Monday, September 25, 2017

বাংলাদেশের যমিন উশরি না খারাজি

প্রশ্ন : বাংলাদেশী জমি উশরি না খারাজি?

উত্তর : বাংলাদেশের জমি তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
১. যেসব জমি ধারাবাহিকভাবে ব্রিটিশ শাসনের আগ থেকে মুসলমানদের মালিকানায় চলে আসছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, সেগুলোকে উশরি ধরে উশর আদায় করা কর্তব্য।
২. যেসব জমি বিধর্মীর হাত থেকে মুসলমানদের হাতে এসেছে বলে প্রমাণিত, সেগুলোকে খারাজি গণ্য করে প্রতি বছর একবার খারাজ বা ট্যাক্স আদায় করতে হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে খাজনা নেয়া হয় তাতে দাতা যদি খারাজ আদায়ের নিয়ত করে তাহলে খাজনা দ্বারাই খারাজি বা ট্যাক্স আদায় হয়ে যাবে।
৩. আর যদি উল্লিখিত কোনো সুরত জানা না যায় বা সন্দেহ হয়, সে ক্ষেত্রে সতর্কতা হিসেবে উশর আদায় করা ভালো। (সূত্র : রদ্দুল মুহতার : ৪/১৯২, বাদায়ে সানায়ে : ২/৫৮, জাওয়াহিরুল ফিক্বহ-২/২৬১, ফাতাওয়া উসমানী : ২/১২৭)।

সূত্রঃ মাওলানা সাদেকুল ইসলাম, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ঢাকা
  

ফসলের যাকাত বা উশরঃ

বাংলাদেশের জমি উশরী না খারাজী , বর্তমানে এব্যপারে সিদ্ধান্ত দেওয়া অত্যন্ত জটিল বরং অসম্ভব। এ দেশকে উলামায়ে কেরাম একসময় দারুল হরব বলে ঘোষনা করেছিলেন। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের জমি উশরী বা খারাজী কোনটিই হতে পারে না।
 
তবে ফিকহী দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করলে বুঝে আসে উক্ত হুকুম ঐ সকল দারুল হরব সম্পর্কে, যা পূর্বে থেকে দারুল হরব ছিল। আর আমাদের দেশ পূর্বে দারুল হরব ছিল না। বরং আটশত বছর দারুল ইসলাম থাকার পর দারুল হরব হয়েছিল। কজেই উক্ত হুকুম আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে না। আবার ইংরেজরা এদেশের ক্ষমতা দখলের পর যে সমস্ত জমি মুসলমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তাদের মালিকানা বাতিল করে হিন্দুদেরকে জমিদারী প্রদান করেছিল, ঐসকল জমিও উশরী নয়। তবে এধরনের জমি খুজেঁ বের করাও কঠিন। এক্ষেত্রে উলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্ত হল যে সকল জমি ধারাবাহিক ভাবে মুসলমানদের মালিকানায় চলে আসছে বলে প্রমান পাওয়া যায় সেগুলোকে উশরী ধরে উশর আদায় করবে।
  
আর যে সকল জমির ক্ষেত্রে জানা যায় যে, উক্ত জমি বিধর্মীর হাত থেকে মুসলমানদের হাতে এসেছে তবে তা খারাজী হিসাবে গন্য হবে এবং তার খারাজ আদায় করবে। যা প্রতিবছর একবার বর্তাবে। যদি উল্লে¬খিত সূরত জানা না যায় বা সন্দেহ হয় তবে সতর্কতা হিসাবে উশর আদায় করবে।

সূত্রঃ মুফতি হুসাইন সাহেব

বাংলাদেশের ভূমি ওশরী না খারাজী ?
 
বাংলাদেশের ভূমি ওশরী না খারাজী এ ব্যাপারে একদল ওলামা বলেন খারাজী। তাদের যুক্তি হলো, বাংলাদেশ ছিল পৌত্তলিকদের দেশ। এখানে সর্বপ্রথম মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান কুতুবুদ্দীন আইবেক এর সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা বিজয় করেন। বিজয়ের পর তিনি বাংলাদেশের ভূমি মুসলমানদের মাঝে গণিমতের মাল হিসেবে বন্টন করেছিলেন কিনা একথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
  
তবে স্বাভাবিক যুক্তিতে এ কথাই বুঝে আসে যে, এ বিশাল বাংলা যেমন পূর্বে হিন্দুদের হাতে ছিল, এমন জমীন ছিল রাষ্ট্রের অধীন, তেমনি রেখে দিয়েছিলেন বখতিয়ার খিলজী। তাদের সাথে খারাজের চুক্তি সাধন । করেন, ওশরের নয়। কারণ ওশর কাফেরদের সাথে হয় না। যা তার নিযুক্ত গভর্নরের মাধ্যমে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত পৌঁছত। আর আমরা জানি, মুসলিম বাহিনী কর্তৃক বিজিত এলাকা মুসলমানদের মাঝে বন্টন না করলে তা খারাজী ভূমি হিসেবেই বাকি থাকে। আর যে ভূমিতে একবার খারাজ সাব্যস্ত হয়, তা চিরকাল খারাজীই থাকে। সুতরাং, এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, বাংলাদেশের ভূমি খারাজী। ওশরী নয়। (ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ন: ৩০৭-৩০৮)

সূত্রঃ মাওলানা লুৎফুর রহমান ফরায়েজি

Saturday, September 23, 2017

সিরিয়া যুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ


সিরিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আগে এর পক্ষ বিপক্ষগুলো বুঝে নেওয়াটা জরুরী। এই যুদ্ধক্ষেত্রে মোটাদাগে পক্ষগুলোকে দেখলে  চারটি পক্ষ দেখা যাবে।

১ সরকার প্রধান বাশার আল আসাদ ও তার বাহিনী 
২ বিদ্রোহী গ্রুপ, যারা সরকার পতনের ডাক দিয়েছে
৩ আইএস 
৪ কুর্দি

এদের প্রত্যেকের সাথেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৈদেশিক মিত্রের মদদ আছে।কিন্তু বিষয় হল বিদেশী মদদদাতাদের মধ্যে অনেকেই সরাসরি স্বীকার করে না যে সিরিয়া যুদ্ধে কে কাকে কিভাবে সাহায্য করছে। যার ফলে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে গভীর নজর না রাখলে পক্ষ বিপক্ষ নির্ণয় করতে চরম সংশয়ে পড়তে হয়। 

নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে যারা নিয়মিত সিরিয়া যুদ্ধের খবরাখবর রাখেন তারা জেনে থাকবেন, স্বাভাবিকভাবে নিয়ম মত দুই পক্ষের সংঘাতের মাধ্যমেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। একদিকে ছিল সরকার প্রধান বাশার আল আসাদ ও তার বাহিনী, অন্যদিকে সরকার পতনের আন্দোলনে নামা বিদ্রোহী গ্রুপ। 

যুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে একদিকে বিদ্রোহীগ্রুপদের সমর্থন দিয়েছে সৌদি, তুরস্ক, জর্ডান আর আমেরিকার ট্রাম্প এডমিনিস্ট্রেশন। 
অন্যদিকে সরকার প্রধান বাশার আল আসাদের সমর্থনে ছিল রাশিয়া, ইরান ও লেবাননের শিয়া অধ্যুষিত সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। বলাবাহুল্য, হিজবুল্লাহ ইরান ও সিরিয়া সরকার থেকে আর্থিক ও রাজনৈতিক মদদ গ্রহণ করে। এবং অন্যদিকে ইউরোপ আমেরিকা কানাডা ও ইসরাইল হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি সংগঠক সাব্যস্ত করে। 

যুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপটঃ

২০১১ সালে মার্চ মাসে সিরিয়ার স্বৈরাচার সরকার বাশারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের সূচনা করে বিক্ষোভকারীরা। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আরবদের এই জাগরণের সময়টাকেই "আরব বসন্ত" বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ক্ষমতার নেশায় বুদ হয়ে থাকা বাশার আল আসাদ সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের উচ্ছেদ করতে সরাসরি গুলি চালানোর আদেশ দেয় তার সেনাবাহিনীকে। এতে বিক্ষোভ নস্যাৎ হয়ে সাময়িকভাবে আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই দমন পীড়নের ফলে বিক্ষোভকারীদের চাপা ক্ষোভ আরো ভয়ংকর রূপ নেয়। পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে সে বছর জুলাই মাসে পুনরায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে সিরিয়ান বিক্ষোভকারীরা। আর এবারের বিক্ষোভ রূপ নেয় সশস্ত্র বিদ্রোহে। সিরিয়ান সেনাবাহিনী থেকে একটি দল বের হয়ে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।

২০১২ সালে বিশ্বের অন্যান্য হক্বপন্থী জীহাদী সংগঠন সেখানে গিয়ে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিতে শুরু করে। এতে বিদ্রোহীরা আরো শক্তিশালি হতে থাকে। ফলে বাশারও ধীরে ধীরে কোণঠাসা হতে থাকে। একটা পর্যায়ে বাশার আল আসাদ সিরিয়ার জেল থেকে মুজাহিদদের মুক্তি দেয়া শুরু করে

মুজাহিদদেরকে সন্দেহজনকভাবে মুক্ত করে দেওয়াটা অনেকে বিদেশী শক্তির মদদ গ্রহণ করার জন্য বাশারের কূটচাল বলে মনে করে থাকেন। কারণ জিহাদী শক্তিকে "সন্ত্রাস" বলে দেখাতে পারলে বিদেশী মদদ পাওয়ার বিষয়টি এখন খুবই কমন একটা ব্যাপার। 
তবে অনেকে আবার ভিন্ন কথাও বলে থাকে। কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল বলেই শেষ পর্যায়ে বাধ্য হয়েছিল মুজাহীদদের মুক্তি দিয়েছিল বাশার সরকার

বাশারের এই ক্রান্তিলগ্নে প্রথম মিত্র হিসেবে পাশে দাঁড়ায় ইরান। এবং যেসব বুদ্ধিজীবীরা এই প্রেক্ষাপটকে শিয়া সুন্নি বিরোধ বলে আখ্যা ও ব্যাখ্যা দিতে চায়, বাশার সরকারকে এইভাবে মদদ দিতে এগিয়ে এসে মাধ্যমে সেইসব বুদ্ধিজীবীদের হাতে প্রথমবারের মত দলিল তুলে দেয় ইরান। 

এরপর শুরু হয় ইরান+বাশার বনাম বিদ্রোহীদের যুদ্ধ। ২০১২ এর শেষ দিকে এমন সময়ও গেছে যখন ইরান প্রত্যেকদিন কার্গো ফ্লাইট পাঠাতো সিরিয়াতে। যার প্রত্যেকটির সাথে থাকতো একশরও বেশী হাইলি ট্রেইন্ড কমান্ডার।

ইরান বাশারের পাশে দাড়ানোর পরই সৌদি আরব সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপকে অস্ত্র ও অর্থের যোগান দেয়া শুরু করে। সৌদির সাথে এগিয়ে আসে তুরস্ক ও জর্ডান।

অতঃপর যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রথম সশস্ত্র গ্রুপ হিসেবে আগমণ ঘটে হিযবুল্লাহর। বাশারকে শক্তিশালী করতে ইরানের নির্দেশেই হিযবুল্লাহ যুদ্ধে যোগ দেয়

আমেরিকায় তখন বারাক ওবামার শাসন চলছিল। ওয়ার অন টেররে মিশনে সে সফলতা দেখাতে উদগ্রীব। তাই সিরিয়ার অত পক্ষ নির্ণয়ের প্যাচে ঢুকার সময় ওবামার হাতে ছিল না বলেই হয়তো জঙ্গিবাদ বিরোধী মুখস্থ বয়ান দিয়ে নিজের মোড়লগিরি টিকিয়ে রাখার গুরুদায়িত্বটা পালন করে যাচ্ছিল সে। 

তখন উড়ে এসে জুড়ে বসে ওবামা এডমিনিস্ট্রেশন থেকে সৌদিকে বলা হল উগ্রবাদীদের অর্থের যোগান দেয়া বন্ধ করতে।
উগ্রবাদী কারা এর ব্যাখ্যা আমেরিকাও দিচ্ছিল না। একটা সরল সমীকরণে গিয়ে নিজেদের জঙ্গি গেইম খেললো তারা। 

বাশার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ! এ কি করে হয়! এরাই তো জঙ্গিবাদ, এদেরকেই থামাতে হবে। অতসব বুঝার কাজ নেই, সৌদি যেহেতু পোষ মেনে আছে অতএব তাদেরকে একটা ধমক দিয়ে দেয়া যাক। কেন বলছি আমেরিকা কিছু না বুঝেই এই বক্তব্য দিয়েছে, কারণ এই এই আমেরিকা এখন যেই বিদ্রোহীদের উগ্রপন্থী বলছে একটু পর তাদেরকেই অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে মদদ দেওয়া শুরু করবে। অথবা হয়তো এইভাবে না বুঝার ভান করাটাও পরিকল্পনার অংশ ছিল।

এভাবেই যুদ্ধে যুদ্ধে ২০১৩ সাল চলে আসলো। ক্ষমতার স্বপ্ন পুনরায় দেখতে থাকলো বাশার আল আসাদ। কিন্তু ততদিনে সাধারণ জনগণ সবই তার বিপক্ষে চলে গেছে। যদিও সবাই সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেয়নি। অবস্থা বেগতিক দেখে আসাদ সময়ের সবচেয়ে ঘৃণিত আক্রমণটা করলো। নিজের দেশের নিরপরাধ নিরস্ত্র সাধারণ জনগণের উপর ক্যামিকাল অস্ত্র প্রয়োগ করলো। এরপর এক বছরের টানা হামলায় হত্যা করলো সতেরোশরও বেশী মানুষ। হ্যা এক আর সাতের পর দুইটা শূন্য, ১৭০০।

ওবামা তখন আবারো অফিশিয়ালি "গভীর উদ্বেগ" প্রকাশ করে। এবং বাশারের বিপক্ষে চলে যায়। এবং সপ্তাহ খানেকে মধ্যেই সে আমেরিকা থেকে সিআইএর ট্রেইনিংপ্রাপ্ত কমান্ডারদের পাঠিয়ে দেয় সিরিয়ান বিদ্রোহীদের মদদে 

যুদ্ধে এখন পর্যন্ত পক্ষ দুইটাই। একদিকে বাশার বাহিনী যাদের পেছনে আছে ইরান ও হিযবুল্লাহ। অন্যদিকে বিদ্রোহীগ্রুপ যাদের সাথে ছিল অন্যান্য জীহাদী গ্রুপ এবং সর্বশেষ মদদ নিয়ে আসলো আমেরিকা। 

ফেব্রুয়ারী ২০১৪। সিরিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় টারনিং পয়েন্ট। সিরিয়াতে আইএসের আগমন ঘটলো। এসেই অন্যান্য জীহাদী গ্রুপের সাথে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লো। এবং বিদ্রোহীদের পক্ষে লড়াইরত জীহাদী গ্রুপ আলকায়দা ও জাবহাতুন নুসরার সাথে চরম শত্রুতা শুরু করলোএমনকি আইএসের বাধানো অভ্যন্তরীণ এই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে তারা জাবহাতুন নুসরার নেতাদের ঘাটি থেকে ধরে এনে জবাই করেছিল বলেও খবর পাওয়া গেছে। আর আইএসের এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের রেশ ধরেই সিরিয়ার যুদ্ধে ত্রিমুখী সংঘর্ষের সূচনা হয়। 

তখন আইএস এক সাথে দুই "মহৎকাজ" শুরু করে। একদিকে বাশারের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে  উঠে পড়ে লাগে অন্যদিকে সকল হক্বপন্থী মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ শুরু করে। এবং তাদের "খেলাফত" কায়েমের ঘোষণা দেয়। 

আইএসের এই আচরণের সাথে আমেরিকার লক্ষ্য উদ্দেশ্যে পৌছানোর ছক কিভাবে যেন মিলে যায়। কারণ ঠিক এই সময়ে আমেরিকার আচরণও রহস্যজনকভাবে পরিবর্তন হতে শুরু করে। এতদিন যেখানে আমেরিকা বিদ্রোহীদের মদদ দিয়ে যাচ্ছিল, আইএসের খেলাফত ঘোষণার পর আমেরিকা তাদের টার্গেট পরিবর্তন করে ফেলে। আসাদ বিরোধিতা থেকে আমেরিকা এইবার পুরোপুরী আইএস বিরোধিতার মিশনে নামে। এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে শুধুমাত্র তাদেরকেই অস্ত্র ও ট্রেনিং সরবরাহ করা শুরু করে যারা আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এবং যারা আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায় তাদেরকে ট্রেনিং দেয়া বন্ধ করে দেয়। এর ফলে মূল বিদ্রোহকারী ও বিদ্রোহ দুইটাই চরমভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।

এভাবে আমেরিকা যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আইএসকে মূল লক্ষ্য বস্তু বানানোর ফলে সুবিধা হয় আসাদের। এবং ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বাশার আল আসাদের পাশে এসে দাঁড়ায় রাশিয়া। পাঠিয়ে দেয় কয়েক ডজন মিলিটারী এয়ারক্রাফট। ধীরে ধীরে আসাদ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে।

ওদিকে আমেরিকায় ওমাবার যেতে না যেতেই ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, সিরিয়ার স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বাশার আল আসাদেকে ক্ষমতায় রাখার বিকল্প নেই। বুঝাই যাচ্ছে, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ট্রাম্প- ওবামার কিছু দ্বিমত থাকলেও সিরিয়াইস্যুতে গোটা আমেরিকার নীতি এক ও অভিন্ন। ওমাবা যেই পর্যন্ত খেলে গিয়েছিল, ট্রাম্প ঠিক তারপর থেকেই কন্টিনিউ করেছে। 

সেকারণেই আমেরিকান ইলেকশনের সময়ও ট্রাম্প আর পুতিনের বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা কারোই নজর এড়িয়ে যায়নি। এই বন্ধুত্বের সুবাদে বাশারের জন্য
নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে বিজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। 
এরপর ২০১৬ এর শেষের দিকে যখন ইরানি মিলিশিয়া ও রাশিয়ান এয়ার ক্রাফটের সাহায্য আসে বাশার তখনই আলেপ্পো দখল করে নেয়।

সিরিয়ার সাধারণ মানুষগুলো মৃত্যুর প্রহর গুনতে শুরু করে। বেসামরিক মানুষগুলোকে মেরে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে বাশার সরকার। কেউ বেচে থাকলে তাকেও ক্যামিকাল অস্ত্র ব্যবহার করে মেরে ফেলা হবে। সোশাল মিডিয়াগুলোতে তখন অনেকগুলো বিদায়ী ভিডিও বা ফাইনাল ম্যাসেজ ভাইরাল হয়েছিল। ঘরের ভেতর বন্দি হয়ে অসহায় সিরিয়ানরা দুনিয়াবাসীকে উদ্দেশ্যে করে বলছিল আমাদের যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। 
তাদের একটাই আশা ছিল। এই ফাইনাল ম্যাসেজগুলো যদি মেইনস্ট্রিম মিডিয়া প্রচার করে তাহলে হয়তো কোনভাবে কেউ এসে বাচিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারে। বাইরে শুধুই ভয়ংকর সব বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কেউ ঘর থেকে বের হয়ে পালাবার চেষ্টা করছিল ঠিকই, কিন্তু কোথায় পালাবে! সামনের পথগুলো তো সব সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। নিজ ভূখন্ডের মাটিগুলো পায়ের নিচ থেকে সরে যাচ্ছিল।

সেই সময়টাতে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে কিছু একটিভিষ্টদের কথা এসেছিল। তাদের একজন ছিলেন মোহাম্মদ আলহামদু। ২০১৬ সালের অক্টোবরে টুইটার জয়েন করেছেন। এসছিল আরেকজন সোশ্যাল এক্টিভিষ্ট লিনা শামীর কথাও। অল্প সময়েই তাদের ফলোয়ার সংখ্যা যেভাবে লাখ ছাড়িয়ে যেত সোশ্যাল মিডিয়াতে এতে বুঝা যেত পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লাখ লাখ মানুষ এই জুলুম অন্যায়ের সাক্ষী হয়ে আছে। 

এই সোশ্যাল একটিভিস্টদের সবাই আসাদ সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া মহান বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী বলে নিজেদের পরিচয় দেয়। অনেকের প্রোফাইলেই এবাউটে দেখা যেত, স্পষ্ট ভাষায় লিখে রেখেছে, "সিরিয়ার এই মহান বিপ্লবের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত"। সাত বছরের মেয়ে বানা ছিল এই একটিভিষ্টদের মধ্যে একজন। তার মা তার টুইটার থেকে টুইট করতো। তার ফলোয়ার ছিল প্রায় তিন লাখের মত। মৃত্যুর আগে তার শেষ টুইটটি ছিল একটি বিদায়ী বার্তা, "আমাদের বাচাতে কেউ আসেনি, আমরা চলে যাচ্ছি.. গুডবাই.."।

এইসব সোশ্যাল এক্টিভিস্টের ভূমিকায় থাকা মানুষগুলো দুনিয়াবাসীকে আরেকটি বার্তা দিয়ে গিয়েছিল, একটি সত্য বার্তা,  আসাদবাহিনী প্রত্যেকটা শহরে, এলাকায়, মহল্লায় গিয়ে নিরপরাধ মানুষগুলোকে মেরেছে এবং রাশিয়া এই গণহত্যায় আসাদকে প্রত্যক্ষভাবে মদদ দিয়েছে।

অন্যদিকে আল কায়েদা যখন সিরিয়ায় ঢুকেছিল তখন এই নিষ্ঠুর বাশার বাহিনীর হাত থেকে নিজেদের জীবন বাজী রেখে তাঁরা বাচিয়েছিল ইস্ট আলেপ্পোর সাধারণ জনগণকে। কিন্তু এই সত্য সংবাদটি সবচেয়ে কম প্রচার হয়েছে। কারণ দুনিয়াবাসীর কাছে এই আল কায়েদাকে শুধুমাত্র জঙ্গি হিসেবেই চেনানো হয়েছে। এরা যে ভাল কাজ করতে পারে এ কথা বিশ্বাস করতে দুনিয়াবাসীর কষ্টই হওয়ার কথা।

২০১৭ তে আসাদ আবারো ক্যামিকাল অস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র জনগণ হত্যা করেছে। এই হামলায়প্রাণ হারিয়েছে ১০৫ জন নিরপরাধ মানুষ। যাদের মধ্যে বিশজনই ছিল শিশু। বুঝাই যাচ্ছে আসাদের রক্তের পিপাসা এখনো নিবারণ হয়নি। এক হাতে দিকে লাখো সিরিয়ানের রক্তের স্রোত অন্যদিকে বিদেশী শকুনের দৃষ্টি। এসবের ধোপে আসাদের ক্ষমতার নেশার ঘোর কতদিন টিকবে তাই এখন দেখার বিষয়। 

বাংলাদেশে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

চারশত হিজরীর দিকে আগত এক পর্যটক বলেছেন এই বঙ্গ অঞ্চলে তখন মসজিদ কেন্দ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থার খুব প্রচলন ছিল। এবং তার কথার সমর্থন মিলেছে সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক এক গবেষণায় উঠে আসা এক চাঞ্চল্যকর তথ্যে। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে নির্মিত এক বিরাট মসজিদ ও তৎসংলগ্ন ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা যায় তা নির্মিত হয়েছিল হিজরীর তৃতীয় শতাব্দীতে। 

তবে ৭০০ হিজরীর পর থেকে উপমহাদেশে ইসলামী শিক্ষা যখন আরো ব্যাপকহারে বিস্তার লাভ করেছিল সে সময় আল্লামা শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা বুখারা থেকে সর্বপ্রথম প্রথমে দিল্লি এরপর বাংলাদেশের সোনারগাঁয়ে ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্রস্থলে পরিণত করেন। মাদরাসার শিক্ষার ইতিহাসের এই অধ্যায় নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত। সে হিসেবে দেওবন্দের অনুকরণে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

দারুল উলুম দেওবন্দের অনুকরণে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম মাদরাসা কোনটি একথা নিশ্চিতভাবে না বলা গেলেও ধারণা করা হয় সিলেট জেলার ঝিংগাবাড়ি মাদরাসাই দেওবন্দের অনুকরণে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম মাদরাসা। এবং এরপরই  ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যা এখন সমগ্র বাংলাদেশের "উম্মুল মাদারিস" হিসেবে স্বীকৃত। সূচনা লগ্ন থেকে আজ আবদি এ মাদরাসাটি দেশ বিদেশে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ ও শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। 

হাটহাজারী প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে দেওবন্দের আদলে অসংখ্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এর মধ্যে অনেক মাদরাসাই শতাব্দী বা অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে আজও দ্বীনী শিক্ষার মশাল জালিয়ে রেখেছে। ১৯০১ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত সুপ্রসিদ্ধ কিছু মাদরাসার তালিকা ও প্রতিষ্ঠা সন। 

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের জিরি ইসলামীয়া আরাবিয়া কওমীয়া মাদরাসা।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা দারুল উলুম বরুড়া মাদরাসা।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেটের রানাপিং হোসাইনিয়া আরাবিয়া মাদরাসা।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে বরিশাল সরসিনা দারুস সুন্নাহ মাদরাসা।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে মোমেনশাহী বালিয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসা।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার বড় কাটারা আশরাফুল উলুম মাদরাসা।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে গোপালগঞ্জ গাওহারডাঙ্গা দারুল উলূম খাদেমুল ইসলাম মাদরাসা
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে চিট্টগ্রাম পটিয়া জামেয়া ইসলামিয়া কাসিমুল উলুম মাদরাসা।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে মোমেনশাহী সেহড়া জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদরাসা
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম চারিয়া কাসেমুল উলুম মাদরাসা।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে জামেয়া এমদাদীয়া কিশোরগঞ্জ মাদরাসা।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া।

এ সময়ে বাংলাদেশে দেওবন্দের অনুকরণে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ব্যাপকতা লাভ করে

Wednesday, September 20, 2017

আরাকানের স্বাধীনতাকামী সংগঠন আরসা কি আসলে হকপন্থী? রোহিঙ্গা সংকট (৭)




প্রথমেই একটা বিষয় জেনে রাখতে হবে, ওপাড় থেকে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই এমন আছে যারা এপাড়ে এসে নিজেদের আলেম বলে পরিচয় দেয় অথচ তারা আলেম না। এদের অনেকে আবার আরাকানের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের জঙ্গি বলেও আখ্যা ও ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে। আজকে তাদের এই প্রবণতা ও প্রবণতার উৎস নিয়ে একটু কথা বলবো।

স্বাধীনতাকামী, মুক্তিকামী বা জীহাদী আপনি যে শব্দই রোহিঙ্গা যোদ্ধা আরসার বেলায় ব্যবহার করেন না কেন এটা অবশ্যই মানতে হবে যে তারা এখন যা করছে সেটা আরো বহু আগে শুরু করা দরকার ছিল। তবে কাজটা করতে গিয়ে যেই পন্থা বা মানহাজ তারা অবলম্বন করছে তা নিয়ে অবশ্য অনেকেরই প্রশ্ন আছে। যেসব প্রশ্ন যৌক্তিকও বটে। কিন্তু এ ধরণের সংকটের সময় এসব যুক্তি যে ধোপে টেকেনা এটাও আপনাকে বুঝতে হবে। যেহেতু তাদের নেতিবাচক বলে সন্দেহ করার নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা অতএব এর আগ পর্যন্ত আমাদের উচিত তাদের ব্যাপারে যেকোন ধরণের অবান্তর প্রশ্ন তোলা থেকে বিরত থাকা। 

এবার আসুন, মুক্তিকামী এই যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে জান নিয়ে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের ক্ষোভের কারণ কি? সেনাবাহিনীরা যখন নির্যাতন করতো তখন তারা এই মুক্তিকামী বাহিনীর ছুতোর কথাই বারবার উচ্চারণ করতো। রোহিঙ্গাদেরকে বিশ্বাস করাতো যে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের তৎপরতার জন্যেই তারা মার খাচ্ছে। এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশীরভাগ অসচেতন হওয়ার ফলে ওপাড় থেকে বপন করে দেয়া বিশ্বাসের বীজকে তারা কিছুতেই উপড়ে ফেলতে পারলো না। তাছাড়া এই স্বাধীনতাকামনাকে যারা কিছুটা সমর্থন করে তারাও অনেক সময় নিজে পালিয়ে আসার ফলে সেটাকেই বৈধতা দিতে চায়। ও যুদ্ধের বিপক্ষে যুক্তি দিতে চায়। তা না হলে তো নিজের ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এটাই হচ্ছে তাদের এখনকার প্রবণতা।

এর মৌলিক কারণ বা উৎস হিসেবে বলা যায় বহুকাল যাবৎ রোহিঙ্গাদের দ্বীনী শিক্ষার গন্ডিকে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সংকীর্ণ করে রাখাকে। তাই কেউ ধর্মীয় কারণে আক্রমণ করলে পালটা আক্রমণ করার হুকুম যে তার ধর্ম দেয় এবং ইসলামের ধর্মে যে সমাধানকে জীহাদ বলা হয়েছে সেসব বিষয়ে তাদের কোন ধারণা নেই বললেই চলে। অন্তত শরণার্থীদের সাথে কথা বলে এবং বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মার খেয়ে যাওয়ার ইতিহাস দেখে তাই মনে হয়।

গতবার সময় নিয়ে অনেক শরণার্থীর সাথে কথা বলেছিলাম। তখন সবার মধ্যে যে ব্যাপারটা কমন ছিল তা হল, কোন কারণ ছাড়াই তারা এই মুক্তিকামীদের দোষারোপ করে ঘটনা বর্ণনা করে থাকে। প্রথম প্রথম জিজ্ঞেস করতাম "যদি আরসার এই আক্রমণ ঠিক না হয় তাহলে সেনাবাহিনীর এই নির্যাতনের জবাব কিভাবে দেওয়া উচিত? মগরা আক্রমণ করলে আপনারা কি পালটা আক্রমণ করবেন না?"
অনেকে প্রশ্ন শুনে হা হয়ে তাকিয়ে থাকতো। আর অনেকে উত্তর দিত, "বাবা আমরা মজলুম, আমাদের কিছুই করার নাই।"
তখন বুঝতাম, এসব নিয়ে কথা বলতে যতটুকু জ্ঞান থাকা দরকার সেটা তাদের নেই। অতএব তাদের কথা বা নেতিবাচক প্রবণতার উপর ভিত্তি করে আরাকানের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদেরকে সঠিক বা ভুল বলে বিবেচনা করে ফেলাটা কোনভাবেই যুক্তিযুক্ত না।

তবে রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু মানুষও যে স্বাধীনতার পক্ষে নেই সেটা মিথ্যা কথা। আর এখন আলহামদুলিল্লাহ, পরিস্থিতি পরিবর্তনও হচ্ছে। এই দফায় আসার সময় অনেক যুবকরাই যুদ্ধ করতে আরাকানে থেকে গেছে। স্বাধীনতাই যে তাদের একমাত্র সমাধান এটা ধীরে ধীরে হলেও অনেকে বুঝতে পারছে। সেই সাথে যোদ্ধাদের সমর্থনের পাল্লাও ভারী হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুক।

Saturday, September 16, 2017

রোহিঙ্গা সংকটঃ নিধন কি মুসলিম হওয়ার কারণেই? (৬)



আরাকানে রোহিঙ্গা যা বাকি ছিল গত তিন সপ্তাহে তার ৪০ ভাগ চলে এসেছে। আর দশ ভাগ পাঠিয়ে যদি অভিযান থামিয়েও দেয়া হয় তাহলে পরবর্তী ধাক্কাতেই আরাকান রোহিঙ্গামুক্ত হয়ে যাবে আশা করা যায়। দুনিয়ার মানুষ যত কিছুই বলুক এই অঞ্চলের গডফাদাররা তাতে কোন রকম কর্ণপাত না করে নিজস্ব কায়দায় সফলভাবে একটা মুসলিম জাতিকে নিধন করে যাচ্ছে। হ্যা, মুসলিম জাতিকেই তো!
ও আচ্ছা, ইদানীং তো আবার নতুন প্রশ্ন উঠেছে।
আসলে কি মুসলিম বলেই রোহিঙ্গাদের এভাবে মারা হচ্ছে?

সেকুলারিজমের উটকো গন্ধযুক্ত এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে প্রশ্নকারীদের কাছে একটা সরল প্রশ্ন রাখা দরকার।
-হিন্দু নিধন হলে কি তাতে মোদিজীর অকুণ্ঠ সমর্থন আসতো বলে আপনি মনে করেন?

মুসলিম ছাড়া অন্য যেকোন ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হলেই এখানে জাতিগত নিধন চালিয়ে বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিল করার কথা চিন্তাও করতে পারতোনা এই অঞ্চলের গডফাদাররা। এটা মাথায় রাখলে এখন বাকি হিসেবগুলো বুঝতে সুবিধা হবে।

আসলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নোংরা রাজনীতি করার পেছনে মুসলিম হওয়ার কারণটাকে একেবারেই এড়িয়ে যাওয়ার এই প্রবণতাটা আসে ধর্মের প্রতি বিশেষ এলার্জি থেকে। এখন আপনি হয়তো নিজেকে একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম বলে দাবী করবেন। কিন্তু আমি বলবো, আপনার এই চুলকানীর পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে ইসলামকে সামগ্রিক ভাবতে না পারা। অর্থাৎ আপনি ইসলামকে ব্যক্তিগত জায়গার ধর্ম হিসেবে মানতে পারছেন। কিন্তু যখনই বলা হয়, ইসলাম শুধু ব্যক্তি নয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিধান দেয়ার মত একটি ধর্ম।

সেকুলারগণের মতে, ধর্ম ব্যক্তিগত, জাতির কোন ধর্ম থাকতে পারেনা। এই থিওরীর ভিত্তিতেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে ধর্ম টেনে আনার ঘোর বিরোধিতা করে থাকেন উনারা।
উনাদের ভয় হচ্ছে, ধর্মকে টেনে আনলেই তো ভণ্ডামিগুলো ধরা পড়ে যাবে। তাই আগেই বলে দিয়েছেন, ধর্মের সাথে রাজনীতি মেশানো যাবে না। সে হিসেবে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে যদি কোন জাতি নির্যাতিত হয় এবং তাতে যদি নোংরা রাজনীতির মদত থাকে তাহলেও সেটাকে তারা রাজনৈতিক অবিচার বলবেন না।

অথচ এটা এখন স্পষ্ট যে পুরো রোহিঙ্গা ইস্যুটা তৈরিই করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাজনীতির চর্চা করার জন্য। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ক্ষমতা থাকায় তাঁরা সেটাকে কাজে লাগিয়ে এই অপরাজনীতি করে যাচ্ছে।
এর ফলে যা হয়েছে, সেকুলাররা এর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিপদে পড়ছেন। গোজামিল দেয়াও সম্ভব হচ্ছনা। এই জুলুমের নাম এখন তাঁরা কি দিবেন! অরাজনৈতিক জুলুম!

ঐতিহাসিক অনেক কারণেও রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয়কে মাইনাস করে এই সংকটকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। কারণ রোহিঙ্গাদের জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক কম। অতএব এভাবে ভাবার কোন অধিকার সেকুলারদের নেই। এতে পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির পরিচয়কে অস্বীকার করা হয়। মুসলিম পরিচয়ে রোহিঙ্গাদের সংগ্রামকে এভাবে ছোট করে দেখার কোনই সুযোগ নেই।

ভাবসাব দেখে মনে হয়, মুসলিম পরিচয়টা সেকুলারদের কাছে অনেকটা ভীনগ্রহের কোন প্রাণীর মত। তাই হয়তো উনারা সেই "প্রাণী জাতি"র অধিকারকে মানবাধিকার বলে স্বীকার করতে চান না। যদিও পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে অনেকে জুলুমটাকে মেনে নেন কিন্তু মুসলিম হওয়ার কারণেই যে এই জুলুমটা হচ্ছে সেটা তাঁরা কোনদিনও স্বীকার করতে চান না। আর এখানেই ধর্মনিরপেক্ষতা নামক ভণ্ডামির চরম সংকীর্ণতার ধরা পড়ে।


এই ধোকাবাজীগুলো আমাদের সচেতনভাবে বুঝা উচিৎ। আমার ধর্ম ইসলাম যেখানে দুনিয়ার সমগ্র মানবজাতির জন্য অধিকারের কথা বলে সেখানে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা এসে নিরপেক্ষতার নামে সংকীর্ণতা চর্চা করতে শেখায় তখন তারে আর কি করে নিরপেক্ষ বলি!

Friday, September 15, 2017

রোহিঙ্গা সংকটঃ ভারত বনাম আন্তর্জাতিক শক্তি (৫)



তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার পর এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার পক্ষে জোরালো আওয়াজ তুলেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো মিয়ানমারকে অবরোধ করার প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছে। তাছাড়া জাতিসংঘের এখনকার সব স্টেটমেন্ট দেখে মনেই হচ্ছে অন্যবারের তুলনায় এবার বিষয়টাকে একটু সিরিয়াসলি নিচ্ছে তারা।

তবে যেহেতু মাথাব্যথাটা মূলত বাংলাদেশের তাই আসল কাজটা বাংলাদেশকেই করতে হবে। ওলামায়ে কেরাম, সর্বস্তরের জনগণ ও বুদ্ধিজীবী সমাজ যেভাবে আয়োজন করে প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে এতে কিছুটা হলেও কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পাড়া বেশ কঠোর ভূমিকা রাখবে বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

ফলাফল হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি
চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী দুই সদস্য হওয়ার পরও সেখান থেকে বলা হয়েছে এই ইস্যুতে বাংলাদেশের কথাকেই অধিক গুরুত্ব দেয়া হবে। আনান কমিশন বলেছে, তাদের সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রাধান্য থাকবে বাংলাদেশের। সেই কমিশনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার উপর জোর দেয়া হয়েছে। এবং এদিকে বাংলাদেশও আজকে মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে তলব করে আকাশসীমা লঙ্ঘনের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। জনগণের আন্দোলন করে চাপ সৃষ্টি না করতে পারলে এতটুকুও সম্ভব হতনা।

তবে এই সামান্য অর্জনে অত সন্তুষ্ট হলে ধরে নেব আপনি এই মুভির ভিলেনের কথা ভুলে গেছেন।
ভারত বসে নেই। এতসব কিছু দেখে সে খেলার কৌশল পাল্টেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল শেখ হাসিনাকে ফোন করে বলেছেন,
"আপনি কোন চিন্তা করবেন না। মিয়ানমারকে বলে দিয়েছি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে।"

আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো নড়েচড়ে বসার পরপরই ভারতের এভাবে পল্টি নিয়ে ফেলার পেছনে যেই দুইটা কারণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তা হলঃ

প্রথমত, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ কোন অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ না ভারতের কাছে।
সাগরে নিজেদের আধিপত্য রক্ষার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই হাতে রাখতে হবে। তাই তারা যতই বাশ দিক সময়মত একটু পিঠে হাত বুলিয়ে দিলে যে বাংলাদেশ ঠান্ডা হয়ে যাবে সেটা তারা ভালই বুঝে। এবং এতে কাজও হচ্ছে। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল জনগণকে ভারতপন্থী হয়ে গিয়ে ভারতকে বন্ধু হিসেবে মেনে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। বিস্তারিত জানতে গত কয়েকদিনের পত্রিকাগুলোতে আমাদের মন্ত্রীদের কথাবার্তাগুলো দেখে নিন।

দ্বিতীয় আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, এই ইস্যুতে অন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপমুক্ত রেখে পুরো ব্যাপারটি অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে নিজেদের হাতে রাখার চেষ্টা করা। ঠিক যে কাজটি করেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের মিত্রশক্তি। তারা বাংলাদেশে চালানো গণহত্যাকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে চেয়েছিল পাকিস্তানকে। কিন্তু তখন আমাদের স্বাধীনতায় ভারতের স্বার্থ জড়িত থাকায় এই ইস্যুকে অভ্যন্তরীণ বানিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তান তখন ব্যর্থ হয়েছিল।

কিন্তু কোন ইস্যুকে অভ্যন্তরীণ বানিয়ে বাংলাদেশ সফল হয়েছিল গত নির্বাচনে। যখন আমেরিকা গণতন্ত্র হত্যা নিয়ে কথা বলতে চাইছিল এবং মোদি "অভ্যন্তরীণ বিষয়ে" বলে আমেরিকাকে এখানে এসে নাক গলাতে নিষেধ করে দিয়েছিল।
এবারও ভারত বাংলাদেশের পিঠে হাত বুলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুকে অভ্যন্তরীণ বানিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। কারণ তারা চায়না বাংলাদেশ ভারতকে ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে গিয়ে ন্যায় বিচার চাওয়ার সুযোগ পাক।

আর আমাদের মন্ত্রীদের আচরণে তো মনে হচ্ছে ভারতমাতারই জয় হতে চলেছে।

Thursday, September 14, 2017

রোহিঙ্গা সংকটঃ আন্তর্জাতিক এতিম ও বন্ধুহীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের নড়বড়ে অবস্থান (৪)


আজ দশম জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বললেন, "রোহিঙ্গাদের অবস্থা খুবই অমানবিক। বাংলাদেশ তাদের পাশে থাকবে। প্রয়োজনে তাদের সাথে খাবার ভাগ করে খাবো।"
সামাজিক অবস্থান থেকে আমরা সবাই এ বক্তব্যকে সমর্থন করি। অস্থায়ী সমাধান হিসেবে নিজেদের সাধ্যমত পাশে দাড়ানো এবং খাবার ভাগ করে খাওয়ার কাজটা আমরা আমাদের কর্তব্য হিসেবে করেও যাচ্ছি। 

কিন্তু এই সংকটের একটা স্থায়ী সমাধান নিয়ে সর্বমহলে যেই আলাপ উঠেছিল সে প্রত্যাশা পূরণের ক্ষমতা একমাত্র ছিল আমাদের প্রধানমন্ত্রীর হাতে। শেষমেশ তিনিও বাংলাদেশ নামক স্বাধীন এই রাষ্ট্রটাকে সামাজিক কাজ করেই সন্তুষ্ট থাকতে বলে দিলেন!
ক্ষমতায় থাকার পরও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন কঠোর পদক্ষেপ না নিয়ে যখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই সাহায্য নিয়ে পাশে দাড়ানোর কথা বলেন এবং অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মত সামাজিক দায়িত্ব পালন করে ক্ষান্ত হন তখন কিছু কথা মনে পড়ে। কথাগুলো সত্য উচ্চারণে এ সময়ের সাহসী একজন ব্যক্তির থেকে শুনেছিলাম দুদিন আগে। আমি নিজ থেকে কিছু না বলে শুধু তার কথাগুলোই তুলে ধরছি।

তিনি যা বলেছিলেনঃ
"আসলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহারের সদিচ্ছা না থাকলে এই সংকট নিরসন সম্ভব না। বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালে যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করেছিল সেটাও তৎকালীন সরকারের সাহসী উদ্যোগের ফলেই সম্ভব হয়েছিল।

বাংলাদেশ এখন রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ইস্যুতে কঠোর কোন পদক্ষেপ নিতে পারছেনা দুইটা কারণে।
১) বিরোধী দল ও মতের উপর অকথ্য নির্যাতনের ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো অভ্যন্তরীণভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। জনসমর্থনের অভাবে সরকার শুধুই ক্ষমতায় থাকা না থাকা নিয়ে দুর্বল মানসিকতায় ভোগে। তাই বিদেশী শক্তির দ্বারা বাংলাদেশ কখন কিভাবে প্রতারিত হচ্ছে ও হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে সে নিয়ে চিন্তার সুযোগ পায়না।
২) বহু বছর যাবত সরকার বলে আসছে ভারত আমাদের একমাত্র বন্ধুরাষ্ট্র। যার ফলে এক সময় মিডলিস্টের যেসব দেশ আমাদের ট্রেডিশনাল বন্ধু ছিল তারা এখন আর নেই। ওদিকে সুযোগ পেলেই সরকারের পক্ষ থেকে আমেরিকার সমালোচনা করা হয়। অতএব এমন একটা বন্ধুহীন রাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক কোন শক্তি নিয়ে কিছু করা সম্ভব না এটা মিয়ানমার বেশ ভাল মতই জানে। এর উপর আবার এই অঞ্চলে যত বড় বড় স্টেকহোল্ডার আছে, যেমন চায়না, রাশিয়া ও ভারত, সবাই এই ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে।

এসব কারণেই মিয়ানমারের হেলিকাপ্টার ১৭ বার বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করার পরও বাংলাদেশ নিশ্চুপ বসে থাকে। কিছু বলার সাহস পায়না।"

এই সত্য কথাগুলো অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাহেবের। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে সত্য উচ্চারণে নির্ভীক এমন কিছু মানুষের খুব বেশী প্রয়োজন। তিনদিন আগে "রাউন্ড টেবিল ডিসকাশন অন ন্যাশনাল সলিডারিটি ফর দা রোহিঙ্গা" শীর্ষক বৈঠকে তিনি কথাগুলো বলেছিলেন। আজকে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সামাজিক হয়ে থাকার বক্তব্যে তার দাবীর সত্যতা একেবারে স্পষ্ট হয়ে গেল। আসলেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ একটি জিম্মিরাষ্ট্রের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের এই ভূমিকা দেখার পর একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে অবশ্যই আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্ব নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে।

কবি বেচে থাকলে হয়তো আজ এভাবে লিখতেনঃ
"রেখেছো "সামাজিক" করে, বাঙালি করোনি"
অন্তত বাঙালি হতে পারলেও তো একটা জাতিসত্ত্বা থাকতো, যে জাতির একটা স্বাধীন রাষ্ট্রসত্ত্বা থাকারও সম্ভাবনা ছিল।

Tuesday, September 12, 2017

রোহিঙ্গাদের পাশে আবারো লালবাগ জামেয়া

রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের কান্না ছুঁয়েছে পুরো বিশ্ববাসীকে। আজকে মিসরী এক দোকানদান তো বলেই ফেললো, আমি বার্মা যেতে চাই জীহাদ করতে। বাঙালিদের কাছে তার প্রশ্ন হচ্ছে,
"বাঙালিরা কি করছো রোহিঙ্গাদের জন্য?"

আমি বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম, বিগত সময়ের ইতিহাস ঘেটে দেখো, রোহিঙ্গাদের সাহায্যের জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করেছি। সামাজিকভাবে বাঙালিরা যতটুকু করেছে অন্য কোন সমৃদ্ধ জাতিও তাদের দেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য এতটা করেনা।
এক পর্যায়ে উদাহরণ হিসেবে বলতে গিয়ে বেশ গর্বের সাথে লালবাগ জামেয়ার রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়ানোর গতবছরের সেই উদ্যোগের কথা বললাম। সে শুনে বেশ অবাক হল, একটা বেসরকারি জামেয়া থেকে এই পরিমাণ সাহায্য কিভাবে নেয়া সম্ভব!
সত্যিই, গত বছর রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা সংগ্রহের জন্য লালবাগ জামেয়ার উদ্যোগে যে মানুষ এতটা অভাবনীয় সাড়া দিবে এটা এখনও কেউ শুনলে  অবাক হয়। আমি সেবার দুইটা বিষয় খুব স্পষ্ট বুঝে গেছি।
১ বাঙালিরা কারো প্রতি সহানুভূতিশীল হলে তার জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতে পারে।
২ কিন্তু সেই সহানুভূতিটুকু অসহায় মানুষগুলোর কাছে  পৌছে দিতে তাদের দরকার একটা বিশ্বস্ত মাধ্যম।

একটা ঐতিহ্যের কথাও বেশ মনে পড়ে। অর্ধ শতাব্দি আগে অত্র জামেয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ যেই ঐতিহ্য শিখিয়ে গেছেন। তা ছিল, ক্রান্তিলগ্নে ওলামায়ে কেরামের সামাজিক কাজে এগিয়ে আসা। মানুষ সেইসব অবদানের কথা ভুলে যায়নি। মাঝে কিছু সময়ের বিরতি থাকলেও আলেম ওলামারা প্রয়োজনের খাতিরে আবারো নেমে এসেছেন এই ময়দানে।

লালবাগ জামেয়া গত বছরের বন্যার্ত ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে দুইটি ও এই বছর বন্যার্তদের নিয়ে একটি সফল ইভেন্ট পরিচালনা করার পর এখন জামেয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ও প্রত্যাশা যে কতটা বেড়ে গেছে তা বিগত কয়েকদিনে বেশ ভালই টের পাচ্ছিলাম। মানুষের শুধু একটাই প্রশ্ন, লালবাগ জামেয়া থেকে এবার রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা নিয়ে কবে যাওয়া হচ্ছে?
সকলের অবগতির জন্য জানাচ্ছি,
রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়াতে গত বছরের ন্যায় এ বছরও  উদ্যোগ নিয়েছে লালবাগ জামেয়া।
মুফতি আমিনী রহঃ এর দৌহিত্র ও লালবাগ জামেয়ার নবীন উস্তাদ মুফতি আব্দুল্লাহ ফরহাদ এইবারের ইভেন্টের মূল উদ্যোক্তা। আল্লাহ তায়ালা তার এই খেদমতকে কবুল করুন।

Sunday, September 10, 2017

গীজার পিরামিড

গীজার পিরামিড নিলনদের পশ্চিমদিকে।

 পিরামিড দেখে মনে হয় কোথায় যেন গিয়ে আকাশের সাথে মিশে গেছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না, পিরামিডের মাথার উপর তীব্র সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে।

অদৃশ্য কোন কিছু আটকে রেখেছে এক পাথরের সাথে অন্য পাথরকে। ছবিতে দেখে আন্দাজ করা সম্ভবনা যে আসলে পিরামিড কতটা বড়।

প্রথম পিরামিডটি হল ফারাও কিওপ্সের (দা গ্রেট পিরামিড অফ কুফু অর কিওপ্স)এটা পুরো মিসরের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে পুরানো পিরামিড। ত্রিশ লাখ লাইমস্টোন একটি আরেকটির উপর রেখে তৈরী। উচ্চতা ৪৫৫ ফুট। পিরামিডের ভেতরে দেখা সুযোগ আছে কিন্তু তার জন্য টিকেট কাটতে হয়।

এই পিরামিডকে ছাড়িয়ে একটু সামনে এগোলেই ফারাও কাফিরান বা কাফরে এর পিরামিড। কাফিরান হচ্ছে কিউপ্সের পুত্র। এটিও ৪৫৫ ফুট। তবে একটূ উচিতে হওয়ার কারণে এটিকে একটু বড় মনে হয়।
এর একটু সামনেই মিখারনিস এর পিরামিড।
এইসব পিরামিডের গা আগে ঢাকা ছিল চকচকে শুভ্র লাইমস্টোনে। পরবর্তীকালে মানুষ সেগুলো খুলে নেয়াতে এখন আমরা খসখসে হলদেটে রঙের লাইমস্টোন দেখি।
গীজার পিরামিড ৪০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তৈরী। হেরোডাটাস লিখেছেন এক লক্ষ ক্রিতদাসের ত্রিশ বছর লেগেছিল এই পিরামিড তৈরী করতে। অন্যমতে বন্যার সময়ই কৃষকরা এই কাজে নিয়জিত হত। কারণ একেকটি পাথরের ওজন আড়াই টন। আর এইসব পাথর আনা হত আসওয়ান এবং টুরা থেকে। সেই আড়াই টন ওজনের পাথর আছে এই পিরামিডে তেইশ লক্ষ। মোট ওজন তাহলে হয় ৬০০০০০০ হ্যা, ছয় এর পর ছয়টা শূন্য। আর উচ্চতা ৪৮২ ফুট। একালের আটচল্লিশ তলা বাড়ির সমান। ফিকে হলুদ, সামান্য খয়েরী মেশানো।

এই তিন পিরামিডের মাঝে দেখা যায় কয়েকটি শুস্ক নালার মত সুরঙ্গ পথ। বলা হয়ে থাকে, এই সুরঙ্গ পথের গরতের ভিতর দিয়ে সোলার বোটের মাধ্যমে মৃত ফারাওদের দেহ নীল নদ থেকে পিরামিডের নীচের সুড়ঙ্গ এসে পৌঁছত। পরে এই নৌকাগুলোকেও সমাধিস্থ করা হত। পাশের একটা মিউজিয়ামে এইসব নৌকার মডেল রাখা আছে।

স্ফিংসঃ
তিন পিরামিডকে ছাড়িয়ে সামন যেতেই এক বিশাল, গভীর গহ্বর। গহ্বরের ভিতর প্রস্তরের এক স্থাপত্য শিল্পও চোখে পড়ে কিন্তু এর আকৃতি পেছন থেকে বুঝা যায় না। একটু সামনে আসতেই বুঝা যায়, বসে আছে উদ্ধত মানব মস্তক নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত স্ফিংস। যান নাক পুরোটাই ভাঙ্গা এবং সিংহের থাবা সামনে এগিয়ে আছে।
এখানের মজার ব্যাপার হল, স্ফিংসের ঠিক মুখোমুখি দাড়ালে দেখা যায় তিন পিরামিডকে এক নজরে। মিশরের সূর্যোদয় হলে সর্বপ্রথম কিরণ পড়ে স্ফিংসের মুখে। আর দিনের শেষে সে কিরণ গিয়ে পড়ে নিলের জলে। এটি ৭৩.৫ মিটার লম্বা। স্ফিংসের মুখোমুখি দাড়ালে পেছনের তিন পিরামিডকে পাহাড়ের মত লাগে।
সন্ধায় আলোছায়ার স্ফিংস তার গল্প বলবে। পিজা হাটের ছাদে বসে নাকি বিনা টিকিটেই সেই গল্প শুনতে বসা যায়।

এই প্রাচীন সভ্যতাই আবিস্কার করেছিল করেছিল যে ৩৬৫ দিনে এক বছর হয়। এ কালের বিজ্ঞান এসে যেটাকে প্রমাণ করেছে সেটার সাথে সেই প্রাচীন আবিস্কারের পার্থক্য মাত্র কয়েক মিনিট।
জ্যামেতি গ্রিক থেকে পেয়েছিল ইউরোপ। আর গ্রিক পেয়েছিল মিশর থেকে। নীলনদের পাশে যে কৃষিজমির চাষ করা হত তা চিহ্নিত করে ভাগাভাগি করার জন্য এই জ্যামিতির আবিস্কার হয়। প্যাপারাইস কাগজে তারা লেখালেখি করতো। তা থেকেই ইংরেজী পেপার। আর এই কাগজ তৈরী হত প্যাপারাইস গাছের রিডস অর্থাৎ ডাটা থেকে।

স্ফিংসের নামকরণ করেছিল হেরোডোটাস। গ্রিক ঐতিহাসিকের এই আচরণকে ঔদ্ধত্য বলে বর্ণনা করেন নেপোলিয়ান। আলেকজান্ডারের মত বীর যোদ্ধারাও স্ফিংসের পদতলে মাথানত করেছেন বলে কথিত আছে।
একটা সময় স্ফিংসের বাকি দেহ মরুভূমির বালিতে ঢাকা পড়েছিল। কোন এক রাজকুমারের স্বপ্নে আসে স্ফিংস। বলে তার শরীরকে বালির চাদর সরিয়ে উম্নুক্ত করতে পারলে সে পরবর্তীতে ফারাও হতে পারবে। পরবর্তীকালে এই রাজকুমারই হয়েছিল চতুর্থ ফারাও থাটমোস।  গিজার এই গ্রেট পিরামিড বানানোর জন্য এক লক্ষ কর্মীর প্রয়োজন হয়েছিল।

মমি বানানোর প্রসেসঃ
শরিরগুলো নিলনদ দিয়ে ভেসে আসার পর বা পাশ কেটে কিভার কলিজা মাংস বের করে ফেলা হত। মগজও বের করে ফেলতো মাথা থেকে। হয়তো পচে যাও্যার ভয়েই। এরপর ন্যাট্রন নামক এক ক্যামিকেলের সাহায্যে সম্পূর্ণ শুষ্ক করে নেয়া হত। পুরো চল্লিশ দিন সময় লাগতো মমি হতে। এরপর সেলাই করে দেও্য হত বাপাশ। এরপর শরীর ঢেকে ফেলা হত সোনার অলংকারে। পুরো শরিরকে প্রায় বিশটি আস্তরণে বাঁধা হত পাতলা কাপড় দিয়ে। প্রতি আস্তরণে ব্যবহার হত কিশমিশ সিডার তেল বিভিন্ন গাছের সুগন্ধি।
মিসরীয় প্রবাদে বলেঃ ওয়ার্ল্ড ফিয়ার দা টাইম এন্ড টাইম ফিয়ার দ্যা পিরামিড। এরপর সব অনুষ্ঠান শেষে একটি বিশাল পাথর দিয়ে সুড়ঙ্গপথের শেষ মুখটি চিরতরের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হত। এমনভাবে এই গহ্বরের মুখটি পাথর বসিয়ে বন্ধ করা হত যাতে পরবর্তীকালে বোঝা না যায় যে কোন পাথরটি সরালে সুড়ঙ্গপথ ধরে পিরামিডের ভেতর যাওয়া যাবে।

স্ফিংস নেফারতিতির প্রসংসাও করে। সুদীর্ঘ গ্রিবার অধিকারী নিফারিতিতি শুধু অদ্ভুত সুন্দরীই ছিলেন না বুদ্ধিমতিও ছিলেন। মিশরীয়তা তাকে বিউটি উইথ ব্রেইন্স বলে মনে করে।

স্ফিংস তার নাক ভাঙ্গার কাহিনী নিজ মুখেই বলে। কোন এক রাজপুত্রের কাছে তার হাসু দেখে ভয় লেগেছে। ব্যাস তার চেহারার অহং কমাতে নাক ভেঙ্গে দেয় সেই রাজপুত্র। 

রোহিঙ্গা সংকটঃ ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা (৩)

ইতিহাস বিকৃতির এই সময়ে রোহিঙ্গা নির্যাতনের সূত্রপাত নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা থেকে জেনে আসা প্রকৃত কিছু সত্য তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছি।

রোহিঙ্গা হত্যাকে বৈধ করার জন্য ঘটনার যে অংশটুকু এখন সর্বত্র প্রচার করা হচ্ছে তা হলঃ
"গত বছর ৭ই অক্টোবর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উপর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হামলা করার জের ধরেই রোহিঙ্গাদের উপর এই অভিযান শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী"

ঘটনা এর আগে আরো কিছু ঘটেছিল। যেই অংশটুকুকে আড়াল করে প্রকৃত সত্যকে চাপা দেয়া হচ্ছে। দুঃখের বিষয় হল, আমাদের দেশীয় মিডিয়াগুলোও এখন এতটাই বিদেশী সংবাদের অনুবাদ আর অনুকরণ নির্ভর যে তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষে থাকার পরও এই আংশিক সত্যকেই প্রচার করছে। ঘটনার শুরুর অংশটুকু না লিখে নিজেরা বিভ্রান্ত হচ্ছে ও মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। বলেছিলাম না? এইভাবেই দেখবেন একসময় রোহিঙ্গা হত্যার বৈধতার দলিলপত্র বের হবে।

ঘটনার শুরুতে যা ঘটেছিলঃ
২০১৬ সালের অক্টোবরে অভিযান শুরু হওয়ার আগে একটি গুজব ছড়ানো হয়। তা হল, "রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে"। রোহিঙ্গাদের প্রবল ধারণা যে এই কাজটা মগরাই করেছিল। কারণ রাখাইনে এই মগরাই রোহিঙ্গাদের উপর চরম বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে।
গুজবে বিশ্বাস করে সেনাবাহিনীর ছোট একটা গ্রুপ এসে রাখাইনের একটা গ্রামে তল্লাশি চালায়। অনেক খুজেও তারা রোহিঙ্গাদের থেকে কোন ধরণের অস্ত্র বা যুদ্ধের প্রস্তুতির প্রমাণ পায়না। কিন্তু মুসলিম বিদ্বেষী সেই সেনাবাহিনীকে উস্কানী এতটাই মারাত্মকভাবে দেয়া হয়েছিল যে, তারা তল্লাশি নিতে গিয়ে শুধুমাত্র সন্দেহবশত চারজন রোহিঙ্গা যুবকের উপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে এবং নির্যাতনের একপর্যায়ে তাদেরকে মেরে ফেলে। যেহেতু এভাবে মেরে ফেলাটা গত অর্ধশতাব্দী ধরে সেনাবাহিনীর কাছে নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা তাই রোহিঙ্গারা যে এর জবাব দিতে উপর চড়াও হবে সেটা তারা ভাবতে পারেনি। তাই তাদের কোন প্রস্তুতিও ছিল না। বিগত চার বছর নির্যাতন থেকে বিরত থাকায় হয়তো রোহিঙ্গারা নিজেদের ভেতরের পরাজিত মনোভাব কিছুটা কাটিয়ে উঠেছিল। এ কারণেই হয়তো গ্রামে গুটিকয়েক সেনাসদস্য ঢুকে বিনা কারণে তাদের চারজন যুবককে হত্যা করে ফেলবে এটা রোহিঙ্গারা মানতে পারেনি।

ঘটনার এই অংশটুকু সমস্ত সংবাদমাধ্যম চেপে গেছে। তারা বর্ণনা শুরু করেছে এর পর থেকে। এরপর সেই গ্রামের রোহিঙ্গারা ক্ষোভ আটকে না রেখে সেই সেনাবাহিনীর উপর চড়াও হয় এবং গণধোলাই দিয়ে মেরে ফেলে। এই ঘটনায় প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। "রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীর সাথে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে" এই গুজবকে সত্য ভাবার যথেষ্ট কারণ খুজে পায় মিয়ানমার প্রশাসন। এবং আলজাযিরার মতে, এইভাবে গায়ে পড়ে কারণ খুজে বের করাটাও মিয়ানমারের পরিকল্পনার অংশ। তাই তাঁরা দুনিয়ার গণমাধ্যমকে বলেছে, এই গুজবই সত্য। তোমরা এটাকেই বিশ্বাস করো এবং মানুষকেও বিশ্বাস করাও।

চেপে যাওয়া এই সত্যকে বিশ্বাস করার যথেষ্ট যুক্তি ও কারণ রয়েছে। সরেজমিনের ঘুরে রিলায়েবল সোর্সেস জমা করে আলজাযিরা ওয়ারল্ডক্লাস একাডেমিকসদের থেকে বিশ্লেষণ নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি তৈরী করেছে। তাতে এসব কিছুই যে পরিকল্পিত সে বিষয়টি বেশ স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও সীমান্তের শেষ প্রান্তে বসবাস করা বাঙালিদের এইসব বর্ণনার থেকে যা কোট করেছি তা আমার নিজ কানে শোনা। টেকনাফের বসবাসরত বাঙালী অথবা সেখানে আশ্রয় নেয়া যে কোন রোহিঙ্গাকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন যে এই গণহত্যার সূত্রপাত কিভাবে, তারা সবাই আপনাকে অবিকল পুরো এই ঘটনাটাই বলবে। তাদের বর্ণনায় যদি মিথ্যা বা বানোয়াট কিছু থাকতো তাহলে এতগুলো মানুষ এতটা অভিন্নভাবে কখনোই বলতে পারতো না।

Thursday, September 7, 2017

রোহিঙ্গা সংকটঃ উত্তরণের পথ ও আমাদের অবস্থান (২)


ইতিহাসের কালো অধ্যায়গুলো নিজ গতিতে রচিত হচ্ছে। এখন যদিও মানুষ তার বিশুদ্ধ আবেগ থেকে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হল, বলতে বলতে ও লিখতে লিখতে একটা সময় সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। এরপর সবাই সবকিছু ভুলে যাবে। একচেটিয়াভাবে তখন শুধু প্রচার হতে থাকবে জালেমদের জুলুমের বৈধতার ব্যাখ্যা। ক্ষমতার মসনদে বসে তখন ইতিহাসের কালো অধ্যায়গুলোকে সাদা করা হবে। 
ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের গলা যখন একেবারেই শুকিয়ে আসবে তখন স্মৃতিগুলোকে টাটকা করতে একজন রোহিঙ্গার প্রয়োজন পড়বে। যে এসে তাঁর শরীরের তাজা এক গ্লাস রক্ত দিয়ে বলবে "নাও, দরকার হলে এটা দিয়েই গলাটা একটু ভিজিয়ে নাও, কলমের কালি হিসেবেও ব্যবহার করতে পারো। তাও আমাদের "জঙ্গি" হয়ে ওঠার সত্য গল্পগুলো মানুষকে একটু বলো। তোমাদের চোখের সামনেই তো ঘটলো সবকিছু।"

একটা আশংকার কথা বললাম। হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই কোন একদিন এমন কিছু আমাদের দেখতে হতেও পারে। কারণ আজকে যখনই আরাকানে রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা ও নির্যাতিত জনগণের মুক্তির জন্য রোহিঙ্গা যুবকেরা সংগ্রাম ও যুদ্ধের পথকে বেছে নিল সাথে সাথেই তাদেরকে "জঙ্গি" লকব দিয়ে তাদের হত্যার বৈধতা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে প্রথম ধাপের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে ভারত। রাষ্ট্রীয়ভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে বলেছে এই "সন্ত্রাস দমনে"র অভিযানে তাঁরা মিয়ানমারের সাথেই আছে।
নরেন্দ্র মোদি গতকালকের সংলাপে আং সান সুচির সাথে একমত হয়ে বলেছেন, মিয়ানমারের সেনা অভিযানের নামে এথনিক ক্লেনজিংকে নাকি কোনভাবেই গণহত্যা বলা যায় না। এটা হচ্ছে “সন্ত্রাসী হামলার মোকাবেলা”। এখন যেটাকে তারা "সন্ত্রাসী হামলার মোকাবেলা" বলছে কিছুদিন পর সেটাকে তারা "জঙ্গি দমন" বলবে এতে একজন সুস্থ সচেতন ব্যক্তির কোনই সন্দেহ থাকার কথা না।

পুরো বিশ্ববাসী যেখানে মায়ানমারের গণহত্যার প্রতিবাদ করছে সেখানে মোদি এসে সুচির এই প্রকাশ্যে গণহত্যাকে নগ্নভাবে সমর্থন দিয়ে ফেললো! কারো কিছুই বলার নেই! এই ক্ষমতার জোরেই যে ইতিহাস বিকৃত করা হবে সে আশংকার কথাই বলছিলাম।

যুগে যুগে মুসলিম বিদ্বেষী শক্তিগুলো এইভাবেই মুসলমানদের রক্তকে হালাল বানিয়ে এসেছে। আর মুসলমানরা নিজেদের একশজনের রক্তের প্রতিরোধে যখন তাদের একজনেরও রক্ত নিতে যায় তখন সেটাকে জঙ্গিবাদ বলে আখ্যা দেয়া হয়। অতঃপর মুসলিম হত্যা নিয়ে যাতে কোন ধরণের উচ্চবাচ্য না হয় সেজন্য একটি বৈধ যুক্তি বানিয়ে সেটার ব্যাপক প্রচার প্রসার হয়। এবং ইতিহাস লেখার সময় এই স্বঘোষিত বৈধতাদানকারী খুনিদের ক্ষমতার ঝাঁঝ এত বেশী থাকে যে অতীতের সব সত্যগুলো তাদের মিথ্যার নিচে চাপা পড়ে যায়। এরপর খুনিরা মজলুমের রক্ত দিয়ে বিকৃত ইতিহাস লিখতে শুরু করে।

বিগত সময়ে যতবার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে ততবারই সামাজিকভাবে শরণার্থীদের পাশে দাড়ানোর এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি আমরা বাংলাদেশীরা। কিন্তু একথা আমরা সবাই জানি যে এইভাবে আশ্রয় দিয়ে যাওয়াতে কোন স্থায়ী সমাধান আসবে না। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য নিজেদেরই সোচ্চার হতে হবে। প্রতিবাদ করে ঘুরে দাড়ানোর মত সাহস না দেখাতে পারলে এ অত্যাচার কখনই থামবেনা। এর সবচেয় বড় প্রমাণ হল বিগত সময়গুলোতে শুধু নীরবে নির্যাতন সহ্য করে যাওয়ার পরও নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আশার কথা হচ্ছে একটু দেরী করে হলেও রোহিঙ্গারা এই সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।

ইতিবাচক দিক হল, যুদ্ধ বা প্রতিরোধ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মুক্তির যে দ্বিতীয় আর কোন স্থায়ী সমাধান নেই এটা বাংলাদেশের জনগণের বুঝতেও খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছেনা। কারণ বাংলার জনগণ জানে মুক্তিযুদ্ধের মানে কি। কখন এর প্রয়োজন পড়ে। তাই বাঙালিরা কেউই রোহিঙ্গাদের আন্দোলনকে জঙ্গিবাদ বলে মুখস্থ বুলি আওড়াচ্ছে না। তারা রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের পরিপূর্ণভাবে নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের বাঙ্গালী সমাজের অনেকেই রোহিঙ্গাদের এই ধরণের প্রতিরোধকে কোনভাবেই সমর্থন করতে পারছেন না। উনারা মুক্তিযুদ্ধকে অতি পবিত্র ভাবেন। রোহিঙ্গাদের মত "অপবিত্র" জাতি এই পবিত্র কাজ কিছুতেই আঞ্জাম দিতে পারবেনা! উনারা আবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশেরও বিরোধিতা করেন। এবং তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এসে তাদের পাশে দাড়ালে সেটা নিয়েও উনারা খুব বেশি খুশি হতে মানা করেন। নো অফেন্স, "ব্যতিক্রম চিন্তা"র এই মানুষগুলোকে দেখে মনে হয় তারাও মোদিজীর মত সুচীর এই অভিযানকে সন্ত্রাসী দমনই বলতে চাচ্ছেন। এ তাদের চিন্তার স্বাধীনতা। এ নিয়ে মন্তব্য করার কোন অধিকার আমার নেই।

আসলে নৈতিকতার জায়গা থেকে আন্তর্জাতিক কোন সংকট নিরসনের কথা চিন্তা করার ক্ষমতা ভারতের কোনকালে ছিল কিনা এটা জানতে হলে আমার হয়তো আরো পড়াশুনা বাড়াতে হবে। নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, একাত্তরে আমাদের বাঙালিজাতির কাছে যেটা স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল, ছিল মুক্তিযুদ্ধ, ভারতের কাছে সেটা ছিল নিছকই তাদের রাজনৈতিক একটা স্বার্থ। কাকতালীয়ভাবে হলেও সত্য যে এখনো রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে যাওয়াটা ভারতের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের অনেক বড় একটা অংশ। এতে কাশমিরের বিদ্রোহ পুনরায় শুরু হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। ওদিকে মিয়ানমারকে সাথে রাখলে স্ট্র্যাটেজিকাল পয়েন্ট হিসেবে সুবিধা ভোগের ব্যাপার তো আছেই।

মৌন সমর্থন দিয়ে যাওয়ার পেছনে স্বার্থ আছে চীনেরও। আরাকানে রোহিঙ্গাদের বসবাস বাধা হয়ে রয়েছে তাদের বড় বড় সব প্রকল্পে। এখন তাদের মতে, দুনিয়ার মানুষের এত সব কথা শুনে বিশেষ কোন ফায়দা নেই। তারা চোখ কান বন্ধ রেখে কোনরকমে নিজেদের গন্তব্যে পৌছাতে পারলেই হল।

অতএব স্বাধীনতা, সংগ্রাম বা মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে অধিকার ফিরিয়ে আনার বিষয়গুলো তাদের উপলব্ধিতে আসার আশায় বসে থেকে লাভ নেই। আমাদের বাঙালিদের এই বোধটুকু আছে বলেই আমরা দাবী করতে পারি যে আমরা এখনো সুস্থ বিবেক নিয়ে বেচে আছি। এবং সে হিসেবে দাবী করাই যায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের জনগণের সামাজিক ও চিন্তাগত অবস্থান এখনো প্রশংসনীয়। তবে মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যৎ আশংকামুক্ত নয়। দাদাদের গলাবাজির সময় যেন সত্য বলতে বা লিখতে গিয়ে আমাদের কণ্ঠস্বর বা কলমের কালি কোনটাই শুকিয়ে না আসে। ইতিহাস আমাদেরকেই লিখতে হবে। আমাদেরকেই বলতে হবে।

Wednesday, September 6, 2017

টেকনাফের স্মৃতি ও ত্রাণ বিতরণের অভিজ্ঞতা

অক্টোবর ২০১৬। ঘড়ির কাটা তখন রাত সাড়ে দশটা পেরিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বেশ তৎপর হওয়ায় দিনের বেলা কাজে বের হওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। গতকাল তো আমাদের টিমের একজন হুজুর ধরাই পড়ে গিয়েছিলেন প্রায়। ঘন্টাখানেক আটকে রেখে বিজিবি এ কথা বলে ছেড়ে দেয় যে "হুজুর যা করবেন গোপনে করবেন, চোখের সামনে পড়ে গেলে আমাদের কিছুই করার থাকবেনা।" অতএব গোপনীয়তা রক্ষা করতেই আমাদের রাতে বের হতে হয়েছে। এখন যে স্পটে যাচ্ছি সেখানে একটি চেকপোস্টের কড়া নিরাপত্তা অতিক্রম করে যেতে হবে।

রাস্তার একপাশে পাহাড় আরেকপাশে নাফনদি। শুনশান নিরব রাস্তায় অটোরিক্সা আমাদের নিয়ে বেশ গতিতে চলছে। ভয় এখন শুধুই চেকপোষ্ট। কিছু একটা বলতে হবে যাতে বিজিবি আমাদের সন্দেহ না করে। তাদের সাথে কথা বলার দায়িত্বটা আমার সাথে থাকা স্থানীয় তাবলিগি হুজুর নিয়ে আমাকে চুপ থাকতে বললেন।

দূর থেকে ইশারা দিয়ে অটরিক্সা থামিয়ে দুইজন বর্ডারগার্ড সামনে আসছে। পাওয়ারফুল টর্চের আলোটা একেবারে চোখের উপর মারলো।
-কোথায় যাচ্ছেন?
-মারকায মসজিদে?
-কি কাজে?
-তাবলিগে।
-উনি কে? (আমাকে দেখিয়ে)
-উনি ঢাকা থেকে এসেছেন। তাবলীগী মেহমান।

এরপর আরো কয়েক সেকেন্ড টর্চের আলোয় ঢাকার মেহমানের চেহারাটা দেখে ছেড়ে দিল। প্রাথমিক ভয়টা কেটে গেছে। দুই পকেটে তখন পঞ্চাশ হাজার টাকার দুইটা বান্ডেল। চেক করলেই তো এত টাকা নিয়ে কোথায় যাচ্ছি এর উত্তর দিতে গিয়ে আমতা আমতা করতে হত।

কিন্তু বড় ভয়টা তখনও কাটেনি। রাখাইন বৌদ্ধদের নির্যাতনে রোহিঙ্গারা এপাড়ে আসতে শুরু করলেই টেকনাফ এলাকার সন্ত্রাসী গ্রুপ তৎপর হয়ে ওঠে। ভাগ বাটোয়ারায় অংশ নেয় স্থানীয় পাতিনেতা ও তাদের চামচারা। আমরা ত্রাণ নিয়ে এসেছি এই কোন ভাবসাব যদি তাদের চোখে ধরা পড়ে তাহলেই আমাদের লুট করা হবে।
সেদিন সকালে আবার পত্রিকায় নিউজেও দেখলাম, স্থানীয় কাউন্সেলর এলাকার ওসি ও ডিসির সাথে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রশাসনের অনুমতি ও সহযোগিতা ব্যতিত কেউ ত্রাণ বিতরণ করতে আসলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তারা ত্রাণগুলোকে একটা সুশৃঙ্খল নিয়মের মধ্যে এনে লুট করতে চাইছিল। আমরা সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সতর্ক ছিলাম।

ত্রাণ বিতরণে আরেক প্রতিবন্ধকতা পুরাতন রোহিঙ্গারা। রাস্তায় যারা থাকে তাদের বেশিরভাগই পুরান রোহিঙ্গা। যারা ত্রাণ গ্রহণ করাটাকে একটা ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। কিছু পুরান রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ব্যবসা তো এতটাই জমজমাট যে তাদের ঘরবাড়ির তৈজসপত্র দেখে আমরা রীতিমত টাসকি খেয়েছিলাম।
এসব কারণে রোহিঙ্গাদের প্রকৃত হকদারদের হাতে টাকা পৌছানো খুব কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

রাত এগারোটায় গন্তব্যে পৌছলাম। এলাকার নাম দমদমিয়া। সদ্য আশ্রয় নেয়া প্রচুর রোহিঙ্গা রয়েছে এখানে। এরা সবাই অনিবন্ধিত। খোজ পেলেই এদের ধরে নিয়ে গিয়ে নিবন্ধিত ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। এরপর শুরু হবে তাদের জীবনের আরেকটা নির্মম অধ্যায়। আমাদের টার্গেট ছিল এইসব সদ্য আশ্রয় নেয়া অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের খুজে বের করে এদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা। কারণ এরাই প্রকৃত হকদার। পুরাতনরাও অনেক ক্ষেত্রে হকদার। তবে তাদ্রর হাতে টাকা দেয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত না। বরং তারা যেসব এরিয়াতে থাকছে সেখানে কূয়া বা এমন কিছু করে দিতে হবে যাতে নির্দিষ্ট একটা শ্রেণি টাকা না মারতে পারে।

দমদমিয়ায় এসে যা যা দেখেছি আর শুনেছি তা গা শিউরে ওঠার মত। ওপাড়ে চলতে থাকা নির্যাতনে ভয়াবহ বর্ণনা শুনেছি প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে। ঘরে ঘরে লুকিয়ে আছে এরা। বের হতে প্রচন্ড ভয় পায়। যেই সন্তানদের চোখের সামনে তাদের বাবা মাকে, যেই স্ত্রীর চোখের সামনে তাদের স্বামীকে জবাই করা হয়েছে তারা শোকে যেন বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। কথা বলতে পারছিল না একদম। বেশিরভাগই ট্রামাটাইজড হয়ে গেছে। চেহারায় আতংকের ছাপ দেখেও আতকে উঠেছিলাম।

এটা গত অক্টোবরের নির্যাতন চলাকালে এপাড়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখা অভিজ্ঞতা বললাম। এইবার যারা গিয়ে কাজ করছে তাদের থেকে জানতে পারলাম গতবারের তুলনায় এইবার নির্যাতনের মাত্রা কয়েকগুণ বেশী। গতবারের থেকে বেশী হলে অবস্থা কতটা ভয়াবহ হতে পারে সেটা আমার পক্ষেই আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছেনা।

যারা এখন ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন বা কারো মাধ্যমে পৌছাতে চাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ।
১ স্থানীয় বিশ্বস্ত লোকদের সাহায্য নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করলেই প্রকৃত হকদারদের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়া সম্ভব।
২ গতবার যারা কাজ করেছিল তাদের মধ্যে এইবারও যারা ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে তাদের মাধ্যমে পাঠানো যেতে পারে।
৩ অনেক রোহিঙ্গারা ওপাড় থেকে আহত হয়ে আসছে। স্থানীয় হাসপাতালে তাদের সবার চিকিৎসা করা সম্ভব না। তাদের জন্য মেডিকেল ক্যাম্প করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কিছু ওষুধপাতি ব্যবস্থা করে দেয়াটা খুব বেশী প্রয়োজন। কিন্তু এই মেডিকেল ক্যাম্পের সময়ও স্থানীয় কুলাঙ্গারগুলো আমাদের বিরক্ত করেছিল। কৌশলে কাজ করতে হবে।
৪ কিছু এরিয়া আছে যেখানে রোহিঙ্গারা নতুন উঠছে। এদের ঘর উঠানোর খরচ দেয়া যেতে পারে।
৫ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারা যেই জায়গাগুলোতে থাকছে সেখানে পানির খুব সমস্যা। আশেপাশে কয়েক মাইলে পানির কোন ব্যবস্থা নেই। এটা স্থায়ী এবং অনেক বড় একটা খেদমত। তাদের জন্য কিছু কূপ খনন করে দেয়া। আমরা তিনটা জায়গায় করেছিলাম। খরচ তেমন বেশী পড়েনি।
৬ কাজ বাইরে থাকা বিচ্ছিন্ন অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মাঝে করতে হবে। নিবন্ধিত ক্যাম্পের ভেতর অনেকগুলো সমস্যার কারণে কাজের কোন সুযোগ বা অবস্থা নেই।

এটা আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানি ছিল যে আমরা কাজের শুরুতেই সৎ ও যোগ্য তিনজন রাহবার পেয়েছিলাম। তাদের কারণেই আসল হকদার কাছে মানুষের দেয়া আমানতগুলো পৌছাতে পেরেছিলাম। একজন ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী আলেম। হাটহাজারীর ফারেগ। আরেকজন স্থানীয় তাবলীগি হুজুর। উনারা আমাদেরকে রাতের বেলায় বহুদূরের পথ হেটে হেটে প্রকৃত হকদারদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।

তখন গিয়ে কাজ শুরু করতে খুব একটা সময় লাগেনি। কারণ আমরা যাওয়ার একসপ্তাহ আগে নিজ উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলেন Gazi Yakub মামা। তিনিই খুজে বের করেছিলেন এই দুইজন স্থানীয় রাহবারকে। উনাকে আমি মামা বলি কারণ উনি নানার রূহানী সন্তান। নিজেকে লৌকিকতামুক্ত রেখে কাজ করে যাওয়ার এই গুণটা তার আছে।

কে কি করছে সেদিক না ভেবে উনি গতবারের মত এইবারও অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে দাড়াতে ইয়াকুব মামা ছুটে গিয়েছেন নিজ উদ্যোগে। উনাকে যারা চিনেন তারা জানেন উনার কাছে টাকা দিলে সেটা জায়গা মত গিয়ে পৌছাবে। খুব বেশীদিন হয়নি বড় ধরণের একটা অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছেন। এরমধ্যেই আবার শুরু করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। আল্লাহ তায়ালা তার এই মেহনতকে কবুল করুন।

ইয়াকুব মামা এখন টেকনাফে আছেন। আমি তার বিকাশ নাম্বারটা চেয়েছিলাম। বলেছেন কেউ দিলে এমনি দিবে। কথাটা ভাল লেগেছে।
এখন আমার বন্ধুতালিকার কেউ যদি রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য পাঠাতে চান তাহলে ইয়াকুব মামার ইনবক্স বা আমার ইনবক্স থেকে বিকাশ নাম্বার নিয়ে সাহায্য পাঠাতে পারেন।

Monday, September 4, 2017

কুরবানীর ঈদ ও চামড়া সংগ্রহ

দেশে আজ কুরবানীর তৃতীয় দিন শেষ হল। অন্যান্য বছর আজকের দিনটা আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ থাকতো। দুইদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে আজকের দিনে এর ফলাফল আসতো।

২০০৮ সালে যখন লালবাগ জামেয়ায় তাইসির জামাতে ভর্তি হয়েছিলাম সে বছর থেকেই চামড়া কালেকশনের কাজ শুরু। খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য নতুনদের মত প্রথম প্রথম কাজটা করতে একদমই ভাল লাগতো না। মানুষ কুরবানী দিবে, আর আমরা নিজেদের খুশির ঈদকে মাটি করে এইসব চামড়া টানাটানি করবো।

নানাজী তখন মুহতামিম। তো কুরবানীর আগের জলসায় তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে নিজের চামড়া কালেকশনের ঘটনা শুনালেন। তখন মনে হল উনার মত বড় আলেমরাও ঈদের দিনে চামড়া টেনেছেনে! এরপরও তো আল্লাহ তাকে আজ জাতির কাছে কত সম্মানিত করেছেন। আসলে যার দ্বীনের ইলম চর্চা হওয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করবো সম্মান দেয়া নেয়া তো তারই হাতে। এই দিক থেকে ভেবে কাজটাকে এরপর থেকে আর অপছন্দ করতে পারিনি।

মাদরাসায় চামড়ার সংগ্রহের গ্রুপ প্রায় বিশটার মত। নিজ গ্রুপের চামড়া সংগ্রহের সংখ্যা বাড়িয়ে নিজেদের অবস্থান এগিয়ে নেয়ার একটা প্রতিযোগিতা হয় লালবাগে। যখন কাজ শুরু করেছিলাম আমাদের গ্রুপ ছিল আট নাম্বারে। এক বছর কাজ করতে না করতেই প্রতিযোগিতাটাকে উপভোগ করতে শুরু করলাম। বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হল ব্যাপারটা। এরপর থেকে গ্রুপকে এগিয়ে নেয়ার ফিকির ঢুকার পর থেকে চামড়া সংগ্রহের কাজটাকে আর খারাপ লাগতো না। নায়েবে আমীর ফারুক সাহেব হুজুরের নেতৃত্বে চার বছরের মাথায় গ্রুপ আট থেকে দুই নাম্বারে চলে আসলো। আমাদের গ্রুপের চামড়া সংগ্রহের সংখ্যাও এ সময়ের ভেতর ত্রিশ থেকে একশতে গিয়ে দাড়িয়েছে।

একটা সময় মনে হতে লাগলো যেই ঈদে বিশ পচিশটা গরু জবাই আর চামড়া টানাটানি করে জামায় কুরবানীর রক্তও না মাখাতে পারবো সেই ঈদকে তো কুরবানীর ঈদই মনে হবেনা। এবং আমার এই উপলব্ধিটা এ বছর মিশরে কাটানো কুরবানীর ঈদে একেবারে সত্যি বলে মনে হল।

তবে এটাও সত্যি, অনেকেই কাজটা শুধুমাত্র মাদরাসার জন্য করে। এই কুরবানীকে উপভোগ করার মধ্যেও থাকে পরিবার থেকে ঈদের সময় দূরে থাকার কুরবানী। মাদরাসার ফিকির নিয়ে সব হুজুররা ব্যস্ত। এবং পরিবারের সবাই এটা মেনেই নিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল, যারা কাজ করে তাদের কাছে এটা কোন সমস্যা মনে না হলেও অনেকেই এই কাজটাকে নেতিবাচকভাবে দেখতে পছন্দ করেন।

চামড়া সংগ্রহ করতে যাওয়া মাদরাসার ছাত্রদের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকানোর আগে একটা ব্যাপার মাথায় রাখা উচিত, মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে সবাই দান সদকার চামড়ার টাকায় চলা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের খানা খেয়ে পড়াশুনা করেনা। এমন অনেক ছেলেকে আমি দেখেছি যারা নিজেরাই দুই-তিনটা গরু কুরবানী দেয় কিন্তু এদিকে মাদরাসার জন্য সবকিছু ফেলে দুইদিন চামড়া সংগ্রহের কাজ করে। তার তো কাজ করার কোন দরকার নেই। এইভাবে না খাটলে মাদরাসাও তাকে কিছু বলবেনা।সে নিজেও মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং থেকে খায় না।
তাও সে কেন এত কষ্ট করে?

কারণটা হল, সে আল্লাহর দ্বীন যেই প্রতিষ্ঠানে চর্চা হয় সেই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ভাবতে চায়। তার সহপাঠিদের মধ্যে যারা তুলনামূলক অসচ্ছল, পরিবার থেকে পড়ালেখার খরচের যোগান দেয়া সম্ভব হয়না তাদের পড়ালেখার খরচ হিসেবে মাদরাসা থেকে বরাদ্দ যে আয়টা আছে সেই আয়টা মাদরাসায় আসুক সেটা সে চায়। এই ছোট্ট অবদানটুকু রাখতে বছরের দুইটা দিন কুরবানী করে। এবং এতে সে কুরবানীর প্রকৃত আনন্দ খুজে পায়। এমন ঘটনাও ঘটেছে, যারা মাদরাসার গোরাবা ফান্ড থেকে শিক্ষার খরচ পায়, তারা বাড়ি চলে যাচ্ছে। আর যারা মাদরাসায় সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে পড়াশুনা করছে, তারা এই চামড়া সংগ্রহের খেদমতে অংশ নিচ্ছে। কারণ, মাদরাসাগুলোর নিয়ম হল, যারা কাজ করতে অসামর্থ্য, তারা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। এখানেও কিন্তু ত্যাগের ব্যাপারটাই তাদের কাছে আসল ছিল। তারা এটা তাদের দায়িত্ব হিসেবেই নিয়েছিল।

তাও কেন এক শ্রেণির লোকদের এই কুরবানীগুলোকে ছোট করে দেখতে হবে? আমার কাছে এই শ্রেণির লোকগুলোকে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মনে হয়। মানে তাদের কাছে নীতি নৈতিকতার সংজ্ঞা এলিটিজমের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তন হয়। এলিটরা ভিক্ষা করলেও সেটা সমাজসেবা আর হুজুররা সমাজসেবা করলেও সেটা ভিক্ষা বা তাঁর চেয়েও জঘন্য কিছু। যেমন জাগো ফাউন্ডেশনের মত অন্যান্য এলিট শ্রেণির কর্মী নিয়ে গঠিত সামাজিক সংগঠনগুলো যখন পথশিশুদের জন্য রাস্তায় ফুল বিক্রি করে অথবা ডোনেশনের জন্য বড় ব্যবসায়ীদের কাছে হাত পাতে তখন সেই কালেকশন করে বেড়ানোটাকে তুচ্ছ করে এইসব লোকেরা কোনদিন কিছু বলেন না। যত নিচেই নামুক এদের কাজটাকে সামাজিক কাজ বলেই প্রশংসা করতে দেখা যায়।

আমরা অবশ্যই জাগো ফাউন্ডেশন সহ অন্যান্য সব সামাজিক সংগঠনের সোশাল ওয়ার্ককে এপ্রিশিয়েট করি। কিন্তু সেই একই কাজ যখন মাদরাসার কিছু ছেলেপেলে করে থাকে, সেই ডোনেশনই মানুষের কাছ থেকে কষ্ট করে নিয়ে তার প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দিতে একজন কর্মী হিসেবে সাহায্য করে। এবং তাদের অসচ্ছল, গরিব ছাত্র ভাই যাদের সাথে তারা এক টেবিলে বসে পড়াশুনা করে তাদের শিক্ষার খরচের নির্দিষ্ট ফান্ডের জন্য এই ছেলেগুলো নিজের ঈদটাকে পর্যন্ত কুরবানী করে। এরপরও মাদরাসার এই ছেলেদের অবদানকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হবে? জাগো ফাউন্ডেশন করলেই সামাজিক কাজ আর যে ধর্মীয় শিক্ষা সমাজ ব্যবস্থাকে হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছে সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার মেহনতকে কাজ বলে স্বীকার করতে সমস্যা। এই ধরনের মন-মানসিকতাকেই হিপোক্রেসি বা মুনাফেকি বলা হয়। এসব অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

Sunday, September 3, 2017

কায়রোর দিনলিপি (১০)

ঈদের দ্বিতীয়দিন




৬,৮৫৩ কিলোমিটার বিস্তৃত এই নীলনদকে যে অতীত নিকটেও বিশ্বের দীর্ঘতম নদী বলা হত এ নিয়ে কোন বিতর্ক ছিল না। তবে বিতর্কটা আধুনিক সময়ে এসে অনেকে করতে চান। তারা বলতে চান আমাজন নদীর বিস্তৃতি এর চাইতেও বেশি। 



সত্যি কথা বলতে, গতকাল ঈদের দ্বিতীয় দিন বিকেলে যখন নীলের পাড়ে বসে সন্ধ্যার নির্মল বাতাস উপভোগ করছিলাম তখন এইসব বিতর্ক মাথায় এনে নীলকে দ্বিতীয় স্থানে ভাবতে ইচ্ছে করেনি।



মিসর দেখানোর অনুরোধ ছিল। তাই ক্যামেরায় ধারণ করা গতকাল বিকেলের কিছু ছবি পোষ্ট করলাম। আসলে নীলের তুলনা শুধু নীলই। এটা বুঝতে হলে তাঁর পাড়ে অবশ্যই একটা নির্লিপ্ত বিকেল কাটানো প্রয়োজন।



মিসরের সভ্যতা এত প্রাচীনকাল থেকে শুরু হওয়ার পেছনে নীলনদের অবদান মিসর কখনোই অস্বীকার করেনা। নীল নিয়ে তাদের গৌরব আছে। তাই তো ঈদ উদযাপনে একটা বিকেল কাটাতে দূর দূরান্ত থেকে তারা ছুটে আসে নীলের পাড়ে



The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...