ানোর পেছনে অর্থনৈতিক বড় দুটি কারণও ছিল। প্রথমটি হচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালি হওয়ার জন্য সুদী কারবার চালু করা। প্রাথমিক পর্যায়ে মুশরিকদের তারা বাহ্যিক কিছু উপকারিতার দেখাতে সক্ষম হলেও মুশরিকরা ধীরে ধীরে এর অপকারিতা বুঝতে শুরু করে। এবং প্রতিরোধ করতে না পেরে ধূর্ত ইহুদীদের প্রতি আরো বিদ্বেষপরায়ণ হয়ে ওঠে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বন্ধকদাতার উপর অতিরঞ্জিত শর্তারোপ করা। অর্থাৎ বন্ধক রেখে সময়মত টাকা পরিশোধ করতে না পারলে এমন কিছু শর্তারোপ করতো যা সাধারণ বিবেকসম্পন্ন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এমনকি বন্ধকদাতার স্ত্রী ও সন্তানদেরকে পর্যন্ত বন্ধক রাখতে বাধ্য করা হত। নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করতেই তারা এসব শর্তারোপ করতো। আরবরা যেখানে আত্মসম্মানবোধের ব্যাপারে অন্য সব জাতির চেয়ে বেশি কঠোর ছিল তাদের পক্ষে এ ধরণের শর্ত মেনে চুপ করে থাকা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। এভাবেই ধীরে ধীরে বিবাদ বড় আকার ধারণ করে।

কিন্তু ইহুদিদের মধ্যে অনেকেই আহলে কিতাব আলেম ছিল। তাদের মাধ্যমে কিছু বাস্তবতা তারা অনুমান করতে পারতো। ইহুদি আলেমদের কথামত শেষ নবীর আগমনকে তারা বিশ্বাস করতো। এবং মদিনার মুশরিকদের গর্ব করে বলতো, শীঘ্রই আমাদের মাঝে আখেরী নবী আসবেন। আমরা তাকে আমাদের নেতা বানিয়ে নেবো। এবং তোমাদের থেকে অগ্রগামী হয়ে যাবো।

মদিনার এই অস্থিতিশীল পরস্থিতি ও বহুমূখী সংকট নিরসনে আল্লাহ তায়ালা নিজ নেযাম অনুযায়ী তার রাসুলকে মদিনায় আনার প্রেক্ষাপট তৈরী করা শুরু করেন। ঘটনাক্রমে খাযরাজ গোত্রের কিছু লোক হজের মৌসুমে মক্কায় আসলেন। তাদের সাথে নবীজীর সাক্ষাত হয়। রাসুল তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন। এতেই তারা বুঝে ফেলে, এই হচ্ছে সেই আখেরী নবী যার কথা ইহুদীরা আমাদেরকে এতদিন ধরে বলে আসছে। সাথে সাথে তারা সেই বৈঠকেই ইসলাম গ্রহণ করে ফেলে। এবং ইহুদীরা যাতে কোনভাবেই অগ্রগামি না হয়ে যায় সে কারণে তারাই মদিনায় রাসুলের বাণী প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এভাবেই রাসুলের হিজরতের আগে থেকেই মদিনায় খাজরাজ গোত্রের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের বীজ বপন করা শুরু হয়। মদিনার সর্বত্র ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক অস্থিরতার বিপরীতে অভাবনীয় সাড়া জাগায় ইসলামের সুমহান প্রস্তাবনা। ব্যক্তি ও পারিবার গঠনে ইসলামের সুশৃঙ্খল প্রস্তাবনাকে মেনে নিয়ে মদিনায় শান্তির নীড় গড়ে তুলতে শুরু করে ইমানদারেরা। এখন শুধু নবীজীর আগমনের প্রতিক্ষা। যিনি এসে ইসলামের সামগ্রিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতির প্রস্তাবনাকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে মদিনাকে আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন।

অতঃপর এলো সেই বহুল প্রতীক্ষিত দিন। মদিনার বালকদের কণ্ঠে “তলাআল বাদরু” আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুললো। তিনি এসেই মসজিদে নববী নির্মাণ করলেন। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন কায়েম করলেন। গোত্রের ভিত্তিতে বিবাদকে মিটিয়ে দিলেন। আযানের হুকুম এলো। প্রকাশ্যে ধর্মের দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলাম তার আলোয় উদ্ভাসিত করলো পুরো মদিনাবাসীকে। 

নবীজী সা. যে শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরং পুরো মানবজাতির জন্য রহমত ছিলেন তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল মদিনা নগরীতে তার হিজরতের পর। মুসলমানদেরকে দিক নির্দেশনা দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে যাতে সহাবস্থান বজায় থাকে সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন। সাধারণত মদিনার আদি বাসিন্দা আউস ও খাযরাজের সাথে মুসলমানদের খুব একটা বিরোধ ছিল না। কারণ আউস ও খাযরাজের মুশরিকেরা মক্কার মুশরিকদের চেয়ে বেশি শিক্ষিত ছিল। তারা তাদের অনুসন্ধান ও পড়াশোনার মাধ্যমে এ সত্য আগেই জেনে গিয়েছিল যে তাদের শহরে শেষ নবীর আগমন ঘটবে। কিন্তু মুসলমানরা মদিনায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইহুদীরা বিবাদে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ খুজতে থাকে। কারণ মক্কার কুরাইশদের উস্কে দেওয়ার মাধ্যমে মুসলমানদের যে ক্ষতিসাধন তারা করতো সে পথ ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু নবীজী তাদেরকে সে সুযোগ দিলেন না। তিনি ইহুদিদের সাথে শান্তিচুক্তি করে ফেলেন। সিরাতে ইবনে হিশাম ও বিদায়া নিহায়াতে যা বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। সংক্ষেপে সে চুক্তিগুলো হচ্ছেঃ
১) হত্যার প্রতিশোধ এবং বদলা গ্রহণের যে পদ্ধতি পূর্ব থেকে চলে আসছে তা সুবিচার ও ইনসাফের সাথে যথারীতি বহাল থাকবে।
২) প্রত্যেক গোত্রকেই ন্যায়পরায়ণতার সাথে নিজ দলের পক্ষে মুক্তিপণ দিতে হবে। অর্থাৎ যে সম্প্রদায়ের যতজন বন্দি থাকবে তাদের উদ্ধারের জন্য মুক্তিপণ প্রদান তাদেরই যিম্মায় থাকবে।
৩) অত্যাচার, পাপাচার, শত্রুতা ও বিবাদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেওয়া হবেনা। যদিও অপরাধী কারো পুত্র হোকনা কেন।
৪) কোন মুসলমান কোন মুসলমানকে হত্যায় কোন কাফেরের বিরুদ্ধে সহায়তা করতে পারবেনা। আর কোন মুসলমানের বিরুদ্ধে কোন কাফেরকে সাহায্য করারও অনুমতি থাকবেনা।
৫) বিপন্নকে আশ্রয়দানের ক্ষেত্রে একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমানের যে অধিকার থাকবে একজন সাধারণ মুসলমানেরও সে অধিকার থাকবে। 
৬) যে সমস্ত ইহুদি মুসলমানদের অধীনে থাকবে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব মুসলমানদের উপর বর্তাবে। তাদের উপর না কোন অত্যাচার করা হবে আর না তাদের শত্রুকে কোন প্রকার সাহায্য করা হবে।
৭) কোন কাফের বা মুশরিকের এ অধিকার থাকবেনা যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন কাফেরের জীবন অথবা সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করে, কিংবা মক্কার কুরাইশ ও মুসলমানদের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করে।
৮) যুদ্ধের সময় ইহুদিদেরকে জীবন ও সম্পদ দিয়ে মুসলমানদের সহায়তা করতে হবে। মুসলমানদের বিরোধী পক্ষকে সাহায্য করার অনুমতি থাকবেনা।
৯) নবীজীর কোন দুশমন যদি মদিনায় আক্রমণ করে তাহলে নবীজীকে সাহায্য করা ইহুদিদের জন্য আবশ্যক।
১০) যে সমস্ত গোত্র এ চুক্তি ও শপথে শরিক আছে তাদের মধ্যে যদি কেউ চুক্তি ও শপথ থেকে পৃথক হতে চায় তাহলে নবীজীর অনুমতি ছাড়া পৃথক হতে পারবেনা।
১১) কোন ফিতনাবাজকে সাহায্য করা কিংবা আশ্রয় দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবেনা। যদি কোন ব্যক্তি এরূপ কাউকে সাহায্য করে কিংবা আশ্রয় দান করে তার প্রতি আল্লাহর অভিশাপ ও ক্রোধ নিপতিত হবে। কেয়ামত পর্যন্ত তার কোন আমল কবুল হবেনা।
১২) মুসলমানগণ যদি কারো সাথে সন্ধি করতে চায় তাহলে ইয়াহুদীদের জন্যও সে সন্ধিতে অংশগ্রহণ করা আবশ্যক।
১৩) যে কেউ কো মুসলমানকে হত্যা করলে যদি তার সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে এ হত্যার বদলা নেওয়া হবে। তবে নিহতের অভিভাবক যদি রক্তপণ ইত্যাদির বিনিময় গ্রহণে সম্মত হয় তাহলে বদলা নেওয়া হবেনা।
১৪) যদি কখনো কোন ঝগড়া বিবাদ কিংবা পারস্পরিক মতবিরোধ সৃষ্টি হয় তাহলে তা আল্লাহ্ব তার রাসুলের সামনে পেশ করা হবে।
 
মদিনায় হিজরতের পাচ মাস পর নবীজী এই চুক্তিনামা সম্পন্ন করেছিলেন। এবং এর মাধ্যমে মদিনায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছিল।

লেখকঃ
আশরাফ মাহদি
অধ্যয়নরতঃ জামেয়া আযহার বিশ্ববিদ্যালয়
ফ্যাকাল্টিঃ শারিয়া ওয়াল কানুন

Monday, March 9, 2020

ইসলামের ইতিহাসে নারী মনিষী

'কোন কোন মুহাদ্দিসা এলেমের জগতে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হইছিলেন যে, ওনাদের জামাই ওনাদের ছাত্রত্ব গ্রহণ করছিলেন, এবং বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ও বিচার-সংক্রান্ত প্রশ্নে অন্যদেরও ওনাদের কাছে যাইতে বলতেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। মুয়াজ ইবনে হাবিব আল জুহানির বরাতে হিশাম ইবনু সাঈদ বয়ান করেন: মুয়াজ তার বউরে জিগেশ করছিলেন: 'বাচ্চারা কোন বয়সে এবাদত শুরু করবে?' তার বউ উত্তরে বলেন: নবি সা. থেকে আমাদের এক লোক বয়ান করেন যে, নবিজিকেও এই প্রশ্ন করা হইছিল। তখন উনি বলছিলেন: 'শিশু যখন ডান-বামের তফাত বুঝবে, তখন তারে এবাদতের আদেশ দাও।'

আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাব ইবনে জাময়াও তার বউ কারিমা বিনতে মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ আল কিন্দিয়ার থেকে হাদিস বর্ণনা করছেন। ইসহাক ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবু তালহাও তার বউ উম্মে ইয়াহইয়া হুমাইদা বিনতে উবাই ইবনে রাফিয়া আল আনসারিয়া যুরাকিয়া থেকে হাদিস বয়ান করছেন। 

ফাতেমা বিনতে মুনযির ইবনে যুবাইর ইবনুল আওয়ামরে তাবেয়িদের মধ্যে বেশ বড় মাপের স্কলার ও আইন-বিশেষজ্ঞ হিশাবে দেখা হইত। উনি অনেক হাদিস জানতেন, এগুলার বড় অংশ উনি শিখছিলেন ওনার দাদি আসমা বিনতে আবু বকরের কাছে। অনেক বড় বড় ইমাম ওনার থেকে হাদিস বয়ান করছেন, এদের মধ্যে, 'সিরাতে ইবনে ইসহাক'র লেখক মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকও আছেন। তার সনদে যেসব হাদিস বড় বড় হাদিসের কিতাবে পাওয়া যায়, সেসবের বেশিরভাগই উনার জামাই হিশাম ইবনে উরওয়া ইবনে যুবাইর উনার কাছ থেকে শুনে বয়ান করছেন, যেই হিশাম আবার ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, শু'বা, সুফিয়ান সাওরিসহ অনেক বড় বড় ইমামদের ওস্তাদ। 

'তুহফাতুল ফুকাহা'র লেখক মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে আবি আহমদ আল সমরকন্দী রহ. এর মেয়ে ফাতেমা অনেক উঁচা দরজার বিখ্যাত স্কলার ও আইনজ্ঞ ছিলেন। হানাফি ফেকাহর বিখ্যাত কিতাব 'বাদাইয়ুস সানায়ে'র লেখক আলাউদ্দিন আবু বকর ইবনে মাসুদ আল কাসানি ছিলেন উনার জামাই। ইবনে আদম বয়ান করেন: 'আমার বাবার কাছে শুনছি যে, উনি (ফাতেমা) হানাফি ফেকাহর মাসালাগুলা খুব ভাল জানতেন। উনার জামাই কাসানি রহ. মাঝেমাঝে কোন ফতোয়ার ব্যাপারে সন্দেহে পইড়া গেলে, বা ভুল কইরা ফেললে, উনি (ফাতেমা) তারে ঠিক মাসালাটা কারণসহ বুঝায়ে বলতেন।'

নবম শতকের একজন উদাহরণ হলেন ফাতেমা বিনতে ইয়াহইয়া। আল শাওকানি উনার ব্যাপারে বলেন: 'এলেমের জন্য উনি খুব মশহুর ছিলেন। বিচার সংক্রান্ত অনেক মাসালায় উনার আব্বার সাথে বিতর্ক হইছিল উনার। তার আব্বা ইমাম ছিলেন, এবং উনি নিশ্চিতভাবে বলছিলেন যে, ওনার মেয়ে মাসালা বের করার জন্য 'ইজতেহাদ' করতেছেন। এই কথা প্রমাণ করে যে, জ্ঞানের জগতে ওনার স্থান অনেক উঁচা ছিল। নাইলে একজন ইমাম কোন অযোগ্যর ব্যাপারে এমন কথা বলতেন না।' উনার আব্বা উনারে আল মুতাহহার ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সুলাইমান ইবনে মুহাম্মদের কাছে বিয়া দিছিলেন। 

আল মুতাহহার বিচার-সংক্রান্ত অনেক জটিল মাসালার ফয়সালার জন্য ফাতেমার কাছে লোকজনরে পাঠাইতেন। যখন উনার এবং উনার ছাত্রদের কাছে জটিল কোন মাসালা আসত, উনি বউয়ের কাছে গিয়া সেই মাসালার সমাধান জিগেশ করতেন। ওনার ছাত্ররা তখন বলাবলি করত: 'এই মাসালা তো আপনার না ওস্তাদ, এই মাসালা পর্দার ওইপাশ থেকে আসছে।'
~

[আল মুহাদ্দিসাত: দ্য উইমেন স্কলারস ইন ইসলাম, আকরাম নদভি; পৃ: ১৪২-১৪৪]

শাফেয়ি মাযহাবের বিখ্যাত ইমাম ছিলেন তাকিউদ্দিন সুবকি রহ. (মৃ. ৭৫৬)। উনি ছিলেন দামেশকের বিচারক। ওনার ছেলে তাজ সুবকি রহ. (মৃ. ৭৭০)-ও ছিলেন শাফেয়ি মাযহাবের বিখ্যাত ইমাম এবং ওই সময়ের একজন বিখ্যাত ইতিহাস বিশারদ। বাবার পরে উনি দামেশকের বিচারক হইছিলেন। ইসলামি আইনের শাফেয়ি ট্রাডিশনে এই 'সুবকি ফ্যামিলি'র অবদান অনেক। 

তো, তাজ সুবকি ওনার বিখ্যাত বই 'তাবাকাতে শাফেয়িয়া আল কুবরা'-য় খুব ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা লিখছেন। সেই ঘটনার মূল চরিত্র এক ইয়েমেনি নারী, যার বিস্ময়কর জ্ঞান, শক্ত মনোবল আর প্রবল ইচ্ছাশক্তি ইসলামের ইতিহাসে এখনও উজ্জ্বল। এই নারীর নাম ফাতিমা বিনতে ওবাইদুল্লাহ। উনি ইসলামি ফেকাহর অন্যতম ইমাম, ইমাম শাফেয়ি রহ.-এর মা। 

এখন আমরা যাদের 'সিঙ্গেল মাদার' বলি, ইসলামের ইতিহাস এই 'সিঙ্গেল মাদার'দের অদ্ভুত সব জীবনসংগ্রামের কাহিনীতি ভরপুর। হাদিস ও ফেকাহর বিখ্যাত তিন ইমাম— ইমাম বুখারি, ইমাম মালেক এবং ইমাম শাফেয়ি— তিনজনের মা-ই ছিলেন 'সিঙ্গেল মাদার'। জন্মের পরেপরেই ইমাম শাফেয়ি রহ.-র বাবা মারা যান। উনার আম্মা উনারে নিয়া নানাবাড়ি ইয়েমেনে চলে যান। ওনার আব্বা ছিলেন খুবই গরিব। কিন্তু ওনার আম্মা, ফাতেমার মনোবল ছিল খুবই শক্ত। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার পরেও, ছেলের উচ্চশিক্ষার জন্য কীভাবে উনি মক্কায় যান, শুদ্ধ আরবি, কবিতা ও আর্চারি শেখানোর জন্য হুজাইল নামের বিখ্যাত বেদুইন গোত্রে ছেলেরে পাঠান, হাফেজ, মুহাদ্দিস ও ফকিহ বানান, ছেলের ভবিষ্যতের জন্য বাকি জীবন সিঙ্গেল মাদার হিশাবেই কাটায়ে দেন— সে এক আশ্চর্য সুন্দর কাহিনী। 

যাহোক, এই মহান নারী খালি যে একজন সফল মা ছিলেন, তা না। উনি ওইসময়ের একজন সেরা ফকিহও ছিলেন বটে। ওনার ফিকহি ইনসাইটেরই একটা ঘটনা তাজ সুবকি বয়ান করছেন তার বইতে। 

ঘটনাটা এমন: একবার মক্কায় একটা বিচারের কাজে সাক্ষী হওয়ার জন্য ফাতেমা বিনতে ওবাইদুল্লাহ আর উনার বান্ধবী বিশর আল মিরিসির আম্মা— এই দুইজনকে ডাকা হইল। শাফি মাযহাব-মতে, যদি কাজি সাহেবের মনে সাক্ষীদের ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে, তাইলে উনি সাক্ষীদের আলাদা আলাদা কক্ষে নিয়া সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারবেন, বরং এইটাই বেটার। তো, ওই মজলিশে কাজি আলাদাভাবে দুইজনের সাক্ষ্য নিতে চাইলেন। ফাতেমা বিনতে উবাইদুল্লাহ শান্ত গলায় বললেন: আপনার এইটা করার কোন অধিকার নাই কাজী সাহেব। কারণ আল্লাহ কুরানে বলছেন: 'যদি তাদের (নারী সাক্ষীদের) একজন কোন কথা ভুলে যায়, তাইলে অন্যজন তা স্মরণ করায়ে দেবে' (সুরা বাকারা, ২৮২)। কাজি সাহেব এই দলিলের পরে আর উনাদের আলাদা করেন নাই, একসাথেই সাক্ষ্য গ্রহণ করছেন। 

সুবকি এই ঘটনায় মুগ্ধ হয়ে লেখেন: 'এইটা আসলে খুব সুন্দর দলিল, শক্তিশালী অর্থ, অসাধারণ যুক্তি-তর্ক। যদিও ওনার ছেলের মাযহাবমতে, আলাদা আলাদা করে সাক্ষ্য নেওয়া উচিত, যদি সন্দেহ থাকে। কিন্তু নারী সাক্ষীর ক্ষেত্রে এরকম করা যাবে না, এইটাই ছিল উম্মে শাফেয়ির মত। এই দলিলে কোন সমস্যা নাই।' 

ফাতেমা বিনতে উবাইদুল্লাহ। ফকিহ, মুহাদ্দিস, একজন সফল 'সিঙ্গেল মাদার'। যে ইমামের নাম আজ লাখ লাখ মানুশ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, সেই ইমাম শাফিরে 'শাফি' করে তুললেন তো আপনিই। তবু ইতিহাসে আপনার নামটা পাইতে আমার ৫ টা কিতাব ঘাঁটতে হইছে। উইকিপিডিয়ায় আপনার নাম নাই, তাজ সুবকি আপনার নাম লেখেন নাই, আকরাম নদভিও লেখছেন 'মাদার অব ইমাম শাফি'। ফাতিমা বিনতে উবাইদুল্লাহ, নারী দিবসে আপনারে সশ্রদ্ধ সালাম।

তুহিন খান

ইসলামে পর্দা এবং জ্ঞানার্জনের ভারসাম্য

রাসূলের যুগে নারীরা মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়তেন। অন্ধকারের মধ্যে তারা মসজিদে যেতেন, আবার চারিদিক আলোকিত হবার আগেই বাড়ি ফিরতেন। কেউ তাদেরকে দেখে চিনতে পারতো না। এমনকি অন্ধকারে নারীরা একজন আরেকজনকে চিনতে পারতেন না। সহীহ বুখারীঃ ৩৭২, ৮৭২

ইসলামের স্বর্ণযুগের নারীদের জ্ঞানের প্রতি  ডেডিকেশন ছিলো ঈর্ষনীয়। জ্ঞানার্জনে তাদের আগ্রহ কোনাংশে কম ছিলো না। 

একবার কয়েকজন নারী এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অভিযোগ করেন- "ইয়া রাসূলাল্লাহ! (জ্ঞানার্জনের জন্য) পুরুষরা আপনার নিকট আমাদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়। আপনি আমাদের (জ্ঞানার্জনের) জন্য একটি দিন নির্ধারণ করে দিন।" 

রাসূলু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের জন্য একটি বিশেষ দিন নির্ধারণ করেন। সেদিন তিনি তাঁদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে নসীহাত করেন, নির্দেশ দেন। সহীহ বুখারীঃ ১০১

আবু হুরাইরা এবং আনাস ইবনে মালিকের রা, পর সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনা করেন আঈশা রাঃ। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রায় দুই হাজার হাদীস বর্ণনা করেন। 

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী হিশেবে আঈশার রাঃ এতো বেশি হাদীস বর্ণনা করা উরওয়ার রাহঃ কাছে খুব একটা বিস্ময়কর ছিলো না। উরওয়া রাহিঃ ছিলেন আঈশার রাঃ বোনপো, আসমা বিনতে আবু বকর রা, ছেলে। 

চিকিৎসা বিজ্ঞানে আঈশার রা,জ্ঞান দেখে উরওয়া অবাক হন। তিনি খালাকে জিজ্ঞেস করলেন, "এই জ্ঞান আপনি কিভাবে অর্জন করলেন?" আঈশা রা, বোনপো-কে বললেন, "আমি কিংবা অন্য কোনো লোক অসুস্থ হলে যে ওষুধ ও প্রেসকিপশন দেওয়া হয়, সেখান থেকে শিখেছি। তাছাড়া একজন আরেকজনকে যেসব রোগ ও ওষুধের কথা বলে আমি তাও মনে রেখেছি।" সিয়ারু আ'লাম আন-নুবালা ২/১৮২-১৮৩

আবু বকর রা, এর মেয়ে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী এই পরিচয়গুলো আঈশা রা, কে অহংকারী করেনি। এই পরিচয়গুলো তাঁর জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়নি। তিনি জ্ঞানার্জন করেন এবং তাঁর জ্ঞান থেকে মুসলিম উম্মাহ উপকৃত হয়। 

একজন সাধারণ মুসলিম নারী হিশেবে তিনি পর্দা করতেন। উম্মুল মু'মিনীন হিশেবে স্পেশাল পর্দা করতেন। পুরুষ সাহাবীরা সরাসরি তাঁর এক্সেস পেতেন না। আঈশার রা. থেকে হাদীস বর্ণনা করেন তাঁর বোনপো উরওয়া ইবনে যুবাইর। তিনি সরাসরি খালার রুমে ঢুকতে পারতেন, খালার কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করতে পারতেন। 

আঈশার রা. আরেকজন ছাত্রী ছিলেন। তাঁর নাম আমরাহ বিনতে আব্দুর রহমান রাহি.। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনেকগুলো হাদীস তিনি বর্ণনা করেন। তিনি ছিলেন ইমাম মালিক রাহি: এর শিক্ষিকা। খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রাহিঃ শিহাব আয যুহরীকে হাদীস সংকলনের নির্দেশ দেবার সময় বলেন, "প্রথমে যাও আমরাহ'র কাছে। তাঁর হাদীসগুলো আগে সংগ্রহ করো।"

একবার মদীনার বিচারক একটা রায় দিলে আমরাহ রাঃ তাঁর শিক্ষার্থীদেরকে বলেন, "যাও, বিচারককে গিয়ে বলো এই রায়টি ভুল।" বিচারক যখন শুনলেন তার রায়ের ভুল ধরেছেন আমরাহ রাঃ, তখন সাথে সাথে আমরাহ'র রাঃ রায় মেনে নেন। 

মদীনার সাত ফুকাহার একজন ছিলেন সাইদ ইবনুল মুসাইয়িব রাহিঃ। একদিন দেখলেন তাঁর ক্লাসের এক ছাত্রের মন খারাপ। ছাত্রের নাম ছিলো আব্দুল্লাহ। আব্দুল্লাহকে সাইদ রাঃ জিজ্ঞেস করলেন, "কী হয়েছে তোমার?" 

আব্দুল্লাহ বললেন, "আজ আমার স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন৷ এজন্য আমার মন খারাপ।" 

স্ত্রী ইন্তেকাল করেছে, তারপরও ছাত্রটি ক্লাস মিস দিচ্ছেনা? ছাত্রের জ্ঞানার্জনের প্রতি এমন ডেডিকেশন দেখে সাইয়্যিদ রাঃ ঐদিনই নিজের মেয়ের সাথে আব্দুল্লাহর বিয়ে দেন। 

আগেরদিন স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন, তবুও আব্দুল্লাহ ক্লাসে যান। পরদিন নতুন স্ত্রীকে রেখে আবার ক্লাসে যেতে চাইলেন। আগেরদিন যিনি শিক্ষক ছিলেন, এখন তিনি শ্বশুর। 

আব্দুল্লাহ শ্বশুরের ক্লাসে যেতে চাইলে স্ত্রী বাধা দেন। স্ত্রী তাকে বললেন, "বসো, আমার বাবার কাছে গিয়ে যা শিখতে চাচ্ছো, সেটা আমার কাছ থেকে শিখে নাও। আমি আমার বাবার ইলম অর্জন করেছি।"

নবম শতাব্দীর একজন নারী জ্ঞানার্জনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন৷ তাঁর নাম ছিলো ফাতিমা বিনতে ইয়াহিয়া রাহঃ ইমাম আশ-শাওকানী রাহঃ তাঁর সম্পর্কে বলেন,
"ফাতিমা ইলমের দিক থেকে এতোটাই পারদর্শী ছিলেন, তাঁর বাবা ইয়াহিয়ার সাথে তিনি বিভিন্ন মাস'আলা নিয়ে বিতর্ক করতেন। মেয়ের জ্ঞান-প্রজ্ঞা দেখে তাঁর আলেম বাবা স্বীকৃতি দেন- এই মেয়ের ইজতিহাদ করার সক্ষমতা আছে।"

তাঁর বাবা তাঁকে বিয়ে দেন আল-মুতাছার ইবনে মুহাম্মদের রাহঃ সাথে। তিনিও ছিলেন একজন আলেম। মাঝেমধ্যে ছাত্রদের বিভিন্ন জটিল মাস'আলা নিয়ে আলোচনা করতেন। আলোচনা শেষে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে না পারলে ঘরের ভেতর যেতেন। ফিরে এসে মাস'আলার সমাধান বলতেন।

ছাত্ররা মজা করে বলতো, "এই মাস'আলা তো আপনার থেকে আসেনি, ঘরের ভেতর থেকে এসেছে।"

অর্থাৎ আল-মুতাছার ইবনে মুহাম্মদ স্ত্রী ফাতিমা বিনতে ইয়াহিয়ার কাছ থেকে মাস'আলা জেনে আসতেন। Al-Muhadditath, Page 144

মাজহাবের চার ইমামের সবার বাবা বাল্যকালে ইন্তেকাল করেন। জ্ঞানার্জনের প্রতি তাঁদেরকে আগ্রহী বানান তাঁদের মা। ইমাম আশ-শাফে'ঈর রাহঃ মা তো জেরুজালেম থেকে ছেলেকে কোলে করে মক্কায় নিয়ে যান যাতে ছেলেটা মক্কার আলিমদের কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করতে পারে। 

ইমাম মালিক রাহঃ ছোটবেলায় গায়ক হতে চেয়েছিলেন। ছেলেকে গায়ক হবার ব্যাপারে নিরুৎসাহি করে জ্ঞানের প্রতি উৎসাহি করেন তাঁর মা। কোন শিক্ষকের কাছে গিয়ে কী শিখবে সেই গাইডলাইন তাঁর মা তাঁকে দেন। 

ছোটবেলায় ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের রাঃ মা তাঁকে ভোরবেলায় মসজিদে নিয়ে যেতেন, আর দিনশেষে মসজিদ থেকে নিয়ে আসতেন। এইসব মহিয়সী নারীদের আত্মত্যাগের ফলে ইতিহাসে তাঁদের সন্তানরা 'ইমাম' হয়ে আছেন। 

ইসলামের স্বর্ণযুগে নারীরা পর্দার ব্যাপারে যেমন কনসার্ন ছিলেন, তেমনি জ্ঞানার্জনের ব্যাপারেও কমিটেড ছিলেন। পর্দার প্রশ্ন তাঁদের জ্ঞানার্জনে বাধা হয়ে দাড়ায়নি। আবার পর্দাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তার জ্ঞানার্জনে অগ্রসর হননি। এই দুটোকে ব্যালেন্স করে চলেছেন। 

স্বর্ণযুগের নারীরা জ্ঞানার্জনের বেলায় হীনমন্যতায় ভুগতেন না। পর্দা পালন করেও কিভাবে শেখা যায়, শেখানো যায় তার উদাহরণ তারা রেখে গেছেন। 

জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের নারীরা রাসূলের দ্বারস্থ হয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে শেখার আগ্রহ জানিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদের উৎসাহে পানি ঢালেননি৷ তিনিও তাঁদের জানার আগ্রহকে সমর্থন জানিয়েছেন। 

সমাজের একটা অংশ যদি ইলম বঞ্চিত থাকে তাহলে সমাজের বাকি অংশ বদলাবে কিভাবে? 

ইমাম ইবনুল কাইয়্যুম রাহিঃ অবশ্য নারীদেরকে 'সমাজের অর্ধেক' বলতে নারাজ। তিনি বলেনঃ "Women are one-half of the society which gives birth to the other half so it is as if they are the entire society." 

অর্থাৎ, "নারীরা হলো সমাজের অর্ধেক। কিন্তু, বাকি অর্ধেককেও তো নারীরা জন্ম দেয়। তারমানে নারীরাই যেন পুরো সমাজ।"

- মোহাম্মাদ ইরফান

Sunday, March 1, 2020

কিওয়ামাহ : মুসলিম পরিবারে পুরুষের ভূমিকা


আমাদের পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। সাথে সাথে ভেঙ্গে পড়ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা। পরিবার মানুষের প্রথম ও শেষ আশ্রয়। পার্থিব কোন সম্পর্কই পারিবারিক সম্পর্কের বিকল্প হতে পারে না। পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার সাথে সাথে বাড়ছে হতাশা, বিষাদ, আত্মহত্যা, অপরাধ প্রবণতা, মাদকে আসক্তি ও মানসিক সমস্যা। পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার জন্য পুরুষের দায় অনেক বেশী। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে, আমাদের সমাজে দায়িত্বশীল বাবা ও স্বামীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যে দায়িত্বশীলতাকে ইসলামের ভাষায় কিওয়ামাহ বলে। এই লেখায় কিওয়ামাহ'র ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করবো। 

আল্লাহ তাআলা সূরা নিসার মধ্যে ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ নারীর দায়িত্ব পুরুষের কাঁধে ন্যস্ত করেছেন। কেননা পুরুষ এই দায়িত্বশীলতার বিশিষ্টতার অধিকারী, পাশাপাশি খরচের জিম্মাও তার ওপর। ( সূরা নিসা, আয়াত ৩৪) এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা সাংসারিক পরিচালনার দায়িত্ব পুরুষের কাঁধে অর্পণ করেছেন, সরল দৃষ্টিকে একে অপ্রয়োজনীয় ও অসম্মানজনক মনে হলেও তলিয়ে দেখলে এর গুরুত্ব বুঝা যাবে। ইসলামের দৃষ্টিতে দায়িত্বশীলতার গুরুত্ব অনেক। তিনজনের ছোটদলও যদি সফর করে, তাহলে যে কোন একজনকে দায়িত্বশীল নির্ধারণের নির্দেশনা রয়েছে হাদিস শরীফের মধ্যে।

 ইসলামে একাকী সমাজবিচ্ছিন্ন থাকার কোন সুযোগ নেই। নবীজির হাদিসের আলোকে বুঝা যায়, অনেক ক্ষেত্রে একাকী নফল ইবাদত করার চেয়ে সামাজিক জীবন যথাযথভাবে পালন করা বেশী প্রয়োজনীয়। কেননা একাকী জীবনে পদস্খলনের আশঙ্কা অনেক বেশী, বিষাদগ্রস্থতা, দায়িত্বহীনতা ও অপ্রাসঙ্গিক জীবন যাপনের ঝুঁকিও অনেক বেশী। ইসলাম সামাজিকভাবে জীবন যাপনে অনেক বেশী গুরুত্ব দেয়। মানুষ তো আল্লাহর খলিফা, শুধু আল্লাহর ইবাদত নয়, সামাজিক জীবনে আল্লাহর আহকাম বাস্তবায়ন করাও মানুষের মৌলিক দায়িত্ব। এখান থেকেই সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গ এসেছে। এই পারিবারিক দায়িত্বশীলতাকেই কিওয়ামাহ বলা হয়। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু পুরুষ কেন মূল দায়িত্বশীল হবে, সব পুরুষ কি নারীদের চেয়ে অধিক যোগ্য, এটা তো সরাসরি নারীবিদ্বেষী অবস্থান। আদতে অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর থেকে স্ত্রী বেশী যোগ্য হতে পারেন, অধিক মেধাবী ও দ্বীনদারও হতে পারেন। আল্লাহ কোরআনের মধ্যে বারবার বলেছেন, সৎ কর্মের ভিত্তিতে নারী ও পুরুষ সমান প্রতিদান পাবে। পুরুষ মাত্রই নারীর চেয়ে বেশী যোগ্য ও মেধাবী, এটা ইসলামি অবস্থান নয়। সূরা হুজুরাতে আল্লাহ বলেছেন, শুধুমাত্র তাকওয়া ও দ্বীনদারিতার ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হতে পারে। 

বস্তুত যিনি দায়িত্বশীল হন, তিনিই সবসময় শ্রেষ্ঠ হবেন, সেটা জরুরী নয়। দায়িত্বশীলতা তো বিশেষ জিম্মাদারী, শ্রেষ্ঠত্বের সনদ নয়। তাই কোন পুরুষ যদি কিওয়ামাহ'র ভিত্তিতে নারীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন, তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে একে কোনভাবেই সমর্থন করা যাবে না। আবু জর গিফারি রাঃ দ্বীনদারিতায় অগ্রসর হওয়া সত্ত্বেও কখনো দায়িত্বশীল হননি। দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গ উপযুক্ততার সাথে সম্পৃক্ত, যে যে কাজের উপযুক্ত সে সেই কাজের দায়িত্বগ্রহণ করবে। পাশাপাশি ইসলামে কর্তৃত্বপরায়ণ হবার সুযোগ নেই। উপযুক্ত ব্যক্তি পরামর্শের মাধ্যমে দায়িত্বপালন করবেন। 

ফলে কিওয়ামার অনুবাদে কর্তা শব্দ উল্লেখ করা ঠিক নয়, পাশাপাশি পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বও দায়িত্বশীলতার কারণ নয়। তাহলে তবুও কেন পুরুষকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, পুরুষ কেন এই কাজের উপযুক্ত? আল্লাহ তাআলা এখানে দু'টি কারণ উল্লেখ করেছেন। ক) পুরুষ রক্ষা ও দায়িত্বশীলতায় নারীর চেয়ে বেশী দক্ষ। পুরুষ শারীরিকভাবে কঠিন কাজে অধিক অভ্যস্ত। খ) পুরুষ নারীদের খরচের দায়দায়িত্ব বহন করেন। নারীও সুযোগ থাকলে উপার্জন করতে পাড়ে, তবে খরচ নির্বাহ করা তার দায়িত্ব নয়। এজন্যই আমরা দেখবো, পশ্চিমা সমাজেও নারীবাদের উত্থান ঘটলেও পুরুষকে বলশালী, বডিবিল্ডার ও শারীরিকভাবে ক্ষমতাবান হিসেবে দেখানো হয়। 

পরিবার হচ্ছে, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। সমাজকে যদি শরীর হিসেবে ধরেন, তাহলে পরিবার সেই শরীরের কোষ। ইসলাম পারিবারিক  দায়িত্বের মধ্যে ভাগ-বণ্টন করে দিয়েছে। এই ভাগ-বণ্টনের ভিত্তি নারীপুরুষের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ নারী ও পুরুষকে তাদের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে দায়িত্বে ভাগ-বণ্টন করে দিয়েছে। আমরা পুরুষের মধ্যে দৈহিক মোকাবেলা, পরিশ্রম ও ঝুঁকি নেবার প্রবণতা দেখি। আক্রমণাত্মক মানসিকতা দেখি। এর সাথে পুরুষের শারীরিক ও মানসিক গঠন বিশেষ ভাবে জড়িত। 

এখনো নারীপুরুষদের একইসাথে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হয় না। ঐতিহাসিকভাবে আমরা পুরুষদেরকেই প্রধানত যুদ্ধ করতে দেখি। শারীরিক ও মানসিক বিশেষ গঠনের কারণে তারাই সবচেয়ে বেশী সহিংসতা ও মারামারির সাথে যুক্ত। জেলখানাগুলোতেও এই কারণে পুরুষ আসামীর সংখ্যা অনেক বেশী। অপরদিকে নার্স-প্রাথমিক শিক্ষকতায় নারীদের অংশগ্রহণ বেশী। একইভাবে লিডারশীপের পজিশনে পুরুষদের সংখ্যা বেশী। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, পুরুষদের শারীরিক ও মানসিক বিশেষ সামর্থ্য বিষয়টি সাধারণভাবে প্রযোজ্য, সর্বক্ষেত্রে নয়। কোন বিশেষ নারীর চাইতে অনেক পুরুষ শারীরিক সামর্থ্যে পিছিয়ে থাকতে পারেন। 

এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যতার ভিত্তিতে আল্লাহ পুরুষকে পারিবারিক দায়িত্বশীলতা ও খরচের দায়িত্ব দিয়েছেন। নারীকে সন্তান জন্মদান, প্রতিপালন, স্তনদান, ঘরের দায়িত্ব ও বৈবাহিক আনন্দ আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছেন। এখানে বলে রাখা ভালো, পুরুষ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেও একে শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ববাদ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। কেননা আগেই যেমন বলেছি শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তি তাকওয়া। পাশাপাশি ইসলামে সকল পরিচালনা শুরা ও মুশাওয়ারার ওপর নির্ভরশীল। একক কর্তৃত্ববাদ ফিরাউনি বৈশিষ্ট্য। ফিরাউন কোনভাবেই ইসলামি আদর্শ নয়। 

যদি একটি চিত্রের কথা চিন্তা করেন। রাতের বেলা দরজায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত করা হচ্ছে। ইতিহাসে এই বিষয়ে যত লেখাজোখা আছে, সেগুলোর পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, পুরুষই সাধারণত এসব ক্ষেত্রে দরজা খুলতে যান, নারীদেরকে গোপন আশ্রয়ে যেতে বলা হয়। এই আক্রমণকামী প্রবণতার কারণেই পুরুষ ধর্ষকদের সংখ্যা নারী ধর্ষকদের চাইতে অনেক ও অনেক বেশী। এর যে ব্যতিক্রম নেই, তা নয়, তবে ব্যতিক্রম কখনো নিয়ম ও বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। 

অনেকে দাবী করেন, নারী-পুরুষের এই শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য সমাজ তৈরি করেছে, এই বৈশিষ্ট্য তাদের দৈহিক বিষয় নয়। তারা বলেন, সমাজ নারী ও পুরুষের ধারণা সৃষ্টি করেছে। জন্ম থেকে পুরুষকে নারী হিসেবে বড় করলে সে নিজেকে নারী হিসেবেই চিহ্নিত করবে, নিজেকে পুরুষ হিসেবে ভাববে না।  তবে এই দাবী সত্য নয়। কেননা এখন আপনি চাইলে অপরেশনের মাধ্যমে লিঙ্গপরিবর্তন করতে পারবেন। তবে লিঙ্গ পরিবর্তন করলেই শারীরিক গঠন পরিবর্তন করা যায় না। নির্দিষ্ট অঙ্গের গোশত কর্তন বা সংযুক্তির মাধ্যমে সারা শরীরের পেশি ও মানসিক গঠন পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।    

এসব কারণে আরটি থেকে প্রকাশিত এক ডকুমেন্টরিতে দেখা যায়, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিবর্তিত লিঙ্গের লোকেরা আগের লিঙ্গে ফেরত যেতে চায়, অনেকে আত্মহত্যা করে। ফলে শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যকে নিছক সামাজিক সৃষ্টি হিসেবে আখ্যা দেওয়া যাচ্ছে না। যেহেতু লিঙ্গের পরিবর্তনে শারীরিক পরিবর্তন ঘটে না, তাই লিঙ্গ পরিবর্তিত নারীদের প্রকৃত নারীদের সাথে খেলায় অংশগ্রহণ করা এখনো বিতর্কিত ইস্যু হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে নানারকম কেমিক্যাল ব্যবহার করে নারী বানানোর চেষ্টা করা হয়। তবে কখনোই নারী-পুরুষকে একইসাথে খেলায় অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয় না। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু পুরুষ কেন খরচের দায়িত্ব বহন করবে, নারীরাও তো উপার্জন করতে পারে। সময় ও সুযোগ থাকলে নারীদের উপার্জনে ইসলামের দৃষ্টিতে বিশেষ কোন বাঁধা নেই। তবে  ইসলাম নারীর কাঁধে এই দায়িত্ব দেয়নি। কেননা নারীরা কঠিন কাজের দায়িত্ব নিলে তাতে তাদের ঘরের কাজ ব্যাহত হতে পারে। ফুলটাইম জবের যে পরিমাণ ক্লান্তি ও পরিশ্রম, তাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেক নারীর পক্ষে সবকিছু কুলিয়ে উঠা সম্ভব হয়ে উঠে না। পাশাপাশি এই সুযোগে অনেকে নারীর রুপ ও শরীর ক্রয়ের চেষ্টা করেন। রিসিপশন ও বিজ্ঞাপনের মতো স্পর্শকাতর কাজে নারীকে ব্যবহার করা হয়। 

পাশাপাশি ঘরে ফিরে নারীকে তার সেই আগের দায়িত্বই পালন করতে হয়। সন্তান যথাযথ যত্ন ও আদর থেকে বঞ্চিত হয়। ঘন ঘন একাধিক বাচ্চা হলে হয়তো নারীকে তার ফুলটাইম কাজে অনিয়ম করতে হয় বা সন্তানের যত্নে ত্রুটি হয়। আমরা জানি, কাজের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত দায়িত্বের বিশেষ ভূমিকা আছে। প্রত্যেকে এক কাজ না করে দায়িত্ব ভাগ করে নিলে প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। তাতে সমাজ ও জাতি বিশেষভাবে উপকৃত হয়। যে নারী সমাজে বিশেষ সার্ভিস দিতে চান, তিনি পরিবারে বিশেষ সময় দিয়ে সমাজের একটা বিশেষ ইউনিটকে শক্তিশালী করে তুলতে পারেন। এভাবেই প্রকৃতপক্ষে সমাজ বেশী উপকৃত হয়। 

তবে বলে রাখা ভালো, মৌলিক দায়িত্বপালন করতে পারলে নারীর জন্য চাকরীতে যোগ দেবার সুযোগ রয়েছে। ঘরে গৃহকর্মী ও সাহায্যকারী রেখে পরিশ্রম ভার কমিয়ে গৃহিণীর দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি সামাজিক কাজ ও শ্রমেও অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। ইসলাম এক্ষেত্রে বাঁধা দেয়নি। তবে কোনভাবেই নারীর ওপর  বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক দায়িত্ব চাপায় নি। যেমন পুরুষের ওপর  সন্তান জন্মদান, প্রতিপালন, স্তনদান, ঘরের পরিচালনা ও বৈবাহিক আনন্দ আয়োজনের দায়িত্ব দেন নি। 

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়কে তার পরিমাপ মতো সৃষ্টি করেছেন। ( সূরা কামার, আয়াত ৪৯)। আল্লাহ দুনিয়াতে অনেক প্রাকৃতিক নীতি তৈরি করে দিয়েছেন, মানুষ চাইলেও এগুলোকে অতিক্রম করতে পারবে না।

ইফতেখার জামিল

Friday, February 14, 2020

খৃষ্টবাদের বিদাত ও একনায়কতন্ত্রিক ধর্মান্ধতা

ক্যাথোলিক পোপ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বিবাহিতরা পাদ্রী হতে পারবে না। অর্থাৎ ভ্যাটিকান তার হাজার বছরের সিদ্ধান্ত থেকে বের হতে পারছে না। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। 

ক)  একক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে ধর্ম চলছে। ইসলামে এটা ভাবাই যায় না। কাবা শরীফ ইসলামে অত্যন্ত সম্মানিত জায়গা, দেওবন্দ বা আজহার বড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, তবে কারো পক্ষেই একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা নাই। কোরআন-সুনানের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে পারলে বাংলাদেশের কোন প্রান্তিক অঞ্চল থেকেও কেউ এর বিরোধিতায় দাড়াতে এবং ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। 

খ) বিবাহিতরা পাদ্রী হতে পারবে না, এটা মূলত একটা বিদআত। এর সূচনা হয়েছে হাজার বছর আগে। এর আগে খৃস্টান ধর্মে এর প্রচলন ছিল না। ইসলামে এমন সার্বজনীন বিদআতের কথা ভাবাও যায় না। এত দীর্ঘমেয়াদীভাবে কোন বিদআত টিকে থাকে এবং তথাকথিত সংস্কারবাদী পোপ তাতে সম্মতি জানান - বুঝেন অবস্থা ! 

গ) সবচেয়ে বড় কথা বিবাহের মতো স্পষ্ট হালাল ও অধিকারের বিষয় পোপ বা গির্জা হারাম বানায় কীভাবে, মানুষ কীভাবে  এই এখতিয়ার পেল? দেখুন, গণতন্ত্রেরও ঠিক একই সমস্যা। তারা আইন প্রণয়ন করে। অবৈধ প্রতারক চক্র সংসদে বসে মানুষের বৈধ-অবৈধ ঠিক করে দেয় ; আঠারো বছরের আগে বিবাহ করা যাবে না। *

ঘ) আমরা অনেক সময় মনে করি, গির্জা বা খৃস্টান ধর্মীয় ব্যবস্থায় বোধহয় গণতন্ত্র নেই। আদতে সেখানেও 'গণতন্ত্র' আছে। পাদ্রী-বিশপরা পোপ নির্বাচিত করেন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পোপের স্বৈরতন্ত্রসহ  বাকীদের মতামত নেবার ব্যবস্থা আছে। তবে গির্জার মতো গণতন্ত্রেও মৌলিক কিছু সমস্যা আছে। বিদআতের কথাই ধরুন, কিছু একক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কীভাবে মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, গির্জার মতো আধুনিক গণতন্ত্রও এভাবে স্বৈরাচার জারি রেখেছে। **  

এই লোকগুলোই আবার ধর্মীয় আইনের কথা বলে ইসলামি শরিয়তের বিরোধিতা করেন। ট্র্যাম্প তার ভাষণে শরিয়া ল উচ্চারণ করতে গিয়ে কীভাবে মুখ ও উচ্চারণ বিকৃত করেছিলেন, সেটা ভুলতে পারি না !

ইফতেখার জামিল

Thursday, February 6, 2020

ইতিহাসে ফিকহ ও তুরাছের গুরুত্ব কেন বেশী

যারা আধুনিক আইন বা সমাজতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন, তাদের অধিকাংশের একটা বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, তারা ইসলামি ফিকাহ জানেন না। ফিকাহ ইসলামি চিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দু ; ফিকাহের মানে শুধু কোরআন-হাদিস নয়, পাশাপাশি চৌদ্দশো বছরের অভিজ্ঞতা ও চর্চা। সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মোকাবেলা। এখানে কত বিষয়ের  পর্যালোচনা, আলোকপাত ও ব্যাখ্যা আছে, সেটা ফিকাহের কিতাবগুলোর বিষয়বস্তু দেখলেই বুঝা যাবে। আমাদের প্রচলিত আইন ও সমাজতত্ত্ব কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতার এমন অভিজ্ঞতার ওপরেই দাড়িয়ে আছে।

 তবে তলিয়ে দেখলে ধরতে পারবেন, পশ্চিমা সভ্যতায় ব্যাপক পরিসরে গ্রন্থ উৎপাদনের বয়স তিন থেকে চারশো বছর, তাই ক্লাসিক্যাল কাজকর্মের হিসেব করলে মুসলিম লেখাজোখার সংখ্যা অনেক বেশী। সমকালীন লেখাজোখার অবশ্যই গুরুত্ব আছে, তবে ক্লাসিকের স্বাদ ও গভীরতা অনেক বেশী। বইমেলায় যত বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে হয়তো বড়জোর পাঁচ-দশটা বই ক্লাসিক্যাল অর্থে কিতাব হবার যোগ্যতা রাখে। বাকীগুলো নোট, নকল বা খাতা, ইসলামি ইতিহাসে এসব বিষয়েরও দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। 

পশ্চিমাদের রেনেসাঁ যুগে শিক্ষিতদের প্রায় সবাই ল্যাটিন জানতেন। আদতে ধারাবাহিকতাহীন কোন রেনেসাঁ সম্ভব হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, আরবি ছাড়া আপনি কি ইসলাম শিখতে ও ভালো মুসলমান হতে পারবেন না? অবশ্যই পারবেন। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা বা মুসলমানিত্বের কথা বলা হচ্ছে না। গবেষণা ও আত্মানুসন্ধানের প্রসঙ্গ আনা হচ্ছে। ক্লাসিক কিতাব তৈরি হতে সময় লাগে, সভ্যতাগত স্থিতিশীলতা লাগে, যার অনেককিছুই এখন অপ্রতুল। তাই চৌদ্দশো বছরের বিকল্প হাতছাড়া কেন করবেন? 

বলে রাখা ভালো, আমি ব্যক্তিগতভাবে মোটেই ইংরেজি বা পশ্চিমা শিক্ষার বিরুদ্ধে না। তবে ত্রিপল আইটির গবেষণা যেমন বলেছে, ইসলামি সভ্যতায় রাজনীতি বিষয়ক অমুদ্রিত প্রায় কয়েক শো গুরুত্বপূর্ণ বই আছে, মাকাসেদ বিষয়ক বই আছে কয়েক ডজন, নিজুত মানুষের হালাকাজাত অভিজ্ঞতার সঞ্চিত জ্ঞান অনেকটা গুপ্ত ধনের মতই , বরং তারচেয়েও বেশী পবিত্র, চিন্তার সাথে তো সম্পদের তুলনা হয় না। যদি মিসরের পিরামিডের রাজা-বাদশাদের মমি অত গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে আমাদের ক্লাসিক কিতাবগুলো কেন নয়?

ইফতেখার জামিল

Saturday, February 1, 2020

ফতোয়া আন্দোলন : নীরব বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই



ইমরান আব্দুল্লাহ:

একটি গ্রাম্য সালিশকে ফতোয়া আখ্যা দিয়ে ২০০১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি সব ধরনের ফতোয়াকেই নিষিদ্ধ বলে রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি গোলাম রব্বানির নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ। হাইকোর্টের এ বিচারপতির পক্ষ থেকে এটাই একমাত্র আঘাত ছিল না, বরং হাইকোর্টে থাকাকালীন তিনি আরও একাধিক মামলায় কুরআন-বিরোধী রায় দিয়েছেন। এমন একটি মামলা ছিল তালাক-পরবর্তী খরপোষ বিষয়ে। রায়টি আপিল বিভাগে বাতিল হয়ে যায়। ঠিক তেমনি ২০১১ সালে এসে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়টিও আপিল বিভাগে বাতিল হয়ে যায়।

কিন্তু এত সহজেই বাতিল হয়নি রায়টি। এজন্য ময়দানে যেমন আন্দোলন করতে হয়েছে, তেমনি কোর্টে লড়তে হয়েছে, দৃশ্যপটের আড়ালে লড়াই করতে হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও। বরং বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইটাই সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হয়েছে। এ লড়াইটা না করলে আঁধারে তির ছোঁড়ার মতোই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যেত আপিলের চেষ্টা। বু্দ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের গল্পটা এখানে একটু বলি।

বই লেখা

ফতোয়ার যে সংজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে বিচারক গোলাম রব্বানি ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় দিয়েছিলেন, সে সংজ্ঞাই ছিল ভুল। তিনি বলেছেন, ‘ফতোয়া’= হচ্ছে আইনগত কর্তৃপক্ষের আইনানুগ মতামত।’ অথচ শরিয়তে ফতোয়ার সাথে আইনগত কর্তৃপক্ষ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই এবং এটি কোনো বিচারিক রায়ও নয়। এক্ষেত্রে রব্বানি সাহেব জেনে বা না জেনে ফতোয়ার ভুল সংজ্ঞার আশ্রয় নিয়েছেন সকল ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করার জন্য। অন্যথায় ইসলামি বিচারব্যবস্থায় এ ধরনের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো প্রয়োজন হয় না; কেননা ‘হিদায়াহ’সহ ফিকহের বিশাল গ্রন্থগুলোর ‘আদাবুল কাযী’ অধ্যায়ে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো বিচারক শরিয়াহ পরিপন্থী কোনো রায় দিলে তা আপনাআপনিই বাতিল বলে বিবেচিত হবে।

ফতোয়া নিয়ে যেহেতু বিচারকদের মাঝেই জ্ঞানের কমতি আছে, এই কমতি দূর না করলে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেও লাভ হবে না। তাই আপিলের শুনানি শুরু হলে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি তৈয়ব সাহেবের উকিল মুজিবুর রহমান বললেন, ‘আপনারা ফতোয়া নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটি বই লিখে দেন। বইটি আমরা বিচারকদের হাতে দিই; যেন তারা বিষয়টা বুঝতে পারেন। তাদের সামনে যেন ফতোয়ার ধারণাটা স্পষ্ট হয়।’

ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের কাছে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুফতি তৈয়ব বলেন, লালবাগে মিটিং হলো বইটি কে লিখবে। একজন বড় মুফতিকে দায়িত্ব দেয়া হলো। কিন্তু দুদিন পর আরেক মিটিংয়ে তিনি জানালেন, বইটি এত কম সময়ে তিনি লিখতে পারবেন না। এদিকে শুনানি চলছে, হাতে সময়-ও নেই। উপায় না দেখে মুফতী আমিনী রহ. আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া রহ.-কে বললেন, আপনি লিখে দেন। আবুল ফাতাহ সাহেব বললেন, আমি তো মুফতি না। আমিনী সাহেব ভরসা দিয়ে বললেন, কাজ করতে মুফতি হওয়া লাগে না। আপনি কাজ করুন, আমরা সাহায্য করব।

মুফতী তৈয়ব বলেন, আবুল ফাতাহ সাহেব মাত্র তিনদিনে ‘ফতওয়া ফিকহ হাদীস’ শিরোনামে বইটি লিখে শেষ করেন। বইয়ের কপি বিচারকদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এই বইটির মাধ্যমে তাঁরা ফতোয়া ফিকহ এবং হাদীস সম্পর্কে সুস্পষ্ট একটা ধারণা লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৬০ পৃষ্ঠার বইটি বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত হয়।’

এমিকাস কিউরিদের তথ্য সরবরাহ

২০১১ সালের পয়লা মার্চ থেকে আপিল শুনানি শুরু হলে সুপ্রিমকোর্ট ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীকে এই মামলার এমিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত করেন। নিযুক্ত এমিকাস কিউরিদের কেউ কেউ ফতোয়া, ফিকাহ, হাদিস সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, এগুলোর নির্ভরযোগ্যতা, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং আইনের সাথে এগুলোর সম্পর্ক জানতে চেয়ে শীর্ষ আলেম-উলামাদের কাছে চিঠি পাঠান। এই চিঠির উত্তরে এসব বিষয়ে দলিল-প্রমাণ, আলোচনা-বিশ্লেষণ সরবরাহ করেন শীর্ষ আলেমগণ। বিশেষ করে মারকাযুদ দাওয়াহ’র পক্ষ থেকে কয়েকজন এ কাজে এমিকাস কিউরিদের সহায়তা করেন।

সিনিয়র আইনজীবীদের পাশাপাশি আদালত ৫ জন শীর্ষ আলেমকেও এমিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্ত করেন। আলেম এমিকাস কিউরিদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন ফতোয়া পক্ষের হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মাওলানা নজরুল ইসলাম। তিনি আলেমদের কথা শুনেন এবং আদালতে একজনের কথা যেন আরেকজনের সঙ্গে মিলে না যায়, তা তিনি বুঝিয়ে দেন। অথবা আরও কিছু কথা যুক্ত করার মতো মনে হলে তাও বলে দেন। এমনভাবে তিনি আদালতে বক্তব্য দেয়ার জন্য প্রস্তুত করেন আলেমদের।

শেষকথা

হাইকোর্টে যুক্তি-তর্কের ওপর ভিত্তি করেই আলেমগণ বসে থাকেননি। বরং তারা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ দিয়ে বিচারকদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতা বদলে দিতে চেয়েছেন। যেখানে যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন, কাজে লাগিয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক এই কাজগুলো না করলে বিচারকরা হয়তো অন্যকিছু ভাবতেন। তখন ফতোয়ার পক্ষে রায় আসাটা অসম্ভব হয়ে যেত।


-ফাতেহ২৪

ফতোয়া আন্দোলন : আদালতে রায়ের মোকাবেলা



মুনশী নাঈম:

২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাবাজার পত্রিকায় নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নের আতিথা গ্রামে এক গৃহবধূকে ফতোয়া দিয়ে হিল্লা বিয়ে করতে বাধ্য করার বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর বিচারপতি গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার আদালত কেন ফতোয়া প্রদানকারী হাজি আজিজুল হকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না—এ বিষয়ে নওগাঁর জেলা প্রশাসক, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি এক স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমেটো) রুল জারি করেন। পরে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি দুই বিচারপতি ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে বলেন, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইনসংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।

ইসলাম ও শরিয়াহর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক এ রায়ে চমকে ওঠেন এ দেশের ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী এবং উলামায়ে কেরাম। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলেন না। ঠিক সে সময় আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. হাইকোর্টের রায়দাতা দুই বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও নাজমুন আরা সুলতানাকে মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে ফতোয়া প্রকাশ করেন। এবং হাইকোর্টের ফতোয়া-নিষিদ্ধের রায়ের বিরুদ্ধে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে দুর্বার আন্দোলনের ডাক দেন। পুরো দেশ তখন আমিনী রহ.-এর এই সাহসী আহ্বানে সাড়া দিয়ে গর্জে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে হকপন্থী সমস্ত উলামায়ে কেরাম তাঁকে সমর্থন জানান।

৪ ফেব্রুয়ারি দিনের বেলা মুফতি আমিনী রহ.-কে লালবাগ থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপর এই দিনই রাতের বেলা দিনাজপুরের একটি জনসভা থেকে ফেরার পথে গাজিপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, আবদুল লতিফ নিজামি, মুফতি ইজহার , জুনায়েদ আল হাবীবসহ আরও অনেক নের্তৃবৃন্দকে।

এরপরই মূলত হাইকোর্টের ফতোয়া-নিষিদ্ধের রায়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু হয়। এসময় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আপিল বিভাগে পাঁচটি আবেদন করা হয়। এর মধ্যে ২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি তৈয়বের পক্ষে মুজিবুর রহমান এবং কিছুদিন পর আবুল কালাম আজাদের পক্ষে আবদুর রাজ্জাকের আপিল দুটি গ্রহণ করা হয়। সেই আইনি লড়াইয়ের প্রক্রিয়া জানতে চেয়ে ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের পক্ষ থেকে আমরা কথা বলেছি ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতী মুহাম্মদ তৈয়বের সঙ্গে।

যেভাবে আইনি লড়াই শুরু

আইনি লড়াইয়ের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল জানতে চাইলে মুফতী তৈয়ব বলেন, দেশজুড়ে তখন আন্দোলন চলছে। কিন্তু মুফতী আমিনী, শায়খুল হাদীসের মতো বড় বড় নেতা ময়দানে নেই। তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দেয়া হয়েছে। জেল থেকেই মুফতী আমিনী মাওলানা মুহিউদ্দিন খান সাহেবকে খবর পাঠালেন, ‘হাইকোর্টে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের মোকাবেলায় একটা আপিল করে রাখেন।’ যেহেতু ফতোয়া নিয়ে মামলা, খান সাহেব চাইছিলেন বড় কোনো মুফতি আপিলটা করুক। কিন্তু বড় বড় মুফতিদের তখন অনুরোধ করার পরও আপিল করতে কেউ রাজি হননি। কারণ সবাই ভয় পাচ্ছিলেন, এখানে মুফতী আমিনী জড়িত থাকার কারণে রাজনৈতিকভাবে হয়তো তাঁরা ফেঁসে যেতে পারেন। সবাই যখন নিরাপদ দূরত্বে নিজেকে সরিয়ে নিলেন, একদিন খান সাহেব আমাকে বললেন, তুমি ইফতা পড়োনি? আমি বললাম, আমি দু বছর আগে লালবাগে মুফতী আমিনী সাহেবের কাছেই ইফতা পড়েছি। খান সাহেব বললেন, তুমিই আপিল করো।

কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। আমার তো ইফতার সার্টিফিকেট নেই। আপিল করতে গেলে তো মুফতির সার্টিফিকেট দাখিল করতে হবে বিষয়টাকে অথেনটিক করার জন্য। তখনো লালবাগে ইফতা বিভাগে সার্টিফিকেট দেয়া শুরু হয়নি। কারও কোথাও দরকার হলে হাতে লিখে সত্যায়ন দেয়া হতো। মুফতী আমিনী সাহেবের সঙ্গে জেলে দেখা করে বললাম, খান সাহেব আমাকে আপিল করতে বলছেন। কিন্তু আমার তো মুফতির সার্টিফিকেট নেই। হুজুর তখন লালবাগ মাদরাসায় খবর পাঠালেন, ইফতা বিভাগের সার্টিফিকেট তৈরি করা হোক। দুদিনের মধ্যে খুব জলদি করে তৈরি করা হলো সার্টিফিকেট। এরপর লালবাগ মাদরাসার প্রথম সার্টিফিকেট তুলে দেয়া হয় আমার হাতে।

২০০১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি আমরা হাইকোর্টে আপিল করি। আমাদের উকিল ছিলেন হাইকোর্টের প্রভাবশালী প্রবীণ অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান। শুধু আপিলটুকুই করেছিলাম, শুনানির তারিখ-টারিখ কিছু পড়েনি। আপিলে বলা হয়,…এই ঘটনায় সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করা অযৌক্তিক। এটি ইসলামের বিধান ও বাংলাদেশের সংবিধানের ২ (ক), ৮(১), (১ক) ও ৪১ (১) অনুচ্ছেদের বিরোধী। এই রায় কুরআন-সুন্নাহর বিধানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে। কুরআনের বিধানের বিষয়ে হাইকোর্টের রায় দেয়ার অধিকার নেই।

এরপর আমার দেখাদেখি আপিল করেন জামায়াতে ইসলামীর আবুল কালাম আজাদ। তাঁর উকিল ছিলেন আবদুর রাজ্জাক।

জোট সরকারের আমলে

২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়। ক্ষমতায় আসে চারদলীয় জোট সরকার বিএনপি। মুফতী তৈয়বের কাছে প্রশ্ন রেখে বললাম, বিভিন্ন পত্রিকা লিখেছে, জোট সরকারের আমলে আপিল কোর্টে তোলার কোনো চেষ্টা করা হয়নি। মুফতী তৈয়ব উত্তরে বলেন, পত্রিকাগুলো প্রোপাগান্ডা ছড়িয়েছে। আমরা কয়েকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সরকার তা কোর্টে তুলতে দেয়নি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সঙ্গে মুফতী আমিনী এবং শায়খুল হাদীস সাহেব বারবার কথা বলেছেন, অনুরোধ করেছেন আপিলের শুনানির তারিখ দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি কথা কানেই তুলেননি বরং উল্টো আপিল তুলে নিতে চাপ দিয়েছিলেন। কারণ, বিএনপি ভাবছিল, হাইকোর্টে এখন যদি আবার ফতোয়ার মামলাটি তোলা হয়, ফতোয়ার পক্ষে রায় এলে সুশীল সমাজ ক্ষেপে উঠবে। বিপক্ষে রায় গেলে ক্ষেপে উঠবে তৌহিদি জনতা। তখন বিপদে পড়বে সরকার। তাই তারা আপিলের ফাইলটি একরকম ক্লোজড করে দিয়েছিল। মুফতি আমিনী রহ. তখন বলেছিলেন, আলেমদের সঙ্গে এই গাদ্দারি বিএনপির দীর্ঘ পতন ডেকে আনবে।

সরকার থেকেই যেহেতু আপিলের ফাইলটি খুলতে দেয়া হয়নি, তাই আদালতেও আমরা যেতে পারিনি। ফলত সবার মনে হয়েছে আমরা কোনো চেষ্টা করিনি।

চূড়ান্ত শুনানি

কখন আবার আপিলের ফাইলটি ওপেন হলো, জানতে চাইলাম। উত্তরে মুফতি তৈয়্যব বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে, ২০১১ সালের মার্চে আপিলের ফাইলটি ওপেন হয়। ২০০১ সালে যখন আপিল করি তখনই আমাদের আইনজীবী মুজিবুর রহমান বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন। তারপর কেটে গেছে নয় বছর। তিনি আরও দুর্বল হয়ে পড়লেন। তাই আমরা অ্যাডভোকেট মাওলানা নজরুল ইসলামকে উকিল হিসেবে নিয়োগ দিই। আমাদের এবং জামায়াতে ইসলামীর আপিল, দুটোর শুনানি একসঙ্গে হয়।

শুনাননি চলাকালীন আদালত ১০ অ্যাডভোকেট এবং পাঁচজন আলেমকে এমিকাস কিউরি হিসেবে মনোনীত করেন। তারা আদালতের বাইরে থেকে এই মামলায় বিচারকদের সাহায্য করেন। এমিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে আদালতে মুফতী মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, ‘ফতোয়া নিষিদ্ধ করার অর্থ হলো কোরআন অচল করে দেয়া। এটি হতে পারে না । মুফতী কেফায়াতুল্লাহ বলেন, ‘ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে ইসলাম জানা সম্ভব হবে না । তাই ফতোয়া নিষিদ্ধ হতে পারে না।’ মাওলানা রুহুল আমীন বলেন, ‘এখন গ্রামাঞ্চলে যা চলছে সেটি ফতোয়া নয়। কারণ, কাউকে দোররা মারা, হাত কেটে দেয়া এগুলো ফতোয়ার মধ্যে পড়ে না। তিনি বলেন, ফতোয়া দিয়ে শাস্তি দেবার ক্ষমতা কেউ নিজের হাতে নিতে পারে না।’

সংক্ষিপ্ত এবং পূর্ণাঙ্গ রায়

দুই মাস ১২ দিন শুনানির পর ২০১১ সালের ১২ মে তৎকালীন বিচারপতি এ বি এম খাইরুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৬ বিচারকের বেঞ্চ ফতোয়া সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন।

ফতোয়ার রায়ের বেঞ্চে ছিলেন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী। এঁদের মধ্যে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মূল রায় লেখেন। তার সঙ্গে কিছু বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে পৃথক রায় দেন বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা। এই বেঞ্চের অন্য চার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

শুনানিতে আদালতের বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে টি এইচ খান, রফিকউল হক, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, মাহমুদুল ইসলাম, এম জহির, এ বি এম নুরুল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, তানিয়া আমীর এবং এস আই ফারুকীর বক্তব্য শোনেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া পাঁচজন আলেমের বক্তব্যও শোনেন আদালত। এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ওপর ভিত্তি করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নিম্নলিখিত রায় প্রদান করেন :

১. ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তিরা শুধু ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে ফতোয়া দিতে পারবেন। এই ফতোয়া স্বেচ্ছায় গৃহীত হতে হবে। ফতোয়া মানতে কাউকে বাধ্য করা, জোর করা কিংবা অনুচিত প্রভাব প্রয়োগ করা যাবে না।
২. কোনো ব্যক্তির দেশে প্রচলিত আইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকার, সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুণ্ন বা প্রভাবিত করে, এমন ফতোয়া কেউ প্রদান করতে পারবে না।
৩. ফতোয়ার নামে কোনো প্রকার শাস্তি, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না।
৪. তবে ঐ নির্দিষ্ট ফতোয়াটি (যা হাইকোর্ট অবৈধ বলেছেন) অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হলো।

এরপর ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ফাতোয়া সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি।

‘একমাত্র সফল আন্দোলন’

এই ফতোয়া আন্দোলনকে বাংলাদেশের আলেমদের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সফল আন্দোলন বলা চলে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুফতী তৈয়্যব সাহেব বলেন, অবশ্যই বলা চলে। তবে এটা ছাড়াও আরও দুএকটা আন্দোলন আছে, যেখানে আমরা সফল হয়েছি। যেমন আগে আশকোনা হজক্যাম্প ছিল না। একেক বছর একেক জায়গায় হজক্যাম্প করা হতো অস্থায়ীভাবে। এতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলেও পড়তে হতো হাজিদের। হাজিদের দুর্ভোগ লাঘবে আমিনী রহ. স্থায়ী হজক্যাম্পের আবেদন করেছিলেন। কয়েকবছর আন্দোলনের পর আশকোনা হজক্যাম্প স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। কিন্তু ফতোয়া আন্দোলন ছিল সবচেয়ে বড় জয়। আদালত এখন ফতোয়া নিষেধ করেনি, বরং ফতোয়ার অপব্যবহার নিষেধ করেছে।

-ফাতেহ২৪

ফতোয়ার রাজনৈতিক লড়াই : ময়দানে রায়ের মোকাবেলা

জানুয়ারি ৩১, ২০২০

রাগিব রব্বানি:

২০০১ সালের পহেলা জানুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম রব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বেঞ্চ দেশে সবধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করে আইন জারি করেন। ঘোষণায় বলা হয়, একমাত্র আদালতই অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইন সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নে মতামত দিতো পারবেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

হাইকোর্টের এই ঘোষণার পরপরই কিংবদন্তি ইসলামি রাজনীতিবিদ মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. সর্বপ্রথম প্রতিবাদ করেন। তাঁর প্রতিবাদের সূত্র ধরে দেশ জুড়ে গড়ে ওঠে দুর্বার আন্দোলন। আন্দোলন থামাতে মুফতী আমিনীসহ নেতৃস্থানীয় ওলামায়ে কেরামকে সরকার গ্রেপ্তার করে। আন্দোলন আরও প্রবল হয়ে ওঠে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশ ও বিডিআরের নির্বিচার গুলিতে শাহাদত বরণ করেন ছয়জন আন্দোলনকারী। এরই সূত্র ধরে দীর্ঘ ১০ বছর পর হাইকোর্টের এই রায়কে বাতিল ঘোষণা করে ফতোয়াকে বৈধতা দেওয়া হয়।

ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় এবং পরবর্তীতে তা বাতিল ঘোষণার মধ্যবর্তী সময়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে ওলামায়ে কেরামকে। ময়দানের এই লড়াইটা কেমন ছিল, কীভাবে গড়ে উঠেছিল দুর্বার সেই আন্দোলন, এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে কথা হয়েছিল ফতোয়া আন্দোলনের অন্যতম নেতা, ইসলামী ঐক্যজোটের বর্তমান মহাসচিব মুফতী ফয়জুল্লাহ’র সঙ্গে।

ফতোয়া নিষিদ্ধকারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া

ফতোয়া আন্দোলনের সূচনা কীভাবে এবং কখন হয়েছিল জানতে চাইলে মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, ২০০১ সালের পহেলা জানুয়ারি বিচারপতি গোলাম রব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার বেঞ্চ ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় ঘোষণার পরপরই হজরত আল্লামা মুফতী ফজলুল হক আমিনী খবরটা জানতে পারেন। খবরটা জানামাত্রই একদিকে যেমন তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, অপরদিকে পেরেশানও হন। আমরা যাঁরা তাঁর সহযোগী ছিলাম, আমাদেরকে তিনি নির্দেশ দিলেন ফতোয়া নিষিদ্ধকারীরা যে মুরতাদ, এই ব্যাপারে কিতাবাদি ঘেঁটে দলিলাদি যেন দ্রুত বের করি। আমরা হুজুরের নির্দেশ পালনে কিতাবাদি নিয়ে বসে যাই, আর হুজুর দেশের সমকালীন শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ শুরু করেন। প্রত্যেকের কাছে এই রায়ের ভয়াবহতা তুলে ধরে এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ চান। রায়দাতা দুই বিচারপতির মুরতাদ হয়ে যাওয়া মর্মে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবার সম্মতিক্রমে একটি ফতোয়া প্রকাশের প্রস্তাবও পেশ করেন তিনি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য অধিকাংশের কাছ থেকে তিনি আশাব্যঞ্জক সাড়া পাচ্ছিলেন না। প্রত্যেকেই বলছিলেন, আদালতের বিরুদ্ধে এভাবে ফতোয়া প্রকাশ স্পর্শকাতর বিষয়। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কিন্তু আমিনী রহ. নিজের কথায় অনড়। তিনি ফতোয়া জারি করবেনই। ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে কার্যত ওলামায়ে কেরামের মতামত প্রদানের জায়গা সংকুচিত হয়ে আসবে, ইসলামপ্রশ্নে দেখা দেবে নানা সমস্যা, তাই এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যা-ই হোক, কোনো পরোয়া করতে রাজি হননি মুফতী আমিনী রহ.।

মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, রায় প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুফতী আমিনী রহ. দেশের শীর্ষস্থানীয় একজন মুফতী এবং ইসলামী রাজনীতিবিদ হিসেবে ফতোয়া নিষিদ্ধকারী দুই বিচারপতিকে মুরতাদ ঘোষণা করে ফতোয়া জারি করেন। ফতোয়ার সরমর্ম ছিল এরকম—ফতোয়াকে যারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে, তারা আর মুসলিম থাকে না, মুরতাদ হয়ে যায়। ইসলামি আইন অনুযায়ী মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। হাইকোর্টের দুই বিচারপতি গোলাম রব্বানি এবং নাজমুন আরা সুলতানা ফতোয়াকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে মুরতাদ হয়ে গেছেন।

ফতোয়ার সঙ্গে এই দাবিও জানানো হয় যে, মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রেখে আইন পাশ করতে হবে এবং দুই বিচারপতিকে আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিল করতে হবে।

ময়দানে রায়ের মোকাবেলা

মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, মুফতী আমিনী রহ. সাহস করে যখন এই ফতোয়া প্রকাশ করেন, দেশজুড়ে হইচই পড়ে যায়। তথাকথিত সুশীল ঘরানা উঠে পড়ে লাগে মুফতী আমিনী রহ.-এর পেছনে। কিন্তু তিনি নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন। আর ওলামায়ে কেরামও হুজুরের এ সাহসিকতা দেখে তাঁকে সমর্থন করেন। ফলে জানুয়ারি মাসেই দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম একত্রিত হন এবং ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিলের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। বৈঠকে খতিব আল্লামা উবায়দুল হক রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ., চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব ফজলুল করীম রহ.-সহ শীর্ষস্থানীয় সকলেই উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকেই ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়।

মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যাত্রা শুরু হয়। এবং পরবর্তী আন্দোলন এই ব্যানারেই পরিচালিত হয়। জনসমাবেশ থেকে ৩/৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল কর্মসূচি ঘোষিত হয়। আন্দোলনের এই স্পিরিট নষ্ট করতে ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমে মুফতী আমিনী রহ.-কে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর একে একে গ্রেপ্তার করা হয় শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক, আল্লামা আবদুল লতিফ নেজামী, মুফতী ইজহারুল ইসলাম, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীবসহ নেতৃস্থানীয় অনেক আলেমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মুফতী ফয়জুল্লাহ জানান, এসব আলেমকে গ্রেপ্তারের পর আন্দোলনের নেতৃত্বের জায়গায় একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তবে সেটা তাৎক্ষণিকভাবেই পূরণ হয়ে যায় খতিব আল্লামা উবায়দুল হক রহ., আল্লামা মুহিউদ্দীন খান রহ., মুফতী ওয়াক্কাসসহ আমরা যাঁরা বাইরে ছিলাম তাঁদের তৎপরতার কারণে।

এদিকে নেতৃস্থানীয় আলেমদের গ্রেপ্তারের কারণে সারা দেশেই প্রতিবাদ হচ্ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেহেতু মুফতী আমিনী রহ.-এর এলাকা, প্রতিবাদটা সেখানেই বেশি হচ্ছিল। ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হরতাল কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশ ও বিডিআরের গুলিতে শাহাদত বরণ করেন ছয়জন আন্দোলনকারী। তারপর আন্দোলন আরও দুর্বার হয়ে ওঠে।

মুফতী ফয়জুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ তখন ফুরিয়ে এসেছিল। তারা দায়িত্ব ছাড়ার আগে আগেই মুফতী আমিনী ও শায়খুল হাদীস রহ. জামিনে মুক্তি পান। তারপর নির্বাচনের ডামাডোল। পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয় শহিদের বিচার, ক্ষতিপূরণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই ছয় শহিদের স্মরণে শহিদি মসজিদ নির্মাণ এবং ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শহিদ পরিবারগুলোকে একটি করে বাড়ি প্রদান করা ছাড়া তারা আর কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করেনি। মুফতী আমিনী রহ.-সহ জোটভুক্ত দলের ওলামায়ে কেরামের বারংবার চেষ্টা ও অনুরোধের পরও ওই সরকার এসব দাবি বাস্তবায়ন করেনি। অবশেষে ২০১১ সালে দীর্ঘ দশ বছর পর ওলামায়ে কেরামের প্রচেষ্টায় এই রায় বাতিল করে আদালত ফতোয়া বৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করে।


-ফাতেহ২৪

ফতোয়া আন্দোলনে সুশীল, মিডিয়া ও এনজিওদের ভূমিকা


রাকিবুল হাসান:

ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের প্রতিবাদে আলেম এবং মাদরাসাছাত্রসহ সর্বস্তরের তৌহিদি জনতা যখন আন্দোলনে নেমে আসে, তাদের থামিয়ে দেবার জন্য শয়তানের অনকগুলো মাথা গজিয়ে ওঠে। এই জাগরণকে দুর্বল করে দেবার জন্য উঠেপড়ে লাগে শয়তানের মাথাগুলো। এদের মধ্যে অন্যতম হলো সুশীল শ্রেণি, মিডিয়া এবং এনজিও কিংবা মানবাধিকার সংস্থা। সবাই মিলে চেষ্টা করেছে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের পক্ষে একটা শিবির গড়ে তুলতে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা ধোপে টেকেনি।

মিডিয়ার দৌড়ঝাঁপ

ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের সঙ্গে এক আলাপে বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ফতোয়া আন্দোলনে মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে বলেন, ‘ফতোয়া নিষিদ্ধের ক্ষেত্রটাই তৈরি করেছে মিডিয়া। প্রায় এক দশক ধরে তারা বিভিন্নভাবে ফতোয়াকে হেয় করেছে। ব্যভিচার, প্রেম, বিয়ে নিয়ে বিভিন্ন গ্রাম্য সালিশকে ফতোয়া আখ্যা দিয়ে তারা ফলাও করে নিউজ করেছে, স্টোরি করেছে। ‘ফতোয়াবাজ’ শিরোনামে একটি সংখ্যা-ও করেছিল বিচিত্রা ম্যাগাজিন। এভাবে তারা ফতোয়াকে নারী নির্যাতনের একটি হাতিয়ার হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে। আর ফতোয়াকে কলঙ্কিত করার এই প্রচেষ্টারই আইনি প্রতিধ্বনি ছিল ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়।’

মুফতি তৈয়ব সাহেব বলেন, ‘মিডিয়া বরাবরের মতোই সুশীল এবং এনজিওদের পক্ষ নিয়েছে। ফতোয়াবিরোধী নিউজ, নিবন্ধ, ফলোআপ প্রচার করেছে। তবে ফতোয়ার পক্ষে সবচে সরব ছিল মানবজমিন। তারা আলেমদের মতামত, সাক্ষাৎকার, নিবন্ধ ছেপেছে। নিউজ কাভারেজ এবং ফলোআপ করেছে। কাটতির জন্য হোক কিংবা অন্যকিছুর জন্য, তবুও আমাদের মতামত তুলে ধরেছে। এরপরে ইনকিলাবও আমাদের পক্ষে কথা বলেছে। ২০০১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছয়জন ছাত্র শহীদ হলে, ধারাবাহিকভাবে তাদের স্টোরি ছাপায় ইনকিলাব। ছয়দিনে ছয়জনের স্টোরি। পরে এগুলো সম্পাদনা করে একটা বইও করেছিলাম আমি।’

সুশীলদের ভূমিকা

সুশীলরা বরাবরই ছিল ফতোয়া নিষিদ্ধের পক্ষে। ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিলে আপিল শুনানির সময় তারা খুব চেষ্টা করেছে নিষিদ্ধের পক্ষে যুক্তি-তর্ক দাঁড় করাতে। তৎকালীন পত্র-পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতাগুলোতে সুশীলদের কলাম দেখলেই বিষয়টি টের পাওয়া যায়।

২০১০ সালের পয়লা জুন প্রথম আলোর এক নিবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মিজানুর রহমানের বক্তব্য কোট করা হয়। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘কতগুলো ভুল ধারণার ভিত্তিতে আপিল করা হয়েছে। মুসলিম শরিয়া আইন আমাদের আইনি ব্যবস্থার অংশ নয়। শরিয়া আইনের যুক্তির ওপর ভিত্তি করে তারা আরও যেসব যুক্তি দিয়েছে, সেগুলোও একই কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের আইনি কাঠামোতে কোনো আইনি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচার প্রশাসন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। অন্য কেউ এখানে আইনি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। এদিক থেকেও ফতোয়া দেওয়া আইন ও সংবিধানবিরোধী।’

তারপর মিজানুর রহমান ফতোয়ার ওপর আস্ত একটা অপবাদই চাপিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ফতোয়াগুলো একপেশে ও নারীবিরোধী হয়ে থাকে। অথচ আমাদের সংবিধানে বলা আছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আইনে কোনো বৈষম্য করা যাবে না।’

২০১৫ সালের ১১ মার্চ প্রথম আলোতে নিজের লেখা এক প্রবন্ধে মিজানুর রহমান খান আইনজীবী মাহমুদুল ইসলামকে উদ্ধৃত করে লিখেছিলেন, ‘আজকের দিনে মুফতি বলে কিছু নেই। তাই ফতোয়াদানেরও কোনো প্রশ্ন নেই।’ পাশাপাশি তিনি সংবিধানের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে ফতোয়া দেয়া যাবে না মর্মে কিছু প্রবন্ধ পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত করারও আহ্বান জানান।’

ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতি তৈয়ব বলেন, এই সুশীলদের ভয়েই বিএনপি আমাদের আপিলের ফাইল খুলতে দেয়নি। বরং আলেমদেরকে আপিল ফিরিয়ে নিতে চাপ দিয়েছে।

এনজিওদের লম্ফঝম্ফ

ফতোয়া আন্দোলনের শুরু থেকেই এনজিও এবং তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থাগুলো ফতোয়াবিরোধী জনমত দেখানোর চেষ্টা করেছে। আলেমদের মতো তারাও মাঠে এসে হুংকার ছাড়তে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। মুফতি তৈয়ব বলেন, ‘২০০১ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির উদ্যোগে আমরা যেদিন ঢাকায় হরতাল পালন করি, ফতোয়াবিরোধী এক মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিল এনজিওজোট কিন্তু আমাদের হরতাল এত  কঠিন ছিল, তাদের সমাবেশে তেমন কেউ আসতেই পারেনি। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা সমাবেশ করেছে। কিন্তু আলেমদের আন্দোলনের প্রভাবে তাদের সমাবেশ কোনো উত্তাপ ছড়াতে পারেনি।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসময় আওয়াজ তুলে—বাংলাদেশে ফতোয়ার মাধ্যমে অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। তারা উদাহরণ হিসেবে কিছু গ্রাম্য সালিশ তুলে ধরে। যেগুলো মূলত কোনো ফতোয়াই ছিল না। এমনকি আপিলে ফতোয়া নিষিদ্ধের পক্ষে উকালতি করে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসকের আইনজীবী ওবায়েদুর রহমান শুনানি শুরুর আগে ২০১০ সালের পয়লা জুন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ফতোয়ার ফলে মানবাধিকার ও আইন কীভাবে লঙ্ঘিত হয় এবং এর ফলে নারীরা যে নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে, তা শুনানিতে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

এনজিও ও মানবাধিকার কর্মীরা আসলে ফতোয়াকে নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছে। নারীর নিরাপত্তার জন্য ফতোয়াকে হুমকি হিসেবে উল্লেখ করতে চেয়েছে।

-ফাতেহ২৪

ফতোয়ার ছয় শহিদ : যাঁদের রক্তে অর্জিত হয়েছে ফতোয়ার হক

জানুয়ারি ৩১, ২০২০

রাগিব রব্বানি:

সেদিন ছিল ২০০১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। হাইকোর্টের ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় বাতিলের দাবিতে পল্টন ময়দানে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বানে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ. সমাবেশে যোগদানের জন্য লালবাগে তাঁর নিজস্ব কার্যালয় থেকে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এমন সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পল্টনের সমাবেশে তাঁর আর যোগ দেওয়া হয়নি। এই দিনই শায়খুল হাদিস আজিজুল হক রহ.-এর প্রোগ্রাম ছিল দিনাজপুরে। রাতের বেলা প্রোগ্রাম শেষে ঢাকা ফেরার পথে গাজিপুর থেকে তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়-বিরোধী আন্দোলনের মূল কাণ্ডারি ছিলেন এ দুজন। আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সরকার ভেবেছিল আন্দোলনের এই দুই প্রাণপুরুষকে গ্রেপ্তার করলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু ফল দাঁড়াল ঠিক এর বিপরীতটা। জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢেলে দিলে যেমন হয়, পুরো বাংলাদেশ সেভাবে গর্জে উঠল তাঁদের গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে। ৩-৪ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। চলতে থাকে সরকারের দমন-পীড়নও।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বড়হুজুর ও জামিয়া ইউনুছিয়ার তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা সিরাজুল ইসলাম রহ. ৩ ও ৪ ফেব্রুয়ারির হরতালের পর ঘোষণা দেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক এবং মুফতী আমিনীকে মুক্তি না দিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাগাতার আন্দোলন চলবে। ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি হরতালের ঘোষণা দেন। ৫ ফেব্রুয়ারিও মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত থাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর।

৬ ফেব্রুয়ারি ভোর হবার আগে আগেই পুরো শহরে বিডিআর ও পুলিশের বিশেষ ফোর্স মোতায়েন করা হয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী এবং ৬ ফেব্রুয়ারির ৬ শহিদের শাহাদতের প্রত্যক্ষদর্শী মুফতী এনামুল হাসানের সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। তিনি সেদিনকার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ফজরের আগে আগেই বিডিআর ও পুলিশের বিশেষ ফোর্সের উপস্থিতিতে পুরো শহর ছেয়ে যায়। জামিয়া ইউনুছিয়া থেকে নামাজের আগে আগেই অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। ফজরের নামাজের পর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবকয়টি মাদরাসার ছাত্র-উসতাদ এবং শহরের ধর্মপ্রাণ তৌহিদি জনতা হরতাল কর্মসূচি পালনের জন্য রাস্তায় নেমে আসেন।

মুফতী এনাম বলেন, ফজরের পর জামিয়া ইউনুছিয়া থেকে শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সহকারে আমরা শহরের প্রাণকেন্দ্র টিএ রোড হয়ে কালিবাড়ির দিকে যাই। কালিবাড়ি পৌঁছুতেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমাদের বাধা দেয়। আমরা পুনরায় ফিরে আসি টি এ রোডে। এবং এখানেই অবস্থান করে হরতাল কর্মসূচি পালন করতে থাকি।

যেভাবে ঝরে পড়ে ছয়টি তাজাপ্রাণ

মুফতী এনাম বলেন, ধীরে ধীরে বেলা বাড়তে থাকে। পুলিশ এবং বিডিআর সদস্যরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে আমাদের ঘিরে রাখে। আমাদের নানাভাবে বাধা দিতে থাকে, ফলে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও বিডিআর যাকে পারছে, গ্রেপ্তার করছে।

এদিকে সেসময়কার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর মাদরাসার বর্তমান শিক্ষক মাওলানা বোরহানুদ্দীন জানান, বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এবং বিডিআর সদস্যরা আন্দোলনরত জনতার অবস্থানকে ক্রমশ সংকুচিত করে আনছিল। বেলা ১০টার দিকে তারা একটা লাল ব্যানার টাঙিয়ে ঘোষণা করে আন্দোলনকারীরা এই ব্যানার অতিক্রম করে যেতে পারবে না। উত্তেজিত জনতা তখন ব্যানার অতিক্রম করে আর তখনই শুরু হয় পুলিশ ও বিডিআরের নির্বিচার গুলি বর্ষণ।

মুফতী এনামুল হাসান বলেন, সারা শহরেই তারা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি বর্ষণ ও নির্যাতন শুরু করে। আন্দোলনে মাদরাসাছাত্র ছাড়াও সর্বস্তরের তৌহিদি জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। অসংখ্য মানুষ আহত হচ্ছিলেন। দুপুর পর্যন্ত এই তাণ্ডব চালিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় প্রশাসন। ততক্ষণে ছয়টি তাজাপ্রাণ ঝরে পড়েছে। প্রশাসনের নৃশংসতার শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন জামিয়া ইউনুছিয়ার ছাত্র হাফেজ তাজুল ইসলাম ও হাফেজ সাইফুল ইসলাম। সাধারণ তৌহিদি জনতার মধ্য থেকে প্রাণ দিয়েছেন শহিত মুখলিসুর রহমান, শহিদ সুজন, শহিদ আলাউদ্দিন ও শহিদ উসমান। এ চারজনই ছিলেন সাধারণ মানুষ। ধর্মীয় অনুভূতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা এ আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।

মাওলানা বোরহানুদ্দিন ও মুফতী এনাম জানান, প্রশাসনের এ নৃশংসতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সেদিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৌহিদি জনতা থেমে থাকেনি, শহীদদের রক্ত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরদিন থেকে আবারও আরও জোরদার আন্দোলনে নামেন তাঁরা।

কেমন আছে ৬ শহিদের পরিবার?

মাওলানা বোরহানুদ্দীনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ৬ শহিদের পরিবারগুলো সম্পর্কে। তিনি জানান, ফতোয়া আন্দোলনের পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে এবং মুফতী আমিনী রহ. তখন এমপি হন। তিনি ছয় শহিদের প্রত্যেকের পরিবারকে সরকারিভাবে একটি করে বাড়ির ব্যবস্থা করে দেন।

শহরের পনিয়াউট এলাকায় ৩২ শতাংশ জায়গার ওপর টিনশেড ঘর নির্মাণ করে ছয় পরিবারের প্রত্যেকের জন্য তিন রুমের বাসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শহিদ মুখলেস ছিলেন বিবাহিত। তাঁর শাহাদতের পর তাঁর স্ত্রীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায় এবং তাঁর বাবাও মারা যান। ফলে তাঁর নামে বরাদ্দ বাসা ভাড়া দিয়ে ভাড়ার টাকা নিচ্ছেন তাঁর স্ত্রী। শহিদ সুজন অবিবাহিত, তাঁর বাবাও মারা গেছেন। বর্তমানে তাঁর মা বাসাটি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। আর বাকি চার শহিদের পরিবার তাঁদের নামে বরাদ্দ বাসাগুলোতেই অবস্থান করছেন।

শহিদদের রক্তের বিচার হয়েছে?

ফতোয়া আন্দোলনে শাহাদতবরণকারী এই ছয় শহিদের রক্তের বিচার কি হয়েছে? জানতে চেয়ে কথা বলেছিলাম ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও ফতোয়া আন্দোলনের অন্যতম নেতা মুফতী মুহাম্মদ তৈয়বের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ফতোয়া আন্দোলনের সেই সময়টা ছিল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মুহূর্ত। নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট তখন আওয়ামী লীগের ইসলাম-বিরোধিতা ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের কারণে তৈরি ধর্মপ্রাণ মানুষের সিম্প্যাথিকে কাজে লাগিয়ে বিজয়ী হয়েছিল। নির্বাচনে তারা ওয়াদা দিয়েছিল ফতোয়া-বিরোধী রায় বাতিল করার পাশাপাশি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছয় শহিদের বিচার ও তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে একটি করে বাড়ি তৈরি করে দেবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মুফতী আমিনী রহ.-এর প্রচেষ্টায় ছয় শহিদের পরিবারকে একটি করে বাড়ি দিলেও তাদের পাঁচ বছরের শাসনামলে শহিদের বিচার তো দূরের কথা, ফতোয়া-বিরোধী রায়টা পর্যন্ত বাতিল করেনি বিএনপি-জামায়াত প্রভাবিত জোট।

মুফতী তৈয়ব জানান, মুফতী আমিনী ও শায়খুল হাদীস রহ. বারবার অনুরোধ এবং নিজেদের সর্বাত্মক চেষ্টা দিয়ে সরকারকে বলেছেন এইসব বিষয়ে, কিন্তু বিএনপি তাঁদের কথা কানেই তুলতে রাজি হয়নি। মুফতি আমিনী রহ. তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আলেমদের সঙ্গে বিএনপির এই গাদ্দারি খুব শিগগির তাদের দীর্ঘ পতন ডেকে আনবে।

মুফতী তৈয়ব বলেন, আজ হয়েছেও তাই। বিএনপির বর্তমান যে দুর্দশা, অদূর ভবিষ্যতে আর কখনও তারা ক্ষমতায় আসতে পারবে কি-না, সন্দেহ। তবে ছয় শহিদের রক্ত বৃথা যায়নি। তাঁদের শাহাদাতের হয়তো বিচার হয়নি, কিন্তু যে আওয়ামী লীগ ফতোয়া-নিষিদ্ধের রায় দিয়েছিল, সে আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করেছে।

একদিন হয়তো এভাবেই ছয় শহিদের রক্তের বিচার হবে এই মাটিতে। বিচার হবে ইসলামি আন্দোলন-সংগ্রামে বিগত দিনে আরও যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, পান করেছেন শাহাদতের অমীয় সুধা, তাঁদের তপ্ত খুনের। এমনটাই আশা ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মুফতী মুহাম্মদ তৈয়বের।


-ফাতেহ২৪

Thursday, January 30, 2020

বাল্যবিবাহ কখন অপরাধ নয়

বাল্যবিবাহবিরোধী আইনের কিছু ধারার ক্ষেত্রে বিশেষ কারণে বিশেষ বিধান মতে অপরাধ বলে গণ্য হবে না।


বিশেষ বিধান আইনের ধারায় এভাবে উল্লেখ করে হয়েছেঃ

"এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।"

আইনের পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ 
"এই আইন বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ নামে অভিহিত হইবে।
ইহা অবিলম্বে কার্যকর হইবে।"


আইনে উল্লেখিত শব্দগুলোর ব্যাখ্যাঃ 

“অপ্রাপ্ত বয়স্ক” অর্থ বিবাহের ক্ষেত্রে ২১ (একুশ) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ (আঠারো) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো নারী।

“অভিভাবক” অর্থ Guardians and Wards Act, 1890 (Act No. VIII of 1890) এর অধীন নিয়োগপ্রাপ্ত বা ঘোষিত অভিভাবক এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির ভরণ-পোষণ বহনকারী ব্যক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত হবে।

“প্রাপ্ত বয়স্ক” অর্থ বিবাহের ক্ষেত্রে ২১ (একুশ) বৎসর পূর্ণ করিয়াছেন এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ (আঠারো) বৎসর পূর্ণ করিয়াছেন এমন কোনো নারী।

“বাল্যবিবাহ” অর্থ এইরূপ বিবাহ যার কোন এক পক্ষ বা উভয় পক্ষ অপ্রাপ্ত বয়স্ক।

“বিধি” অর্থ এই আইনের অধীন প্রণীত বিধি।


বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেছে সরকার।
বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জাতীয়, জেলা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা এবং স্থানীয় পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তি সমন্বয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন এবং কার্যাবলি নির্ধারণ করতে পারবে।

বাল্যবিবাহ বন্ধে কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধির সাধারণ ক্ষমতা     
ধারা ৫ এর বিধানের সামগ্রিকতাকে ক্ষুণ্ন না করে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা, উপজেলা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি কোন ব্যক্তির লিখিত বা মৌখিক আবেদন অথবা অন্য কোন মাধ্যমে বাল্যবিবাহের সংবাদ প্রাপ্ত হলে তিনি উক্ত বিবাহ বন্ধ করবেন অথবা বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।


বাল্যবিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গের শাস্তি     
(১) আদালত, স্ব-উদ্যোগে বা কোন ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে বা অন্য কোন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, যদি এই মর্মে নিশ্চিত হন যে, কোন বাল্যবিবাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইয়াছে অথবা বাল্যবিবাহ অত্যাসন্ন তাহা হইলে আদালত উক্ত বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিতে পারিবে।

(২) আদালত স্বেচ্ছায় বা অভিযোগকারী ব্যক্তির আবেদনের ভিত্তিতে উপ-ধারা (১) এর অধীন প্রদত্ত আদেশ প্রত্যাহার করিতে পারিবে।

(৩) কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করিলে তিনি অনধিক ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ১ (এক) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।
মিথ্যা অভিযোগ করিবার শাস্তি     
৬। কোন ব্যক্তি ধারা ৫ এর অধীন মিথ্যা অভিযোগ করিলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৩০ (ত্রিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ১ (এক) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

বাল্যবিবাহ করার শাস্তি     
(১) প্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্যবিবাহ করিলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

(২) অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোন নারী বা পুরুষ বাল্যবিবাহ করিলে তিনি অনধিক ১ (এক) মাসের আটকাদেশ বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তিযোগ্য হইবেন:

তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৮ এর অধীন কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বা দণ্ড প্রদান করা হইলে উক্তরূপ অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী বা পুরুষকে শাস্তি প্রদান করা যাইবে না।

(৩) উপ-ধারা (২) এর অধীন বিচার ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে শিশু আইন, ২০১৩ (২০১৩ সনের ২৪ নং আইন) এর বিধানাবলী প্রযোজ্য হইবে।
বাল্যবিবাহ সংশ্লিষ্ট পিতা-মাতাসহ অন্যান্য ব্যক্তির শাস্তি     
৮। পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা অন্য কোন ব্যক্তি, আইনগতভাবে বা আইনবহির্ভূতভাবে কোন অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির উপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন হইয়া বাল্যবিবাহ সম্পন্ন করিবার ক্ষেত্রে কোন কাজ করিলে অথবা করিবার অনুমতি বা নির্দেশ প্রদান করিলে অথবা স্বীয় অবহেলার কারণে বিবাহটি বন্ধ করিতে ব্যর্থ হইলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর ও অন্যূন ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।
বাল্যবিবাহ সম্পাদন বা পরিচালনা করিবার শাস্তি     
৯। কোন ব্যক্তি বাল্যবিবাহ সম্পাদন বা পরিচালনা করিলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর ও অন্যূন ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।
বাল্যবিবাহ বন্ধে উদ্যোগী হইবার শর্তে বাল্যবিবাহের অভিযোগ হইতে অব্যাহতি     
১০। এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, আদালতের নিকট উপযুক্ত বলিয়া বিবেচিত হইলে বাল্যবিবাহের উদ্যোগের সহিত জড়িত বিবাহ সম্পন্ন হয় নাই এইরূপ অভিযুক্ত যে কোন ব্যক্তি, বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে, যদি এই মর্মে মুচলেকা বা বণ্ড প্রদান করেন যে, তিনি ভবিষ্যতে বাল্যবিবাহের সহিত সম্পৃক্ত হইবেন না এবং তাহার নিকটবর্তী এলাকায় বাল্যবিবাহ বন্ধে উদ্যোগী হইবেন তাহা হইলে মুচলেকা বা বণ্ডের শর্তানুযায়ী তাহাকে তাহার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ হইতে অব্যাহতি প্রদান করা যাইবে।
বাল্যবিবাহ নিবন্ধনের জন্য বিবাহ নিবন্ধনের শাস্তি, লাইসেন্স বাতিল     
১১। কোন বিবাহ নিবন্ধক বাল্যবিবাহ নিবন্ধন করিলে উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনধিক ২ (দুই) বৎসর ও অন্যূন ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং অর্থদণ্ড অনাদায়ে অনধিক ৩ (তিন) মাস কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং তাহার লাইসেন্স বা নিয়োগ বাতিল হইবে।

ব্যাখ্যা: এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, “বিবাহ নিবন্ধক” অর্থ Muslim Marriages and Divorces (Registration) Act, 1974 (Act No. LII of 1974) এর অধীন লাইসেন্সপ্রাপ্ত নিকাহ্‌ রেজিষ্ট্রার এবং Christian Marriage Act, 1872 (Act No. XV of 1872), Special Marriage Act, 1872 (Act No. III of 1872) ও হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২ (২০১২ সনের ৪০ নং আইন) এর অধীন নিয়োগপ্রাপ্ত বিবাহ নিবন্ধক।
বয়স প্রমাণের দলিল     
১২। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ বা আবদ্ধ হইতে ইচ্ছুক নারী বা পুরুষের বয়স প্রমাণের জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয় পত্র, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট, প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট অথবা পাসপোর্ট আইনগত দলিল হিসাবে বিবেচিত হইবে।
ক্ষতিপূরণ প্রদান     
১৩। (১) এই আইনের অধীন আরোপিত অর্থদণ্ড হইতে প্রাপ্ত অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রদান করিতে হইবে।
ব্যাখ্যা: উপ-ধারা (১) এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে “ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ’’ অর্থ বাল্যবিবাহের যে পক্ষ অপ্রাপ্ত বয়স্ক।
(২) উপ-ধারা (১) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ধারা ৭ এর উপ-ধারা (২) এর অধীন আরোপিত জরিমানা হইতে প্রাপ্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হইবে।
অপরাধের আমলযোগ্যতা, জামিনযোগ্যতা এবং অ-আপোষযোগ্যতা     
১৪। এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য এবং অ-আপোষযোগ্য হইবে।
বিচার পদ্ধতি     
১৫। এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হইবে এবং এতদুদ্দেশ্য Code of Criminal Procedure, 1898 (Act No. V of 1898) এর Chapter XXII এ বর্ণিত পদ্ধতি প্রযোজ্য হইবে।
সরেজমিনে তদন্ত     
১৬। আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন কোন অভিযোগ বা কার্যধারা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ঘটনার সত্যতা নিরূপণের নিমিত্ত আদালত সরেজমিনে তদন্ত করিতে পারিবে অথবা কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বা অন্য কোন ব্যক্তিকে উক্তরূপ তদন্ত করিবার নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে এবং উক্তরূপ তদন্ত কাজ ৩০ (ত্রিশ) কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করিতে হইবে:

তবে শর্ত থাকে যে, যুক্তিসঙ্গত কারণে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে তদন্তকার্য সমাপ্ত করার সম্ভব না হইলে কারণ উল্লেখপূর্বক অতিরিক্ত ১৫ (পনের) কার্যদিবসের মধ্যে তদন্তকার্য সম্পন্ন করিতে হইবে এবং তৎসম্পর্কে আদালতকে লিখিতভাবে অবহিত করিতে হইবে।
মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর প্রয়োগ     
১৭। আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে, মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ (২০০৯ সালের ৫৯ নং আইন) এর তফসিলভুক্ত হওয়া সাপেক্ষে, মোবাইল কোর্ট দণ্ড আরোপ করিতে পারিবে।
অপরাধ আমলে নেয়ার সময়সীমা     
১৮। এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হইবার ২(দুই) বৎসরের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করা না হইলে আদালত উক্ত অপরাধ আমলে গ্রহণ করিবে না।
বিশেষ বিধান     
১৯। এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোন বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।
বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা     
২০। এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা বিধি প্রণয়ন করিতে পারিবে।
রহিতকরণ ও হেফাজত     
২১। (১) Child Marriage Restraint Act, 1929 (Act No. XIX of 1929), অতঃপর উক্ত Act বলিয়া উল্লিখিত, এতদ্দ্বারা রহিত করা হইল।

(২) উপ-ধারা (১) এর অধীন রহিতকরণ সত্ত্বেও উক্ত Act এর অধীন -

(ক) কৃত কোন কাজ বা গৃহীত কোন ব্যবস্থা এই আইনের অধীনকৃত বা গৃহীত বলিয়া গণ্য হইবে;

(খ) দায়েরকৃত কোন মামলা বা কার্যধারা কোন আদালতে চলমান থাকিলে উহা এমনভাবে নিষ্পত্তি করিতে হইবে যেন উক্ত Act রহিত হয় নাই।
ইংরেজিতে অনূদিত পাঠ প্রকাশ     
২২। (১) এই আইন প্রবর্তনের পর সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, এই আইনের বাংলা পাঠের ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ (Authentic English Text) প্রকাশ করিবে।


-শামসুল আরেফিন মনজু

Friday, January 10, 2020

মুরসিকে ২০১৯ এর ম্যান অফ দা ইয়ার ঘোষণা

ইটালিয়ান নিউজপেপার লা লিউস মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ২০১৯ সালের ম্যান অফ দ্য ইয়ার ঘোষণা করেছে। এবং এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছে "মৃত্যু পর্যন্ত সে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে"। সে তার শেষ বক্তব্যে বলেছিল,
আমরা সবাই আমাদের দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। এবং আমিই হবো প্রথম ব্যক্তি। শরিয়ত রক্ষায় ত্যাগ শিকার করতে গিয়ে যদি আমার রক্ত দিতে হয় তাহলে আমি রক্তকে বিনিময়ে হিসেবে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।" 
সে তার আদর্শের সাথে আপোষ না করায় শেষ পর্যন্ত তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে স্বৈরাচার সিসি প্রশাসন। 

২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে মিসরের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার পেছনে মুরসির অবদান ও দূর্নীতি বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের প্রশংসা করেছে লা লিউস। 

জেনারেল কাসেম সুলেমানীকে হত্যার পর বার্নি স্যান্ডারসের বক্তব্য

কাসেম সুলেমানীকে হত্যার পর পরই এক বক্তব্যে আগামী নির্বাচনের ডেমোক্রেটের প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট বার্নি স্যান্ডার্স বলে,
"ট্রাম্প বলেছিল সে প্রেসিডেন্ট বুশের ঘোষিত অনন্ত যুদ্ধকে শেষ করবে। কিন্তু ট্র‍্যাজিকলি তার সিদ্ধান্ত আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি ধংসাত্মক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷ আমি যখন ২০০২ সালে ইরাক যুদ্ধের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলাম তখন এই আশংকা করেছিলাম যে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ইরাকে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরী করবে। দুঃখজনকভাবে আজ ১৭ বছর পর তা সত্য বলে প্রমাণ হয়েছে৷ দূর্নীতি আর দারিদ্রের চরম ভয়াবহ প্রকোপের পর এখন ইরাকিরা এখন চাচ্ছে আমেরিকা ইরাক থেকে তাদের সৈন্য সরিয়ে নিক।
 
আমি যুদ্ধ থেকে ফেরা অনেক আমেরিকা  সেনাদের ফিউনারেলে গিয়েছি। নিহত সেনাদের মায়েদের সাথে কথা বলেছি। সেসব সেনাদের সাথেও কথা বলেছি যারা যুদ্ধে পঙ্গু হয়ে দেশে ফিরেছে। আমি খুব ভাল করেই জানি যেসব পরিবারগুলো আমেরিকার বেপরোয়া পররাষ্ট্রনীতির ফলে চরম ভুক্তভোগী হচ্ছে তাদের মধ্যে ধনি পরিবারের সংখ্যা একেবারেই কম। 
আমাদের এখন যুদ্ধ শেষ করে নিজেদের দেশের দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত৷ যেখানে হোমলেস জনগণের সংখ্যা পাচ লাখ। আমাদের ডলার নিজেদের জনগণের প্রয়োজনে খরচ করতে হবে। আরো ট্রিলিয়ন ডলার খরচের অনন্ত যুদ্ধে নয়।"

৩ জানুয়ারি ২০২০ 

Friday, January 3, 2020

পর্দায় মুখ ঢাকার ব্যাপারে হানাফি মাযহাবের মত

পর্দা ইস্যুতে কালকে দেখলাম একজন শায়েখ জমহুর আর জমহুরে ফুকাহার পার্থক্য গুলিয়ে ফেলেছেন। যেসব হাদীস দিয়ে ইবনে হুমাম ইমাম আবু হানীফার মতের পক্ষে ইসতেদলাল করেছেন, সেইসব হাদীস দলীল হবে কি না সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আজকে দেখলাম আরেকজন সুপরিচিত সুযোগ্য শায়েখ লিখেছেন, 

‘মজার ব্যাপার হলো, ফিকহের কিতাবে মহিলাদের চেহারা, হাতের ও পায়ের পাতাকে ‘আওরাত’ বলা হয়নি। বয়ানে দেখলাম, এটাকে আজহারী সাহেব মুখ খোলা রাখার পক্ষের দলিল হিসেবে উপস্থাপন করছেন। অথচ ফিকহের প্রাথমিক স্তরের একটা ছেলেও জানে, এখানে মুখ-হাতের ও পায়ের পাতা ঢাকতে হবে না বলতে বুঝানো হয়েছে, নামাজের মধ্যে এই অংশগুলো খোলা থাকলে নামাজ ভংগ হবে না।’

এই কথাটা খুবই হাস্যকর লাগলো। ফেকাহর কিতাবে নামাযের অধ্যায়ে সতরের আলোচনা হয়। এর বাইরে নজর বা নারীর কতটুকু দেখা বৈধ ওই আলোচনা যে করা হয় সেটা কিসের আলোচনা? সেটাও কি নামাযের আওরাতের আলোচনা? 
দেখুন কওমি মাদরাসায় পাঠ্য হানাফী ফিকাহর বিখ্যাত কিতাব হেদায়ার মুসান্নিফ কী লিখেছেন:

قَالَ ( وَلَا يَجُوزُ أَنْ يَنْظُرَ الرَّجُلُ إلَى الْأَجْنَبِيَّةِ إلَّا وَجْهَهَا وَكَفَّيْهَا ) لِقَوْلِهِ تَعَالَى { وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا } قَالَ عَلِيٌّ وَابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا ؛ مَا ظَهَرَ مِنْهَا الْكُحْلُ وَالْخَاتَمُ ، وَالْمُرَادُ مَوْضِعُهُمَا وَهُوَ الْوَجْهُ وَالْكَفُّ ، كَمَا أَنَّ الْمُرَادَ بِالزِّينَةِ الْمَذْكُورَةِ مَوْضِعُهَا ، وَلِأَنَّ فِي إبْدَاءِ الْوَجْهِ وَالْكَفِّ ضَرُورَةً لِحَاجَتِهَا إلَى الْمُعَامَلَةِ مَعَ الرِّجَالِ أَخْذًا وَإِعْطَاءً وَغَيْرَ ذَلِكَ ، وَهَذَا تَنْصِيصٌ عَلَى أَنَّهُ لَا يُبَاحُ النَّظَرُ إلَى قَدِمَهَا .
وَعَنْ أَبِي حَنِيفَةَ أَنَّهُ يُبَاحُ ؛ لِأَنَّ فِيهِ بَعْضَ الضَّرُورَةِ .
وَعَنْ أَبِي يُوسُفَ أَنَّهُ يُبَاحُ النَّظَرُ إلَى ذِرَاعِهَا أَيْضًا ؛ لِأَنَّهُ قَدْ يَبْدُو مِنْهَا عَادَةً

গায়রে মাহরাম নারীর চেহারা এবং দুই হাতের পাতা ছাড়া অন্য কোনো অঙ্গ দেখা পুরুষের জন্য বৈধ নয়। দলিল কুরআনের আয়াত: ‘তারা তাদের অলঙ্কার প্রকাশ করবে না তবে যা আপনাতেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে’। আলী ও ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, আপনাতেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে শুরমা ও আঙটি। উদ্দেশ্য হলো শুরমা ও আঙটির জায়গা অর্থাৎ চেহারা এবং হাতের পাতা। যেনো অলঙ্কার বলে অলঙ্কার পরিধানের জায়গা উদ্দেশ্য। আকলী দলিল হলো: চেহারা এবং হাতের পাতা প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়ে পুরুষের সাথে তার মুআমালা, লেন-দেন ইত্যাদি প্রয়োজনে। এই কথা থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় পুরুষের জন্য নারীর পা দেখা বৈধ নয়। তবে ইমাম আবু হানীফা থেকে এক বর্ণনায় আছে যে পা দেখাও বৈধ। কারণ মাঝে মাঝে পা খুলে রাখারও প্রয়োজন পড়ে। ইমাম আবু ইউসুফ থেকে বর্ণিত, নারীর হাতের নলা দেখাও বৈধ। কারণ কখনও কখনও স্বভাবত তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। 

এর শরাহ করতে গিয়ে ফতহুল কাদীরে ইবনে হুমাম লিখেছেন,

فَالْأَوْلَى فِي الِاسْتِدْلَالِ عَلَى ذَلِكَ هُوَ الْمَصِيرُ إلَى مَا جَاءَ مِنْ الْأَخْبَارِ فِي الرُّخْصَةِ فِي النَّظَرِ إلَى وَجْهِهَا وَكَفَّيْهَا: مِنْهَا مَا رُوِيَ «أَنَّ امْرَأَةً عَرَضَتْ نَفْسَهَا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - فَنَظَرَ إلَى وَجْهِهَا وَلَمْ يَرَ فِيهَا رَغْبَةً» . وَمِنْهَا مَا رُوِيَ «أَنَّ أَسْمَاءَ بِنْتَ أَبِي بَكْرٍ دَخَلَتْ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - وَعَلَيْهَا ثِيَابٌ رِقَاقٌ، فَأَعْرَضَ عَنْهَا رَسُولُ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - وَقَالَ: يَا أَسْمَاءُ إنَّ الْمَرْأَةَ إذَا بَلَغَتْ الْمَحِيضَ لَمْ يَصْلُحْ أَنْ يُرَى مِنْهَا إلَّا هَذَا وَهَذَا وَأَشَارَ إلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ» وَمِنْهَا مَا رُوِيَ " أَنَّ فَاطِمَةَ - رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا - لَمَّا نَاوَلَتْ أَحَدَ ابْنَيْهَا بِلَالًا أَوْ أَنَسًا قَالَ: رَأَيْت كَفَّهَا كَأَنَّهَا فَلْقَةُ قَمَرٍ ": أَيْ قِطْعَتُهُ، فَدَلَّ عَلَى أَنْ لَا بَأْسَ بِالنَّظَرِ إلَى وَجْهِ الْمَرْأَةِ وَكَفِّهَا

উত্তম হলো এই মতের পক্ষে চেহারা এবং দুই হাত দেখার বৈধতা সম্বলিত হাদীস দিয়ে দলীল দেওয়া; এরকম একটি হাদীস হলো, একজন নারী নিজেকে রসূল সা.-এর জন্য পেশ করেছিলো তিনি তার চেহারার দিকে তাকিয়েছিলেন কিন্তু তার প্রতি আগ্রহী হননি। আরও একটি হাদীস হলো, আসমা বিনতে আবী বকর রা. রসূল সা.-এর কাছে গেলেন। তার গায়ে পাতলা কাপড় ছিলো। রসূল সা. মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন, হে আসমা একজন নারী যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন তার এটা এবং এটা ছাড়া প্রকাশিত থাকতে পারে না এবং তিনি হাতের পাতা ও চেহারার দিকে ইশারা করলেন। আরেকটি বর্ণনায় আছে, ফাতেমা রা. যখন তার কোনো ছেলেকে বিলাল বা আনাসের কাছে দিতেন তিনি বলেন, আমি তার হাতের পাতা দেখেছি যেনো তা চাঁদের একটি টুকরা। এ থেকে বোঝা যায় চেহারা এবং হাতের পাতার দিকে তাকলে সমস্যা নাই। 

দেখেন ইবনে হুমামও প্রাথমিক ছাত্রদের মতো না বুঝে কোন কথার পক্ষে কী দলিল দিলেন! হায়্রে!

ফারুক ফেরদাউস

Wednesday, January 1, 2020

জান্নাত জাহান্নামকে স্মরণে রেখে জীবনে লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত

আপনার ২০২০ সালের resolution আপনাকে সফলতা দিবে না ব্যর্থতা দিবে যখন আপনি সৃৃষ্টিকর্তার কাছে পৌছাবেন?

“শেখ আব্দুল্লাহ আল শাংকিতি যিনি মদিনার অন্যতম আলেম, এবং তিনি তাফসির ও উসুল ( ইসলামি আইনের মূলনীতি) এর একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক। তিনি জাহান্নামে যাওয়ার ৪ টি কারণ এবং জান্নাতে যাওয়ার ৪ টি কারণ ব্যাখ্যা করেছেন

তিনি পড়লেন-

আল-মুদ্দাসসির ৭৪:৪২
مَا سَلَكَكُمْ فِى سَقَرَ

‘তোমাদেরকে কিসে ‘সাকার’(জাহান্নামে) - এ নিক্ষেপ করেছে?’

এবং তাঁর আঙ্গুল দেখিয়ে গুনতে বললেন, 

আল-মুদ্দাসসির ৭৪:৪৩

قَالُوا۟ لَمْ نَكُ مِنَ ٱلْمُصَلِّينَ
তারা বলবে ‘আমরা সালাত (নামাজ) আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না 
তিনি বললেন- এটাই প্রথম কারণ। 

আল-মুদ্দাসসির ৭৪:৪৪
وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ ٱلْمِسْكِينَ

আর আমরা অভাবগ্ৰস্তকে খাদ্য দান করতাম না 
তিনি বললেন- এটা দ্বিতীয় কারণ।

আল-মুদ্দাসসির ৭৪:৪৫
وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ ٱلْخَآئِضِينَ
এবং আমরা অর্থহীন বিনোদন কারীদের মধ্যে থাকতাম।
তিনি বললেন- এটাই তৃতীয় কারণ।

আল- মুদ্দাসিসর ৭৪:৪৬
وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ ٱلدِّينِ
আমরা কিয়ামতের দিন কে অস্বীকার করেছিলাম।

তিনি বললেন- এটিই চতুর্থ কারণ।

জান্নাতে যাওয়ার চারটি কারণঃ

আল-মু’মিনূন ২৩:১
 قَدْ أَفْلَحَ ٱلْمُؤْمِنُونَ 
অবশ্যই মু'মিনগণ বিশ্বাসী।

আল-মু’মিনূন ২৩:২
 ٱلَّذِينَ هُمْ فِى صَلَاتِهِمْ خَٰشِعُونَ 
যারা তাদের সালাত আদায়ে বিনয়ী।

আল-মু’মিনূন ২৩:৩
 وَٱلَّذِينَ هُمْ عَنِ ٱللَّغْوِ مُعْرِضُونَ 
আর যারা অর্থহীন কর্মকাণ্ডে বিমুখ।

আল-মু’মিনূন ২৩:৪
 وَٱلَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَوٰةِ فَٰعِلُونَ 
এবং যারা যাকাত আদায়ে করে।

এরপর তিনি বললেন- একদল গরীবদের যাকাত দান করতেন এবং আরেকদল গরীবদের অভুক্ত রাখত। এবং 

একদল সমালোচনা থেকে বিরত থাকত এবং আরেকদল অর্থহীন সমালোচনায় লিপ্ত থাকত।
 এবং একদল তাদের ইবাদতে মনোযোগী ছিলেন অন্যদিকে আরেকদল কখনোই ইবাদতে শামিল হত না।
এবং একদিকে বিশ্বাসীগণ সফল,
অন্যদিকে একদল আখিরাতে বিশ্বাসী না।
তারপরে তিনি হেসে বললেন, "কুরআন ধনসম্পদে পরিপূর্ণ, আমাদের কেবল তাতে ডুবে যেতে হবে!"

-ইয়াহইয়া আমিন

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...