Monday, September 4, 2017

কুরবানীর ঈদ ও চামড়া সংগ্রহ

দেশে আজ কুরবানীর তৃতীয় দিন শেষ হল। অন্যান্য বছর আজকের দিনটা আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ থাকতো। দুইদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে আজকের দিনে এর ফলাফল আসতো।

২০০৮ সালে যখন লালবাগ জামেয়ায় তাইসির জামাতে ভর্তি হয়েছিলাম সে বছর থেকেই চামড়া কালেকশনের কাজ শুরু। খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য নতুনদের মত প্রথম প্রথম কাজটা করতে একদমই ভাল লাগতো না। মানুষ কুরবানী দিবে, আর আমরা নিজেদের খুশির ঈদকে মাটি করে এইসব চামড়া টানাটানি করবো।

নানাজী তখন মুহতামিম। তো কুরবানীর আগের জলসায় তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে নিজের চামড়া কালেকশনের ঘটনা শুনালেন। তখন মনে হল উনার মত বড় আলেমরাও ঈদের দিনে চামড়া টেনেছেনে! এরপরও তো আল্লাহ তাকে আজ জাতির কাছে কত সম্মানিত করেছেন। আসলে যার দ্বীনের ইলম চর্চা হওয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করবো সম্মান দেয়া নেয়া তো তারই হাতে। এই দিক থেকে ভেবে কাজটাকে এরপর থেকে আর অপছন্দ করতে পারিনি।

মাদরাসায় চামড়ার সংগ্রহের গ্রুপ প্রায় বিশটার মত। নিজ গ্রুপের চামড়া সংগ্রহের সংখ্যা বাড়িয়ে নিজেদের অবস্থান এগিয়ে নেয়ার একটা প্রতিযোগিতা হয় লালবাগে। যখন কাজ শুরু করেছিলাম আমাদের গ্রুপ ছিল আট নাম্বারে। এক বছর কাজ করতে না করতেই প্রতিযোগিতাটাকে উপভোগ করতে শুরু করলাম। বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হল ব্যাপারটা। এরপর থেকে গ্রুপকে এগিয়ে নেয়ার ফিকির ঢুকার পর থেকে চামড়া সংগ্রহের কাজটাকে আর খারাপ লাগতো না। নায়েবে আমীর ফারুক সাহেব হুজুরের নেতৃত্বে চার বছরের মাথায় গ্রুপ আট থেকে দুই নাম্বারে চলে আসলো। আমাদের গ্রুপের চামড়া সংগ্রহের সংখ্যাও এ সময়ের ভেতর ত্রিশ থেকে একশতে গিয়ে দাড়িয়েছে।

একটা সময় মনে হতে লাগলো যেই ঈদে বিশ পচিশটা গরু জবাই আর চামড়া টানাটানি করে জামায় কুরবানীর রক্তও না মাখাতে পারবো সেই ঈদকে তো কুরবানীর ঈদই মনে হবেনা। এবং আমার এই উপলব্ধিটা এ বছর মিশরে কাটানো কুরবানীর ঈদে একেবারে সত্যি বলে মনে হল।

তবে এটাও সত্যি, অনেকেই কাজটা শুধুমাত্র মাদরাসার জন্য করে। এই কুরবানীকে উপভোগ করার মধ্যেও থাকে পরিবার থেকে ঈদের সময় দূরে থাকার কুরবানী। মাদরাসার ফিকির নিয়ে সব হুজুররা ব্যস্ত। এবং পরিবারের সবাই এটা মেনেই নিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল, যারা কাজ করে তাদের কাছে এটা কোন সমস্যা মনে না হলেও অনেকেই এই কাজটাকে নেতিবাচকভাবে দেখতে পছন্দ করেন।

চামড়া সংগ্রহ করতে যাওয়া মাদরাসার ছাত্রদের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকানোর আগে একটা ব্যাপার মাথায় রাখা উচিত, মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে সবাই দান সদকার চামড়ার টাকায় চলা লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের খানা খেয়ে পড়াশুনা করেনা। এমন অনেক ছেলেকে আমি দেখেছি যারা নিজেরাই দুই-তিনটা গরু কুরবানী দেয় কিন্তু এদিকে মাদরাসার জন্য সবকিছু ফেলে দুইদিন চামড়া সংগ্রহের কাজ করে। তার তো কাজ করার কোন দরকার নেই। এইভাবে না খাটলে মাদরাসাও তাকে কিছু বলবেনা।সে নিজেও মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং থেকে খায় না।
তাও সে কেন এত কষ্ট করে?

কারণটা হল, সে আল্লাহর দ্বীন যেই প্রতিষ্ঠানে চর্চা হয় সেই প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ভাবতে চায়। তার সহপাঠিদের মধ্যে যারা তুলনামূলক অসচ্ছল, পরিবার থেকে পড়ালেখার খরচের যোগান দেয়া সম্ভব হয়না তাদের পড়ালেখার খরচ হিসেবে মাদরাসা থেকে বরাদ্দ যে আয়টা আছে সেই আয়টা মাদরাসায় আসুক সেটা সে চায়। এই ছোট্ট অবদানটুকু রাখতে বছরের দুইটা দিন কুরবানী করে। এবং এতে সে কুরবানীর প্রকৃত আনন্দ খুজে পায়। এমন ঘটনাও ঘটেছে, যারা মাদরাসার গোরাবা ফান্ড থেকে শিক্ষার খরচ পায়, তারা বাড়ি চলে যাচ্ছে। আর যারা মাদরাসায় সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে পড়াশুনা করছে, তারা এই চামড়া সংগ্রহের খেদমতে অংশ নিচ্ছে। কারণ, মাদরাসাগুলোর নিয়ম হল, যারা কাজ করতে অসামর্থ্য, তারা ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাবে। এখানেও কিন্তু ত্যাগের ব্যাপারটাই তাদের কাছে আসল ছিল। তারা এটা তাদের দায়িত্ব হিসেবেই নিয়েছিল।

তাও কেন এক শ্রেণির লোকদের এই কুরবানীগুলোকে ছোট করে দেখতে হবে? আমার কাছে এই শ্রেণির লোকগুলোকে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মনে হয়। মানে তাদের কাছে নীতি নৈতিকতার সংজ্ঞা এলিটিজমের উপর ভিত্তি করে পরিবর্তন হয়। এলিটরা ভিক্ষা করলেও সেটা সমাজসেবা আর হুজুররা সমাজসেবা করলেও সেটা ভিক্ষা বা তাঁর চেয়েও জঘন্য কিছু। যেমন জাগো ফাউন্ডেশনের মত অন্যান্য এলিট শ্রেণির কর্মী নিয়ে গঠিত সামাজিক সংগঠনগুলো যখন পথশিশুদের জন্য রাস্তায় ফুল বিক্রি করে অথবা ডোনেশনের জন্য বড় ব্যবসায়ীদের কাছে হাত পাতে তখন সেই কালেকশন করে বেড়ানোটাকে তুচ্ছ করে এইসব লোকেরা কোনদিন কিছু বলেন না। যত নিচেই নামুক এদের কাজটাকে সামাজিক কাজ বলেই প্রশংসা করতে দেখা যায়।

আমরা অবশ্যই জাগো ফাউন্ডেশন সহ অন্যান্য সব সামাজিক সংগঠনের সোশাল ওয়ার্ককে এপ্রিশিয়েট করি। কিন্তু সেই একই কাজ যখন মাদরাসার কিছু ছেলেপেলে করে থাকে, সেই ডোনেশনই মানুষের কাছ থেকে কষ্ট করে নিয়ে তার প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দিতে একজন কর্মী হিসেবে সাহায্য করে। এবং তাদের অসচ্ছল, গরিব ছাত্র ভাই যাদের সাথে তারা এক টেবিলে বসে পড়াশুনা করে তাদের শিক্ষার খরচের নির্দিষ্ট ফান্ডের জন্য এই ছেলেগুলো নিজের ঈদটাকে পর্যন্ত কুরবানী করে। এরপরও মাদরাসার এই ছেলেদের অবদানকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হবে? জাগো ফাউন্ডেশন করলেই সামাজিক কাজ আর যে ধর্মীয় শিক্ষা সমাজ ব্যবস্থাকে হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছে সে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার মেহনতকে কাজ বলে স্বীকার করতে সমস্যা। এই ধরনের মন-মানসিকতাকেই হিপোক্রেসি বা মুনাফেকি বলা হয়। এসব অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

No comments:

Post a Comment

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...