Wednesday, September 6, 2017

টেকনাফের স্মৃতি ও ত্রাণ বিতরণের অভিজ্ঞতা

অক্টোবর ২০১৬। ঘড়ির কাটা তখন রাত সাড়ে দশটা পেরিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বেশ তৎপর হওয়ায় দিনের বেলা কাজে বের হওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। গতকাল তো আমাদের টিমের একজন হুজুর ধরাই পড়ে গিয়েছিলেন প্রায়। ঘন্টাখানেক আটকে রেখে বিজিবি এ কথা বলে ছেড়ে দেয় যে "হুজুর যা করবেন গোপনে করবেন, চোখের সামনে পড়ে গেলে আমাদের কিছুই করার থাকবেনা।" অতএব গোপনীয়তা রক্ষা করতেই আমাদের রাতে বের হতে হয়েছে। এখন যে স্পটে যাচ্ছি সেখানে একটি চেকপোস্টের কড়া নিরাপত্তা অতিক্রম করে যেতে হবে।

রাস্তার একপাশে পাহাড় আরেকপাশে নাফনদি। শুনশান নিরব রাস্তায় অটোরিক্সা আমাদের নিয়ে বেশ গতিতে চলছে। ভয় এখন শুধুই চেকপোষ্ট। কিছু একটা বলতে হবে যাতে বিজিবি আমাদের সন্দেহ না করে। তাদের সাথে কথা বলার দায়িত্বটা আমার সাথে থাকা স্থানীয় তাবলিগি হুজুর নিয়ে আমাকে চুপ থাকতে বললেন।

দূর থেকে ইশারা দিয়ে অটরিক্সা থামিয়ে দুইজন বর্ডারগার্ড সামনে আসছে। পাওয়ারফুল টর্চের আলোটা একেবারে চোখের উপর মারলো।
-কোথায় যাচ্ছেন?
-মারকায মসজিদে?
-কি কাজে?
-তাবলিগে।
-উনি কে? (আমাকে দেখিয়ে)
-উনি ঢাকা থেকে এসেছেন। তাবলীগী মেহমান।

এরপর আরো কয়েক সেকেন্ড টর্চের আলোয় ঢাকার মেহমানের চেহারাটা দেখে ছেড়ে দিল। প্রাথমিক ভয়টা কেটে গেছে। দুই পকেটে তখন পঞ্চাশ হাজার টাকার দুইটা বান্ডেল। চেক করলেই তো এত টাকা নিয়ে কোথায় যাচ্ছি এর উত্তর দিতে গিয়ে আমতা আমতা করতে হত।

কিন্তু বড় ভয়টা তখনও কাটেনি। রাখাইন বৌদ্ধদের নির্যাতনে রোহিঙ্গারা এপাড়ে আসতে শুরু করলেই টেকনাফ এলাকার সন্ত্রাসী গ্রুপ তৎপর হয়ে ওঠে। ভাগ বাটোয়ারায় অংশ নেয় স্থানীয় পাতিনেতা ও তাদের চামচারা। আমরা ত্রাণ নিয়ে এসেছি এই কোন ভাবসাব যদি তাদের চোখে ধরা পড়ে তাহলেই আমাদের লুট করা হবে।
সেদিন সকালে আবার পত্রিকায় নিউজেও দেখলাম, স্থানীয় কাউন্সেলর এলাকার ওসি ও ডিসির সাথে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রশাসনের অনুমতি ও সহযোগিতা ব্যতিত কেউ ত্রাণ বিতরণ করতে আসলে তাকে গ্রেফতার করা হবে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তারা ত্রাণগুলোকে একটা সুশৃঙ্খল নিয়মের মধ্যে এনে লুট করতে চাইছিল। আমরা সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সতর্ক ছিলাম।

ত্রাণ বিতরণে আরেক প্রতিবন্ধকতা পুরাতন রোহিঙ্গারা। রাস্তায় যারা থাকে তাদের বেশিরভাগই পুরান রোহিঙ্গা। যারা ত্রাণ গ্রহণ করাটাকে একটা ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। কিছু পুরান রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ব্যবসা তো এতটাই জমজমাট যে তাদের ঘরবাড়ির তৈজসপত্র দেখে আমরা রীতিমত টাসকি খেয়েছিলাম।
এসব কারণে রোহিঙ্গাদের প্রকৃত হকদারদের হাতে টাকা পৌছানো খুব কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

রাত এগারোটায় গন্তব্যে পৌছলাম। এলাকার নাম দমদমিয়া। সদ্য আশ্রয় নেয়া প্রচুর রোহিঙ্গা রয়েছে এখানে। এরা সবাই অনিবন্ধিত। খোজ পেলেই এদের ধরে নিয়ে গিয়ে নিবন্ধিত ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। এরপর শুরু হবে তাদের জীবনের আরেকটা নির্মম অধ্যায়। আমাদের টার্গেট ছিল এইসব সদ্য আশ্রয় নেয়া অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের খুজে বের করে এদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা। কারণ এরাই প্রকৃত হকদার। পুরাতনরাও অনেক ক্ষেত্রে হকদার। তবে তাদ্রর হাতে টাকা দেয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত না। বরং তারা যেসব এরিয়াতে থাকছে সেখানে কূয়া বা এমন কিছু করে দিতে হবে যাতে নির্দিষ্ট একটা শ্রেণি টাকা না মারতে পারে।

দমদমিয়ায় এসে যা যা দেখেছি আর শুনেছি তা গা শিউরে ওঠার মত। ওপাড়ে চলতে থাকা নির্যাতনে ভয়াবহ বর্ণনা শুনেছি প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে। ঘরে ঘরে লুকিয়ে আছে এরা। বের হতে প্রচন্ড ভয় পায়। যেই সন্তানদের চোখের সামনে তাদের বাবা মাকে, যেই স্ত্রীর চোখের সামনে তাদের স্বামীকে জবাই করা হয়েছে তারা শোকে যেন বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। কথা বলতে পারছিল না একদম। বেশিরভাগই ট্রামাটাইজড হয়ে গেছে। চেহারায় আতংকের ছাপ দেখেও আতকে উঠেছিলাম।

এটা গত অক্টোবরের নির্যাতন চলাকালে এপাড়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখা অভিজ্ঞতা বললাম। এইবার যারা গিয়ে কাজ করছে তাদের থেকে জানতে পারলাম গতবারের তুলনায় এইবার নির্যাতনের মাত্রা কয়েকগুণ বেশী। গতবারের থেকে বেশী হলে অবস্থা কতটা ভয়াবহ হতে পারে সেটা আমার পক্ষেই আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছেনা।

যারা এখন ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন বা কারো মাধ্যমে পৌছাতে চাচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ।
১ স্থানীয় বিশ্বস্ত লোকদের সাহায্য নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করলেই প্রকৃত হকদারদের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়া সম্ভব।
২ গতবার যারা কাজ করেছিল তাদের মধ্যে এইবারও যারা ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে তাদের মাধ্যমে পাঠানো যেতে পারে।
৩ অনেক রোহিঙ্গারা ওপাড় থেকে আহত হয়ে আসছে। স্থানীয় হাসপাতালে তাদের সবার চিকিৎসা করা সম্ভব না। তাদের জন্য মেডিকেল ক্যাম্প করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কিছু ওষুধপাতি ব্যবস্থা করে দেয়াটা খুব বেশী প্রয়োজন। কিন্তু এই মেডিকেল ক্যাম্পের সময়ও স্থানীয় কুলাঙ্গারগুলো আমাদের বিরক্ত করেছিল। কৌশলে কাজ করতে হবে।
৪ কিছু এরিয়া আছে যেখানে রোহিঙ্গারা নতুন উঠছে। এদের ঘর উঠানোর খরচ দেয়া যেতে পারে।
৫ অনিবন্ধিত রোহিঙ্গারা যেই জায়গাগুলোতে থাকছে সেখানে পানির খুব সমস্যা। আশেপাশে কয়েক মাইলে পানির কোন ব্যবস্থা নেই। এটা স্থায়ী এবং অনেক বড় একটা খেদমত। তাদের জন্য কিছু কূপ খনন করে দেয়া। আমরা তিনটা জায়গায় করেছিলাম। খরচ তেমন বেশী পড়েনি।
৬ কাজ বাইরে থাকা বিচ্ছিন্ন অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের মাঝে করতে হবে। নিবন্ধিত ক্যাম্পের ভেতর অনেকগুলো সমস্যার কারণে কাজের কোন সুযোগ বা অবস্থা নেই।

এটা আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানি ছিল যে আমরা কাজের শুরুতেই সৎ ও যোগ্য তিনজন রাহবার পেয়েছিলাম। তাদের কারণেই আসল হকদার কাছে মানুষের দেয়া আমানতগুলো পৌছাতে পেরেছিলাম। একজন ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী আলেম। হাটহাজারীর ফারেগ। আরেকজন স্থানীয় তাবলীগি হুজুর। উনারা আমাদেরকে রাতের বেলায় বহুদূরের পথ হেটে হেটে প্রকৃত হকদারদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।

তখন গিয়ে কাজ শুরু করতে খুব একটা সময় লাগেনি। কারণ আমরা যাওয়ার একসপ্তাহ আগে নিজ উদ্যোগে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলেন Gazi Yakub মামা। তিনিই খুজে বের করেছিলেন এই দুইজন স্থানীয় রাহবারকে। উনাকে আমি মামা বলি কারণ উনি নানার রূহানী সন্তান। নিজেকে লৌকিকতামুক্ত রেখে কাজ করে যাওয়ার এই গুণটা তার আছে।

কে কি করছে সেদিক না ভেবে উনি গতবারের মত এইবারও অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে দাড়াতে ইয়াকুব মামা ছুটে গিয়েছেন নিজ উদ্যোগে। উনাকে যারা চিনেন তারা জানেন উনার কাছে টাকা দিলে সেটা জায়গা মত গিয়ে পৌছাবে। খুব বেশীদিন হয়নি বড় ধরণের একটা অসুস্থতা কাটিয়ে উঠেছেন। এরমধ্যেই আবার শুরু করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। আল্লাহ তায়ালা তার এই মেহনতকে কবুল করুন।

ইয়াকুব মামা এখন টেকনাফে আছেন। আমি তার বিকাশ নাম্বারটা চেয়েছিলাম। বলেছেন কেউ দিলে এমনি দিবে। কথাটা ভাল লেগেছে।
এখন আমার বন্ধুতালিকার কেউ যদি রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য পাঠাতে চান তাহলে ইয়াকুব মামার ইনবক্স বা আমার ইনবক্স থেকে বিকাশ নাম্বার নিয়ে সাহায্য পাঠাতে পারেন।

No comments:

Post a Comment

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...