এখন সবার মুখে একটাই প্রশ্ন। দীর্ঘকাল থেকে চলে আসা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কি? বাংলাদেশ তো রাষ্ট্রীয়ভাবে পাশে দাড়াবেনা বলেই দিয়েছে। কেন দাঁড়াবে না এর পেছনে যে যুক্তি আছে সেটা বেশ শক্তিশালী। শুধু আবেগ দিয়ে ঠেলাঠেলা করলেই সে যুক্তি কেন ঠুনকো হয়ে যাবে না সেটা একটু পরে বলছি।
আন্তর্জাতিক চাপ দিয়ে যারা সমাধান করার কথা ভাবছেন তাদের খেয়াল করা দরকার, জাতিসংঘ কিন্তু প্রতিবারের মত এবারও বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়াতে বলছে। কিন্তু জাতিসংঘ গত পঞ্চাশ বছরে যেই পরিমাণ ধ্বজভঙ্গতার পরিচয় দিয়েছে এরপরও এখন আর এই ইস্যুতে তাদের কথা কতটুকু গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্যতা রাখে এটা বাংলাদেশ বুঝে নিয়েছে। তাদের অক্ষমতা বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়েছিল গত অক্টোবরের গণহত্যা চলাকালে কফি আনান যখন মংডু সফর করেছিল। মিয়ানমার সফরকালে তার গাড়ির সামনে রোহিঙ্গাদের কুপিয়ে লাশ বানিয়েছে মগদস্যুরা। কফি আনান ফিরে গিয়ে কেবলই একটা অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট দিয়ে তার দায়িত্ব পুরা করেছেন। অত:পর জাতিসংঘ আবারো তার চিরচায়িত রীতি মোতাবেক বাংলাদেশকে পাশে দাড়ানোর আহবান জানিয়েছে। এইভাবেই এই ঘটনায় জাতিসংঘের মূল্যবান ভূমিকার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। এই হল আন্তর্জাতিক চাপ দিয়ে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন বন্ধ করার অবাস্তব প্রত্যাশার একটা জবাব। এভাবে আরো অনেক জবাব আছে।
এখন আসি, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য আসলে কি করতে পারে। বাংলাদেশ যে কি করতে পারে, সেটা বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে প্রমাণ করে আসছে। কি পরিমাণ রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়েছে এর হিসেব কষতে হলে খুব বেশী দূরের ইতিহাস ঘাটতে হবেনা। ফলাফল কি দাড়িয়েছে?
আশ্রয় দিয়েছে বলে আজকে মগরা একেবারে নিজেদের মুল্লুক দাবী করে বসেছে। বাংলাদেশ যেন রোহিঙ্গাদের পৈতৃক সম্পত্তি। থাকার জায়গা দিয়ে রহম করার পর এর ধরণের আচরণ কি নিমকহারামি না?
বলবেন, রোহিঙ্গাদের কি দোষ? দোষ আছে। টেকনাফ গিয়ে এক সপ্তাহ পরিস্থিতিটা দেখে আসলে যে কেউ বুঝতে পারবে ব্যাপারটা।
রোহিঙ্গাদের মেরে এপাড়ে পাঠিয়ে দেয়ার সময়ই তাদের মাথায় রাখাইন বৌদ্ধরা এটা ভাল মত ঢুকিয়ে দেয় যে "তোরা আসলে বাংলাদেশের নাগরিক।" এবং বিগত পঞ্চাশ বছরে রোহিঙ্গারা এটাই প্রমাণ করেছে যে রাখাইনদের এই মিথ্যাকথা বিশ্বাস করেই তারা বর্ডার পার হয়। তাছাড়া এখন তো রোহিঙ্গাদের মেরে মেরে এপাড়ে পাঠানোর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে রাখাইনরা এটাই বলছে যে রোহিঙ্গারা নাকি মূলত বাঙালিই ছিল।
আমি নিজেও এর একটা প্রমাণ পেয়েছি। গতবার গিয়ে যেই কয়জনের সাথে কথা বলেছিলাম, এই প্রশ্নটা করেছিলাম, "আপনাদের দেশের অবস্থা ভাল হলে কি আপনারা ফিরে যাবেন?"
ওয়াল্লাহি, একজনও বলেনি ফিরে যাবে।
এমনকি একটা ভিডিও ফুটেজ নেয়ার জন্য আমার এই কথাটা দরকার ছিল যে "তারা নিজেদের দেশে ফিরে যেতে চায় কিন্তু পারছেনা, তারা এতটাই নির্যাতিত।" ক্যামেরার সামনে এই কথাটুকু তারা নিজের মুখে বলবে। অবাক হয়েছিলাম, সেদিন রোহিঙ্গা লোকটার মুখ দিয়ে এই কথাটা বের করাতে আমার সাতবার সেই ভিডিও শটটা নিতে হয়েছে। সে মুখ দিয়ে কোনভাবেই উচ্চারণ করতে চায়না যে সে ফিরে যাবে।
প্রথমে ভেবেছি মাত্র নির্যাতিত হয়ে এসেছে। না যেতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরে এদেশে খুটি গেড়ে বসে যে তারা কি অপকর্ম করে স্থানীয় লোকজনের কাছে যখন তা জানতে পারলাম তখন যেতে না চাওয়ার আসল কারণটা বুঝতে পেরেছি। নানান সমস্যা সৃষ্টি করতে সুবিধা হওয়ার কারণে তারা আসলেই আর ফিরে যেতে চায়না। যেসব কারণে পরবর্তীতে বাঙালি স্থানীর লোকজন বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে। এ কারণে অনেকে তাদেরকে সাহায্য করাটাও পছন্দ করেনা। যদিও টেকনাফবাসীই মানবতার খাতিরে নিজেদের ঘরে জায়গা না থাকার পরও তাদের জায়গা দেয়।
এভাবেই তাদের ব্রেইন ওয়াশ করে এই দেশে পাঠানো হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশে বিশেষ করে টেকনাফে বেশ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। আগে আমাদের এটা ভালমত জানা দরকার যে রোহিঙ্গারা বাঙালী না।
১৭৮৪ সালে যখন প্রথমবারের মত স্বাধীন রাষ্ট্র আরাকান ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মিয়ানমারের অধীনে নেয়া হয় তখন থেকেই এই রোহিঙ্গা সমস্যার সূচনা। এর আগে মুঘল আমলে আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। এবং তখন আতাকানের শাসকদের মধ্যে মুঘলদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। আর সে সময় যে রোহিঙ্গারাই বসবাস করতো এই ইতিহাস স্বতঃসিদ্ধ। এবং ডা. শায়েখ আরেফি তার এক লেকচারে এ কথাও বলছিলেন আরাকানে রোহিঙ্গাদের বসবাসের সূচনা বাদশাহ হারুনুর রশিদের যুগ থেকে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় বারোশত বছর আগের ঘটনা। এরপরও মিয়ানমারের অশিক্ষিত গর্দভগুলা যে কোন ইতিহাসের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের বাঙালী বলে চালিয়ে দিতে চায় এটা বুঝে আসেনা।
বরং কি পরিমাণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ জায়গা দিয়েছে এর একটা ফিরিস্তি সকাল বিকাল এই গর্দভগুলোকে পানি দিয়ে গুলিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।
১৯৩৭ সালে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার পর থেকে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু। তখন অনেক রোহিঙ্গা মুসলমানদেএ বাংলাদেশে আসা শুরু।
এরপর ১৯৪২ সালে রাখাইনরা জাপানের পক্ষ নিয়ে রোহিঙ্গাদের উপর হামলা শুরু করে এবং মার্চ মাসে ৫ হাজার রোহিঙ্গা হত্যা করে। তখন রোহিঙ্গারা শক্তিশালী ছিল। ৫ হাজারের বিপরীতে তারা বিশ হাজার মগ হত্যা করেছিল। ইতিহাসে এই একটাই বড় ধরনের রোহিঙ্গাদের প্রতিশোধের ঘটনা পাওয়া যায়। তার পর থেকে ১৬ বছর আর কোন সমস্যা হয়নি।
১৯৫৮ সালে ক্ষমতা মজবুত করতে রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান শুরু করে রাখাইন মগরা।
১৯৬২ সালে সামরিক শক্তি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলমানদের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া অব্যাহত আছে।
এরপর ইতিহাসে প্রথম এবং শেষবারের মত ১৯৭১ এ যুদ্ধের সময়ই কিছু বাঙালি আরাকানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। এরপর দেশের অবস্থার উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে তারা ফিরেও এসেছে। কিন্তু ফিরে আসাটা তাদের চোখে পড়েনি। উনারা শুধু আশ্রয় নিতেই দেখেছেন এবং এতেই পুরো মহাভারত শুদ্ধ করার বৈধতা পেয়ে গেছেন। "বাঙালিরা তাদের যুদ্ধের সময় এসে আর বের হয়নি" রোহিঙ্গারা বাঙালি হওয়ার পেছনে ইহাও অন্যতম মহান যুক্তি।
১৯৭৮ এ ভয়াবহ হামলা হয় জেনারেল নে উইনের সময়। তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নাগমিন ড্রাগন নামের এই অভিযানে তারা হত্যাও করেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপে তারা কিছু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়। তবে এটাই প্রথম ও শেষবারের মত বাংলাদেশ থেকে কিছু রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়া।
এরপরের তিন তিনবার ভয়ানক অভিযানে প্রায় পাচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। কিন্তু তারা কেউ ফেরত যায়নি। শুধু অনুপ্রেবশই হয়েছে। এবং এদিকে বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প করার মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা যে নিল নকশার আশংকা করছেন সেই ষড়যন্ত্র হয়তো উপরমহলও কিছুটা আচ করতে পারছে।
তাহলে সমাধান কি? রোহিঙ্গারা এখন কি করবে, কোথায় যাবে, এ নিয়ে সামনের পর্বে লিখবো ইনশাল্লাহ
No comments:
Post a Comment