Saturday, September 2, 2017

কায়রোর দিনলিপি (৯)

ঈদুল আযহা - ২০১৭

একটা হাসির কান্ড দিয়ে সকালটা শুরু হল। মসজিদে রাহমানুর রাহিমে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার নিয়ত করেছিলাম। তো যেই টেক্সিতে উঠেছি কোন কারণবশত সেই টেক্সিওয়ালার মেজাজ সকালবেলাতেই চরম রকম গরম ছিল। কেবল একটা গাড়ি তাকে ওভারটেক করাতেই সে একেবারে ক্ষেপে অস্থির। অন্য সময় হলে অবশ্যই এতক্ষণে গালি দেওয়া শুরু করতো। এখন ঈদের সকাল বলে বেচারা ক্ষোভটাও ঝাড়তে পারছেনা। 

অবশেষে নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে সে ঝাড়ির সুরেই বললো "কুল্লু সানা ওয়াআনতা তায়্যিব"। সাধারণত মিসরীরা ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে এই ফ্রেজটা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু এখন ড্রাইভার বেচারা তো ঈদের দিন সকালে আর গালি দিতে পারছেনা। তাই একরাশ বিরক্তি নিয়ে সে গালির মত করে এই শুভেচ্ছাবাক্য দ্বারা ঝাড়ি দিয়ে বিকল্প পন্থায় ক্ষোভ ঝাড়লো। পরিস্থিতি যে কতটা হাস্যকর ছিল সেটা লিখে বুঝানো সম্ভব না।
সকাল সকাল তার এ ধরনের মেজাজ খারাপের সম্ভাব্য কারণগুলো আমরা বাংলায় আন্দাজ করে করে বলছি আর হাসছি। হঠাৎ সে গাড়ি থামিয়ে বললো "তোমাদের ভাড়া দেয়া লাগবেনা। নেমে যাও। আমি আর তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি না।"
আল্লাহই জানে, আচানক তার কি হয়ে গেল।
এই মিসরী ড্রাইভার আবার আমাদের বাংলা হাসাহাসি বুঝে ফেলেনি তো। বুঝলেও কিছু করার ছিলনা। সে যা কাণ্ডকারখানা দেখাচ্ছিল তাতে না হেসে উপায়ও ছিলনা।

ওদিকে নামাজের সময় বেশি নেই। কে এখন এই পাগলের সাথে তর্ক করতে যাবে? এর কান্ড দেখে মেজাজ খারাপের থেকে হাসিই বেশি আসছিল। সকাল সকাল কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম। নেমে হাটা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু না, হেটে গিয়ে রাহমানুর রহিমে নামাজ পাওয়া যাবেনা। অবশেষে নামাজ পড়া হল মদিনাতুল বুয়ুসের মসজিদে। এক হিসেবে ভালই হল। কিছু বাঙালি ছাত্রভাইদের সাথে দেখা হল। এবং দেখা হল একটা মিসরী গরুর সাথে, যাকে ক্রয় করা হয়েছে আজ রাতের অনুষ্ঠানে আমাদের খাওয়ানোর জন্য।

নামাজ পড়ে এসে সবার আগে ভিডিও কলে আম্মু আব্বু আর বোনদের সাথে কথা না বললে কি আর ঈদ শুরু হয়!
এরপর দেশীয় লাচ্ছি সেমাই খেয়ে একটু ঈদকে একটু দেশীয় ফ্লেভার দেয়ার প্রচেষ্টা এবং নুডুলস অর্ধেক রান্না করে আরেকজনের হাতে দিয়ে শুয়ে শুয়ে বাকি রান্না শেষ হওয়ার অপেক্ষা করা। অত:পর অপেক্ষা করতে করতে নুডুলস না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়া। ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে দেশ থেকে আনা পোলাউয়ের চাউল দিয়ে পোলাও রান্না করা এবং আগের রাতে ঈদ উপলক্ষে রন্ধনকৃত অতিমসলাদার গরুর গোশত সহকারে তা ভক্ষণ করা।

এরপর বিকেলের ঘুরাঘুরি হল হাদিকাতুল আযহারে। কাছেধারে কোথাও বিকেল কাটানোর জন্য বেশ চমৎকার একটা জায়গা। সেখান থেকে সালাউদ্দিন আইয়ুবির কেল্লা দেখা যায়। আজকে আর যাওয়া যাবে না। কেল্লা চারটার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। অতএব আগামীকাল কেল্লায় যাওয়ার প্রোগ্রাম করা হল এবং আজকের মত কেল্লাকে পেছনে রেখে ছবি তুলেই ক্ষান্ত হতে হল।

যেহেতু পার্ক থেকে বের হতেই এই রাস্তা অতএব অনেককেই হেটে দৌড়ে পার হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু গাড়ি তার গতি একদমই কমাচ্ছে না। কারণ এটা সালাহ সালেম রোড। এই রোডে গাড়ির গতি কমানোটা মিশরীরা বোধহয় হারাম মনে করে। এর পরিবর্তে দুইচারজনের জান গেলে তাতে এদের বিশেষ কিছু করার নেই। সাইফুল ভাই রাস্তা পারাপারের আগ মুহূর্তে কিছু মনে করিয়ে দিলেন
-মাহদি ভাই! এটা কিন্তু সেই সালাহ সালেম রোড যেখানে আপনার চোখেন সামনে যুবায়ের জানে বেচে গিয়েছিল। তবে আমার চোখের সামনে অনেক মানুষ এই রোডে এক্সিডেন্টে মারা গেছে। চলেন রাস্তা পার হই।
-ভাই! মজা কইরেন না। আমার পা ব্যথা এখনো ভাল হয়নাই। খোঁড়ায় খোড়ায় হাটতে গিয়া আজকে ঈদের নামাজ ধরতে কষ্ট হয়া গেছে।
-আরে ভাই! টেনশন নিয়েন না। প্রয়োজনে পাচটা মিসরীকে ঢাল বানায় রাস্তা পার হবো।

অবশেষে আমি দ্বিতীয়বারের মত আশংকামুক্তভাবে কোন রকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া সালাহ সালেম রোড পার হলাম। এটাকে এই ঈদের অন্যতম বিশেষ ঘটনা বলা যেতে পারে।

সেখান থেকে আসা হল ইত্তেহাদের রাতের দাওয়াতে। খাওয়া দাওয়ার পর বাঙালি ছাত্রদের মধ্যে পরিচিত প্রায় সবার সাথেই দেখা হল। অনেক কথাবার্তা হল। তখন পুরো সময়টাতে একদমই মনে হয়নি দেশের বাইরে ঈদ করছি। এই কয়টা দিনের মধ্যেই সবার সাথে কেমন গভীর একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। স্টুডেন্ট অরগ্যানাইজেশনকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে ঈদের দিনের জন্য অপরিহার্য এমন একটা প্রোগ্রাম করার জন্য।

No comments:

Post a Comment

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...