ইতিহাসের কালো অধ্যায়গুলো নিজ গতিতে রচিত হচ্ছে। এখন যদিও মানুষ তার বিশুদ্ধ আবেগ থেকে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা হল, বলতে বলতে ও লিখতে লিখতে একটা সময় সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। এরপর সবাই সবকিছু ভুলে যাবে। একচেটিয়াভাবে তখন শুধু প্রচার হতে থাকবে জালেমদের জুলুমের বৈধতার ব্যাখ্যা। ক্ষমতার মসনদে বসে তখন ইতিহাসের কালো অধ্যায়গুলোকে সাদা করা হবে।
ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের গলা যখন একেবারেই শুকিয়ে আসবে তখন স্মৃতিগুলোকে টাটকা করতে একজন রোহিঙ্গার প্রয়োজন পড়বে। যে এসে তাঁর শরীরের তাজা এক গ্লাস রক্ত দিয়ে বলবে "নাও, দরকার হলে এটা দিয়েই গলাটা একটু ভিজিয়ে নাও, কলমের কালি হিসেবেও ব্যবহার করতে পারো। তাও আমাদের "জঙ্গি" হয়ে ওঠার সত্য গল্পগুলো মানুষকে একটু বলো। তোমাদের চোখের সামনেই তো ঘটলো সবকিছু।"
একটা আশংকার কথা বললাম। হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই কোন একদিন এমন কিছু আমাদের দেখতে হতেও পারে। কারণ আজকে যখনই আরাকানে রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা ও নির্যাতিত জনগণের মুক্তির জন্য রোহিঙ্গা যুবকেরা সংগ্রাম ও যুদ্ধের পথকে বেছে নিল সাথে সাথেই তাদেরকে "জঙ্গি" লকব দিয়ে তাদের হত্যার বৈধতা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে প্রথম ধাপের কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে ভারত। রাষ্ট্রীয়ভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়ে বলেছে এই "সন্ত্রাস দমনে"র অভিযানে তাঁরা মিয়ানমারের সাথেই আছে।
নরেন্দ্র মোদি গতকালকের সংলাপে আং সান সুচির সাথে একমত হয়ে বলেছেন, মিয়ানমারের সেনা অভিযানের নামে এথনিক ক্লেনজিংকে নাকি কোনভাবেই গণহত্যা বলা যায় না। এটা হচ্ছে “সন্ত্রাসী হামলার মোকাবেলা”। এখন যেটাকে তারা "সন্ত্রাসী হামলার মোকাবেলা" বলছে কিছুদিন পর সেটাকে তারা "জঙ্গি দমন" বলবে এতে একজন সুস্থ সচেতন ব্যক্তির কোনই সন্দেহ থাকার কথা না।
পুরো বিশ্ববাসী যেখানে মায়ানমারের গণহত্যার প্রতিবাদ করছে সেখানে মোদি এসে সুচির এই প্রকাশ্যে গণহত্যাকে নগ্নভাবে সমর্থন দিয়ে ফেললো! কারো কিছুই বলার নেই! এই ক্ষমতার জোরেই যে ইতিহাস বিকৃত করা হবে সে আশংকার কথাই বলছিলাম।
যুগে যুগে মুসলিম বিদ্বেষী শক্তিগুলো এইভাবেই মুসলমানদের রক্তকে হালাল বানিয়ে এসেছে। আর মুসলমানরা নিজেদের একশজনের রক্তের প্রতিরোধে যখন তাদের একজনেরও রক্ত নিতে যায় তখন সেটাকে জঙ্গিবাদ বলে আখ্যা দেয়া হয়। অতঃপর মুসলিম হত্যা নিয়ে যাতে কোন ধরণের উচ্চবাচ্য না হয় সেজন্য একটি বৈধ যুক্তি বানিয়ে সেটার ব্যাপক প্রচার প্রসার হয়। এবং ইতিহাস লেখার সময় এই স্বঘোষিত বৈধতাদানকারী খুনিদের ক্ষমতার ঝাঁঝ এত বেশী থাকে যে অতীতের সব সত্যগুলো তাদের মিথ্যার নিচে চাপা পড়ে যায়। এরপর খুনিরা মজলুমের রক্ত দিয়ে বিকৃত ইতিহাস লিখতে শুরু করে।
বিগত সময়ে যতবার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে ততবারই সামাজিকভাবে শরণার্থীদের পাশে দাড়ানোর এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি আমরা বাংলাদেশীরা। কিন্তু একথা আমরা সবাই জানি যে এইভাবে আশ্রয় দিয়ে যাওয়াতে কোন স্থায়ী সমাধান আসবে না। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য নিজেদেরই সোচ্চার হতে হবে। প্রতিবাদ করে ঘুরে দাড়ানোর মত সাহস না দেখাতে পারলে এ অত্যাচার কখনই থামবেনা। এর সবচেয় বড় প্রমাণ হল বিগত সময়গুলোতে শুধু নীরবে নির্যাতন সহ্য করে যাওয়ার পরও নির্যাতনের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আশার কথা হচ্ছে একটু দেরী করে হলেও রোহিঙ্গারা এই সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
ইতিবাচক দিক হল, যুদ্ধ বা প্রতিরোধ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মুক্তির যে দ্বিতীয় আর কোন স্থায়ী সমাধান নেই এটা বাংলাদেশের জনগণের বুঝতেও খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছেনা। কারণ বাংলার জনগণ জানে মুক্তিযুদ্ধের মানে কি। কখন এর প্রয়োজন পড়ে। তাই বাঙালিরা কেউই রোহিঙ্গাদের আন্দোলনকে জঙ্গিবাদ বলে মুখস্থ বুলি আওড়াচ্ছে না। তারা রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের পরিপূর্ণভাবে নৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের বাঙ্গালী সমাজের অনেকেই রোহিঙ্গাদের এই ধরণের প্রতিরোধকে কোনভাবেই সমর্থন করতে পারছেন না। উনারা মুক্তিযুদ্ধকে অতি পবিত্র ভাবেন। রোহিঙ্গাদের মত "অপবিত্র" জাতি এই পবিত্র কাজ কিছুতেই আঞ্জাম দিতে পারবেনা! উনারা আবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশেরও বিরোধিতা করেন। এবং তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এসে তাদের পাশে দাড়ালে সেটা নিয়েও উনারা খুব বেশি খুশি হতে মানা করেন। নো অফেন্স, "ব্যতিক্রম চিন্তা"র এই মানুষগুলোকে দেখে মনে হয় তারাও মোদিজীর মত সুচীর এই অভিযানকে সন্ত্রাসী দমনই বলতে চাচ্ছেন। এ তাদের চিন্তার স্বাধীনতা। এ নিয়ে মন্তব্য করার কোন অধিকার আমার নেই।
আসলে নৈতিকতার জায়গা থেকে আন্তর্জাতিক কোন সংকট নিরসনের কথা চিন্তা করার ক্ষমতা ভারতের কোনকালে ছিল কিনা এটা জানতে হলে আমার হয়তো আরো পড়াশুনা বাড়াতে হবে। নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, একাত্তরে আমাদের বাঙালিজাতির কাছে যেটা স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল, ছিল মুক্তিযুদ্ধ, ভারতের কাছে সেটা ছিল নিছকই তাদের রাজনৈতিক একটা স্বার্থ। কাকতালীয়ভাবে হলেও সত্য যে এখনো রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষে যাওয়াটা ভারতের নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের অনেক বড় একটা অংশ। এতে কাশমিরের বিদ্রোহ পুনরায় শুরু হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। ওদিকে মিয়ানমারকে সাথে রাখলে স্ট্র্যাটেজিকাল পয়েন্ট হিসেবে সুবিধা ভোগের ব্যাপার তো আছেই।
মৌন সমর্থন দিয়ে যাওয়ার পেছনে স্বার্থ আছে চীনেরও। আরাকানে রোহিঙ্গাদের বসবাস বাধা হয়ে রয়েছে তাদের বড় বড় সব প্রকল্পে। এখন তাদের মতে, দুনিয়ার মানুষের এত সব কথা শুনে বিশেষ কোন ফায়দা নেই। তারা চোখ কান বন্ধ রেখে কোনরকমে নিজেদের গন্তব্যে পৌছাতে পারলেই হল।
অতএব স্বাধীনতা, সংগ্রাম বা মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে অধিকার ফিরিয়ে আনার বিষয়গুলো তাদের উপলব্ধিতে আসার আশায় বসে থেকে লাভ নেই। আমাদের বাঙালিদের এই বোধটুকু আছে বলেই আমরা দাবী করতে পারি যে আমরা এখনো সুস্থ বিবেক নিয়ে বেচে আছি। এবং সে হিসেবে দাবী করাই যায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের জনগণের সামাজিক ও চিন্তাগত অবস্থান এখনো প্রশংসনীয়। তবে মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যৎ আশংকামুক্ত নয়। দাদাদের গলাবাজির সময় যেন সত্য বলতে বা লিখতে গিয়ে আমাদের কণ্ঠস্বর বা কলমের কালি কোনটাই শুকিয়ে না আসে। ইতিহাস আমাদেরকেই লিখতে হবে। আমাদেরকেই বলতে হবে।
No comments:
Post a Comment