Thursday, August 31, 2017

রোহিঙ্গা সংকটঃ ত্রাণকর্তা কে? বাংলাদেশ না জাতিসংঘ (১)


এখন সবার মুখে একটাই প্রশ্ন। দীর্ঘকাল থেকে চলে আসা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কি? বাংলাদেশ তো রাষ্ট্রীয়ভাবে পাশে দাড়াবেনা বলেই দিয়েছে। কেন দাঁড়াবে না এর পেছনে যে যুক্তি আছে সেটা বেশ শক্তিশালী। শুধু আবেগ দিয়ে ঠেলাঠেলা করলেই সে যুক্তি কেন ঠুনকো হয়ে যাবে না সেটা একটু পরে বলছি।
আন্তর্জাতিক চাপ দিয়ে যারা সমাধান করার কথা ভাবছেন তাদের খেয়াল করা দরকার, জাতিসংঘ কিন্তু প্রতিবারের মত এবারও বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাড়াতে বলছে। কিন্তু জাতিসংঘ গত পঞ্চাশ বছরে যেই পরিমাণ ধ্বজভঙ্গতার পরিচয় দিয়েছে এরপরও এখন আর এই ইস্যুতে তাদের কথা কতটুকু গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্যতা রাখে এটা বাংলাদেশ বুঝে নিয়েছে। তাদের অক্ষমতা বিশেষভাবে প্রমাণিত হয়েছিল গত অক্টোবরের গণহত্যা চলাকালে কফি আনান যখন মংডু সফর করেছিল। মিয়ানমার সফরকালে তার গাড়ির সামনে রোহিঙ্গাদের কুপিয়ে লাশ বানিয়েছে মগদস্যুরা। কফি আনান ফিরে গিয়ে কেবলই একটা অফিশিয়াল স্টেটমেন্ট দিয়ে তার দায়িত্ব পুরা করেছেন। অত:পর জাতিসংঘ আবারো তার চিরচায়িত রীতি মোতাবেক বাংলাদেশকে পাশে দাড়ানোর আহবান জানিয়েছে। এইভাবেই এই ঘটনায় জাতিসংঘের মূল্যবান ভূমিকার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। এই হল আন্তর্জাতিক চাপ দিয়ে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন বন্ধ করার অবাস্তব প্রত্যাশার একটা জবাব। এভাবে আরো অনেক জবাব আছে।

এখন আসি, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য আসলে কি করতে পারে। বাংলাদেশ যে কি করতে পারে, সেটা বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে প্রমাণ করে আসছে। কি পরিমাণ রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়েছে এর হিসেব কষতে হলে খুব বেশী দূরের ইতিহাস ঘাটতে হবেনা। ফলাফল কি দাড়িয়েছে?

আশ্রয় দিয়েছে বলে আজকে মগরা একেবারে নিজেদের মুল্লুক দাবী করে বসেছে। বাংলাদেশ যেন রোহিঙ্গাদের পৈতৃক সম্পত্তি। থাকার জায়গা দিয়ে রহম করার পর এর ধরণের আচরণ কি নিমকহারামি না?

বলবেন, রোহিঙ্গাদের কি দোষ? দোষ আছে। টেকনাফ গিয়ে এক সপ্তাহ পরিস্থিতিটা দেখে আসলে যে কেউ বুঝতে পারবে ব্যাপারটা।

রোহিঙ্গাদের মেরে এপাড়ে পাঠিয়ে দেয়ার সময়ই তাদের মাথায় রাখাইন বৌদ্ধরা এটা ভাল মত ঢুকিয়ে দেয় যে "তোরা আসলে বাংলাদেশের নাগরিক।" এবং বিগত পঞ্চাশ বছরে রোহিঙ্গারা এটাই প্রমাণ করেছে যে রাখাইনদের এই মিথ্যাকথা বিশ্বাস করেই তারা বর্ডার পার হয়। তাছাড়া এখন তো রোহিঙ্গাদের মেরে মেরে এপাড়ে পাঠানোর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে রাখাইনরা এটাই বলছে যে রোহিঙ্গারা নাকি মূলত বাঙালিই ছিল।

আমি নিজেও এর একটা প্রমাণ পেয়েছি। গতবার গিয়ে যেই কয়জনের সাথে কথা বলেছিলাম, এই প্রশ্নটা করেছিলাম, "আপনাদের দেশের অবস্থা ভাল হলে কি আপনারা ফিরে যাবেন?"
ওয়াল্লাহি, একজনও বলেনি ফিরে যাবে।

এমনকি একটা ভিডিও ফুটেজ নেয়ার জন্য আমার এই কথাটা দরকার ছিল যে "তারা নিজেদের দেশে ফিরে যেতে চায় কিন্তু পারছেনা, তারা এতটাই নির্যাতিত।" ক্যামেরার সামনে এই কথাটুকু তারা নিজের মুখে বলবে। অবাক হয়েছিলাম, সেদিন রোহিঙ্গা লোকটার মুখ দিয়ে এই কথাটা বের করাতে আমার সাতবার সেই ভিডিও শটটা নিতে হয়েছে। সে মুখ দিয়ে কোনভাবেই উচ্চারণ করতে চায়না যে সে ফিরে যাবে।

প্রথমে ভেবেছি মাত্র নির্যাতিত হয়ে এসেছে। না যেতে চাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরে এদেশে খুটি গেড়ে বসে যে তারা কি অপকর্ম করে স্থানীয় লোকজনের কাছে যখন তা জানতে পারলাম তখন যেতে না চাওয়ার আসল কারণটা বুঝতে পেরেছি। নানান সমস্যা সৃষ্টি করতে সুবিধা হওয়ার কারণে তারা আসলেই আর ফিরে যেতে চায়না। যেসব কারণে পরবর্তীতে বাঙালি স্থানীর লোকজন বড় ধরনের সমস্যায় পড়ে। এ কারণে অনেকে তাদেরকে সাহায্য করাটাও পছন্দ করেনা। যদিও টেকনাফবাসীই মানবতার খাতিরে নিজেদের ঘরে জায়গা না থাকার পরও তাদের জায়গা দেয়।

এভাবেই তাদের ব্রেইন ওয়াশ করে এই দেশে পাঠানো হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশে বিশেষ করে টেকনাফে বেশ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। আগে আমাদের এটা ভালমত জানা দরকার যে রোহিঙ্গারা বাঙালী না।

১৭৮৪ সালে যখন প্রথমবারের মত স্বাধীন রাষ্ট্র আরাকান ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মিয়ানমারের অধীনে নেয়া হয় তখন থেকেই এই রোহিঙ্গা সমস্যার সূচনা। এর আগে মুঘল আমলে আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। এবং তখন আতাকানের শাসকদের মধ্যে মুঘলদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। আর সে সময় যে রোহিঙ্গারাই বসবাস করতো এই ইতিহাস স্বতঃসিদ্ধ। এবং ডা. শায়েখ আরেফি তার এক লেকচারে এ কথাও বলছিলেন আরাকানে রোহিঙ্গাদের বসবাসের সূচনা বাদশাহ হারুনুর রশিদের যুগ থেকে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় বারোশত বছর আগের ঘটনা। এরপরও মিয়ানমারের অশিক্ষিত গর্দভগুলা যে কোন ইতিহাসের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের বাঙালী বলে চালিয়ে দিতে চায় এটা বুঝে আসেনা।

বরং কি পরিমাণ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ জায়গা দিয়েছে এর একটা ফিরিস্তি সকাল বিকাল এই গর্দভগুলোকে পানি দিয়ে গুলিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।
১৯৩৭ সালে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার পর থেকে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু। তখন অনেক রোহিঙ্গা মুসলমানদেএ বাংলাদেশে আসা শুরু।

এরপর ১৯৪২ সালে রাখাইনরা জাপানের পক্ষ নিয়ে রোহিঙ্গাদের উপর হামলা শুরু করে এবং মার্চ মাসে ৫ হাজার রোহিঙ্গা হত্যা করে। তখন রোহিঙ্গারা শক্তিশালী ছিল। ৫ হাজারের বিপরীতে তারা বিশ হাজার মগ হত্যা করেছিল। ইতিহাসে এই একটাই বড় ধরনের রোহিঙ্গাদের প্রতিশোধের ঘটনা পাওয়া যায়। তার পর থেকে ১৬ বছর আর কোন সমস্যা হয়নি।
১৯৫৮ সালে ক্ষমতা মজবুত করতে রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযান শুরু করে রাখাইন মগরা।
১৯৬২ সালে সামরিক শক্তি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলমানদের অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া অব্যাহত আছে।

এরপর ইতিহাসে প্রথম এবং শেষবারের মত ১৯৭১ এ যুদ্ধের সময়ই কিছু বাঙালি আরাকানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। এরপর দেশের অবস্থার উন্নতি হওয়ার সাথে সাথে তারা ফিরেও এসেছে। কিন্তু ফিরে আসাটা তাদের চোখে পড়েনি। উনারা শুধু আশ্রয় নিতেই দেখেছেন এবং এতেই পুরো মহাভারত শুদ্ধ করার বৈধতা পেয়ে গেছেন। "বাঙালিরা তাদের যুদ্ধের সময় এসে আর বের হয়নি" রোহিঙ্গারা বাঙালি হওয়ার পেছনে ইহাও অন্যতম মহান যুক্তি।

১৯৭৮ এ ভয়াবহ হামলা হয় জেনারেল নে উইনের সময়। তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্র‍য় নেয়। নাগমিন ড্রাগন নামের এই অভিযানে তারা হত্যাও করেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপে তারা কিছু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়। তবে এটাই প্রথম ও শেষবারের মত বাংলাদেশ থেকে কিছু রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়া।

এরপরের তিন তিনবার ভয়ানক অভিযানে প্রায় পাচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। কিন্তু তারা কেউ ফেরত যায়নি। শুধু অনুপ্রেবশই হয়েছে। এবং এদিকে বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প করার মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা যে নিল নকশার আশংকা করছেন সেই ষড়যন্ত্র হয়তো উপরমহলও কিছুটা আচ করতে পারছে।

তাহলে সমাধান কি? রোহিঙ্গারা এখন কি করবে, কোথায় যাবে, এ নিয়ে সামনের পর্বে লিখবো ইনশাল্লাহ

ভেসে আসছে রোহিঙ্গা শিশুদের লাশ


নাফ নদির ওপাড় থেকে আসা শিশুদের লাশের মিছিল নিয়ে আসা হচ্ছে। ছবিটা দেখার পর কেন যেন মনে হচ্ছে এই শিশুদের আল্লাহর কাছে যেতে অন্য রোহিঙ্গা শিশুদের তুলনায় কষ্ট কিছুটা হলেও কম হয়েছে। 

গত বছর অক্টোবরের গণহত্যায় বর্ডার পার হয়ে টেকনাফে যেই শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকে যে কতটা নির্মমভাবে আহত করা হয়েছিল টেকনাফে ত্রাণ দিতে গিয়ে তার কিছু চিত্র নিজ চোখে দেখে এসেছিলাম। ঢাকা ফেরার পথে টেকনাফ হসপিটালে যাওয়া হয়। সেখানে মারাত্মকভাবে আহত শিশুর সংখ্যা তখন অনেক। বেশিরভাগ শিশুর বয়স পাচ থেকে সাতের ভেতর হবে। কারো পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ করা। কারো কোমর পর্যন্ত। বেডে জায়গা নেই বলে অধিকাংশই মেঝেতে শুয়ে বসে চিকিৎসা নিচ্ছে। কারো মা কোলে নিয়ে বসে আছেন। আর যাদের মাকে মেরে ফেলা হয়েছে বা ওপাড় থেকে আসতে দেয়া হয়নি বা পথে হারিয়ে ফেলেছেন নিজের সন্তানকে সেইসব শিশুর অন্য কোন আত্মীয় পাশে বসে আছে। ব্যান্ডেজের কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম, এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর পুরো শরীর পলিথিন দিয়ে পেচিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে মানুষরূপী হায়নাগুলো। অপলক দৃষ্টিতে আমাদের চোখের পানির দিকে বাচ্চাগুলো তাকিয়ে ছিল সেদিন। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমরা কি এদের জন্য কিছু করতে পেরেছি? এখনো তো পারছিনা।

সেখানেই একটা বাচ্চা দূর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বয়স দুইবছর। তার শরিরে কোন ক্ষত দেখা যাচ্ছেনা। সামনে গিয়ে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করতেই উনি বাচ্চাটাকে দাড় করালেন। এসব দেখে চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব না। একপাশের কোমর পাথর মেরে নামিয়ে দেয়া হয়েছে এইটুকুন বাচ্চাটার। কোমরের হাড্ডিটা জায়গা থেকে সরে যাওয়ায় সে আর দাঁড়াতে পারবেনা।

এইতো গেল হাসপাতালের ভেতরের অবস্থা। কিন্তু আহতদের অর্ধেকও এখানে নেই। বাইরের একটা বাচ্চার অবস্থা বলি। যেই বাচ্চাটি তার শরীরের পোড়া চামড়াগুলোর যন্ত্রণায় ঠিক ততক্ষণ কাদতে থাকে যতক্ষণ যে জেগে থাকে। এরপর যখন সে ঘুমায় তখনই দুঃস্বপ্ন দেখে আতকে উঠে। কারণ তার চোখের সামনে তার নিজের বাবা মাকে জবাই করার পর যখন তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তখন তার দাদী তাকে নিয়ে পালিয়ে এসে জান বাচিয়েছে। এসব নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতে চাইবেনা। এমন আরো অনেকেই ধরা পড়ার ভয়ে চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় ভয়াবহ যন্ত্রণা সয়ে দিন পার করছে।

এক বছর শেষ হতে না হতেই আবার শুরু হল মুসলমানদের রক্ত নিয়ে রক্তপিপাসুদের হলিখেলা। অর্ধশতাব্দির ধারাবাহিকতায় এইবারও আমরা নিরবে সয়ে যাচ্ছি সবকিছু। এখন দুঃখ প্রকাশের একটা জায়গা আছে আমাদের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সেই অসহায় নির্যাতিত শিশুদেরই লাশের মিছিলের ছবি দেখে যাচ্ছি। সমবেদনা জানাচ্ছি। পোষ্ট লিখছি। ধিক্কার জানাচ্ছি। অনেক করে ফেলছি আসলেই।

ছবিতে বড় দেখালেও নদিটা আসলে অনেক ছোট। মিছিলটা সে তুলনায় একটু বড় হয়ে যাওয়ার কারণে পথেই হয়তো আটকে যাচ্ছে লাশগুলো। তাই আইলানদের মত পাড়ে এসে পৌছানো সম্ভব হচ্ছেনা রোহিঙ্গা শিশুদের। বাবা মাকেই হয়তো নিজেদের সন্তানদের লাশ এভাবে মাথায় করে পাড়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। আমরা জানিনা লাশের মিছিলের আয়তন আর কতটা বড় হলে বিশ্ববাসীর বিবেক জাগ্রত হবে!  

Wednesday, August 30, 2017

আং সান সু চি ও বিবিসির পুরাতন প্রণয়

আংসান সূচি আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে কিছু মিল খুজে পেয়েছেন বিবিসি সাংবাদিক জোনাহ ফিশার। গতকাল এ নিয়ে তিনি একটি প্রতিবেদন লিখেছেন। বিবিসির ফ্যানপেজে সেটি পোষ্ট করার দুই ঘন্টার মাথায় হাজার ছাড়িয়েছিল এই পোষ্টের শেয়ার। সে হিসেবে একদিনে প্রতিবেদনটা অনেকেরই চোখে পড়ার কথা। 

সুচি এবং ট্রাম্পের মিলটা হল উভয়ের মাথার চুল নিয়েই মিডিয়ায় অত্যাধিক আলোচনা হয় এবং সাংবাদিকদের প্রতি তারা উভয়েই প্রচন্ড ক্ষোভ লালন করে থাকেন।
(নিন্দুকেরা বলবেন সাংবাদিকদের চুলের আলোচনা সহ্য না করতে পেরেই তারা দুজন এইভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেন )

কথা হচ্ছে, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পেছনে যেহেতু বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের তেমন কোন ভূমিকা নেই তাই সাংবাদিকদের প্রতি তার "ক্ষোভনীয়" আচরণ অতটা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু সুচি কি করে পারলো তার উত্থানের পেছনে বিবিসিদের ভূমিকা ভুলে যেতে! যখন সে মিয়ানমারের সামরিক সরকার কর্তৃক রেঙ্গুনে গৃহবন্দি ছিল তখন জীবনের ঝুকি নিয়ে এই আন্তর্জাতিক সাংবাদিকরাই কি সুচিকে বিশ্বে পরিচিত করে তোলেনি? যারা নোবেলটা পর্যন্ত পাইয়ে দিল এত বড় কুরবানীর পরও সুচি তাদের সাথে এহেন অপ্রীতিকর আচরণ কেন করে? কেনু সুচি! কেনু! 

সেই চৌদ্দমাস আগের কথা। শেষবারের মত সাংবাদিকদের সাথে এক বৈঠকে সম্মিলিত হয়েছিলেন সুচি। এরপর কতদিন গেল.. গেল কত রাত.. আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের লোকজন শুধু নীরবে নিভৃতে পানি ফেলেই যাচ্ছেন, ফেলেই যাচ্ছে। (আরেহ, আমি চোখের পানির কথা বলছি  ) কিন্তু সুচি তাদেরকে আর কোন সময় দেননি। এখন সবটুকু সময় শুধু দেশীয় সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে ফটোসেশনের জন্য বরাদ্দ।

ইন দা মিনটাইম, ফিশার সাহেবের সাথে একটা ঘটনা ঘটেছে। যাকে কেন্দ্র করেই মূলত তার এই প্রতিবেদন লেখা। সম্প্রতি শুরু হওয়া নির্যাতনের নির্মম চিত্রগুলো তুলে ধরতে বিবিসি কোন একভাবে রোহিঙ্গাদের এরিয়ায় ঢুকে নিউজ কভার করার অনুমতি আদায় করলো। এবং সেটাও আবার সুচিকে না জানিয়ে। যদিও রোহিঙ্গাদের নির্যাতন নিয়ে মাথাব্যথা করাটা বিবিসির নীতির মধ্যে কখনোই পড়েনি। এরপরও নাকি অনুমতি পেয়েই তারা তাড়াহুড়ো করে রওনা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে পৌঁছেই জানতে পারলো তাদের কোন এক কল্যাণকামী ব্যক্তি সুচির কানে তাদের আগমনের খবর পৌঁছে দিয়েছে। অত:পর সুচি সরাসরি তাদেরকে রোহিঙ্গা নিধনের এরিয়ায় যেতে বাধা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নিরুপায় হয়ে তারা সেখানকার স্থানীয় এক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়ে ফিরে এল। মজার ব্যাপার হল, সেই কর্মকর্তাও সাক্ষাৎকারে দিতে গিয়ে বিবিসিকে সাফ বলে দিল "মায়ানমারের নামে আন্তর্জাতিক মিডিয়া শুধুই প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। আসলে গণহত্যার মত কোন ঘটনাই এখানে ঘটছেনা।"
এই বলে সাংবাদিকদের উলটা বাশ দিয়ে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়া হল।

দুঃখ এখানেই শেষ নয়। রোহিঙ্গা নিধনের সময় সুচির নির্দেশে তার দেশের জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করে জোরদার লেখালেখি চলে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দোষ একটাই, তারা কেন রোহিঙ্গাদের নির্যাতিত বলে "মিথ্যা" নিউজ করবে! সুচি এতবার স্পষ্ট করে বললো যে, "মিয়ানমারে কোন গণহত্যা বা জাতিগত নির্মূল অভিযান চালানো হচ্ছেনা"।
এর সুন্দর ভাবে বলার পরও কেন তারা সুচির একথাকে অন্ধ প্রেমিকের মত বিশ্বাস করছেনা! এরপরও কি তাদের সাথে পুরাতন প্রেমের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়! কক্ষনো না!
তাই ধীরে ধীরে একটা সময় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর সাথে সুচির সম্পর্কটা প্রাক্তন প্রেমিক প্রেমিকার মত হয়ে যায়। এদিকে সুচির ক্ষমতাও পাকাপোক্ত হয়। তাই সেও নিজের উত্থানের পেছনে মিডিয়ার সেইসব অবদানের কথা স্মরণ করার প্রয়োজনবোধ করেনা।

লক্ষণীয় বিষয় হল, সুচির দিক থেকে ভালবাসার অনুপস্থিতি থাকলেও বিবিসি এখনো তার সাথে প্রণয়ের পুরোনো সেই দিনের কথা পুরোপুরি ভুলতে পারেনি। যদিও নিজেদের ইজ্জত বাচাতে সুচিকে দায়সারা একটি পালটা আক্রমণ ফিশার সাহেব এই প্রতিবেদনে করেছেন। এত এত অপমান, কিছু জবাব তো দিতেই হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বলে কথা।

আপত্তি তোলার আগে শুরুতেই সুন্দরভাবে সুচির পক্ষ নিয়ে একটু সাফাই গেয়ে নেয়া হয়েছে সেই প্রতিবেদনে। ফিশার সাহেবের মতে "আংসান সুচি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেনা। তাই তিনি চাইলেই তাদের অভিযান বন্ধ করতে পারেন না।"
মানে তারা বলতে চায় শুধু শুধু সুচিকে সব দোষ দিয়ে লাভ নেই। আচ্ছা, যদি ধরেও নেই যে বিবিসির এই অমূলক দাবির আংশিক সত্যতা আছে এরপরও তো প্রশ্ন থেকে যায়।
-সুচি তাহলে সেনাবাহিনীর গণহত্যার অভিযানের কথা অস্বীকার কেন করে?
-আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জন্য সংবাদমাধ্যম যখন এই নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরতে চায় তখন তাদের কাজে সুচি কঠোরভাবে বাধা কেন দেয়?
-এসব কিছুর পরও কি প্রমাণ হয় না যে সুচি পুরোপুরিভাবে সেনাবাহিনীকে এই গণহত্যার অভিযানে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে যাচ্ছে?

এরপর ফিশার সাহেবের তার দ্বিতীয় আপত্তি তুললেন। সেখানেও পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনয়ের সুর বিদ্যমান।
"রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের সংবাদগুলো নিয়ে যে মিয়ানমারের জাতীয় সংবাদমাধ্যমের উস্কানীমূলক মিথ্যা প্রচারণা চলছে তা তো সুচি বন্ধ করতে পারতেন।"

একদিকে আমরা রোহিঙ্গা হত্যার সংখ্যা গুনে কুল পাচ্ছিনা আর উনারা আছেন উনাদের ইমেজ নিয়ে। সুচি কেন উনার অধীনস্তদের বলে আমাদের ইমেজ সংরক্ষণ করছেন না? ভাবসাব দেখে মনে হয় প্রেম থাকাকালে মান ইজ্জত যে বর্গা দেয়া হয়েছিল তা এখনো ফেরত নেয়া হয়নি। আর রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের খবর যে এমনিতেও তারা কতটুকু প্রচার করে থাকেন বিশ্ববাসী তো তা প্রতিনিয়তই দেখে আসছে।

তো বিবিসি সেখানে না গেলে নিউজ করতে পারেন না? তাহলে আলজাযিরা কিভাবে নিউজ করে? সিরিয়া যুদ্ধের সময় AJ+ ভিডিওগুলো দুনিয়াব্যাপি ভাইরাল হতো তার অনেকগুলোই তো স্থানীয়দের কোন স্মার্টফোনে করা ভিডিও ছিল। সংবাদ প্রচারের ইচ্ছা থাকলে রোহিঙ্গাদের সংবাদগুলোও করা যেত। স্থানীয়দের মোবাইল ফোনে ধারণ করা নির্যাতনের যে ভয়াবহ চিত্র ভিডিও ফুটেজগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে সেগুলো থেকেই প্রচার করা যেত। এসব হল প্রচার না করার বাহানা। প্রচার যাদের করার তারা ঠিকই করে যাচ্ছে।

যেহেতু বিবিসি লন্ডনের তাই তার দেশ ব্রিটেন তাই এতকিছুর পরও কেন সুচিকে এখনো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, নৈতিকতার বিচারে এটা যে সঠিক, তা তো প্রমাণ করাই লাগবে। প্রতিবেদনের শেষে নির্লজ্জভাবে ব্রিটেনের মিয়ানমারকে সমর্থনের একটা কারণ দর্শানো হয়েছে। সেটা হল "সুচির কিছু ভুল থাকলেও সামরিক শাসন থেকে বের হয়ে গণতন্ত্রের পথে হাটার জন্য সুচিই এখন পর্যন্ত বেষ্ট অপশন। তাই ব্রিটেন এখনো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।"

কতটা বায়াসড হলে কথাটা এইভাবে বলা যায়! নূন্যতম লজ্জাবোধ থাকলে এখনো এইভাবে সুচির সাফাই গাওয়ার কথানা বিবিসির। এত এত বাশ খাওয়ার পরও যদি একটু লজ্জা হত। এরপরও নাকি এইসব আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ইমেজ সংকটে পড়েনা!

Tuesday, August 29, 2017

রাজনীতির ময়দানে শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. (৩)


 পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্দোলনে আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ এর ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগের জন্য এক অগ্নি পরিক্ষা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনালগ্ন 


 পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম লীগের পক্ষে ওলামায়ে কেরামের রেফারেন্ডামঃ

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সফল করে তোলার লক্ষে ১৯৪৫ সালে আক্টোবর মাসে সর্বসাধারণের মাঝে জনমত তৈরী করতে তখনকার শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে গঠিত হয় জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম। এই সংগঠনের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন আল্লামা যফর আহমদ উসমানী, মুফতি মুহাম্মদ শফি, মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা তাহের কাসেমী সহ তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় সমস্ত ওলামায়ে কেরাম।

মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এই সংগঠনের অন্যতম নেতা ও সংগঠক। তিনি তাঁর উস্তাদ শাব্বির আহমদ উসমানীর নির্দেশে সমস্ত দেশ সফর করেন এবং মুসলিম লিগের পক্ষে জোরদার ভূমিকা রাখেন। তখন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ সিলেট রেফারেন্ডমে প্রচারণা চালিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য যফর আহমদ উসমানীর কাছে অনুরোধ জানান। তখন তিনি এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই দায়িত্ব পালনে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। 

এরপরই মুজাহিদে আযম শামসুল হক ফরিদপুরি মাওলানা আতহার আলী খান, মাওলানা দ্বীন মুহাম্মদ খান গোটা সিলেটে এক ঝটিকা সফরে নেমে পড়েন। তারা মানুষকে একথা বুঝাতে সক্ষম হন যে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান জারি করা কোনভাবেই প্রতিবন্ধক না। বরং ইসলাম সংখ্যালঘুদের যেই অধিকার দেয় সেই অধিকার অন্য কেউ দিতে পারেনা। নিকট অতীতে ভারত উপমহাদেশে  মুসলমান সুলতানদের শাসন আমলই এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

উলামায় কেরামের এই শক্তিশালী ভূমিকায় রেফারেন্ডামে মুসলিম লীগের অভূতপূর্ব বিজয় সাধিত হয় এবং কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়। তাদের কঠোর পরিশ্রমের ফলেই পাকিস্তান রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে।


 ওলামায়ে কেরামের হাত ধরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাঃ

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট আল্লামা যফর আহমদ উসমানী পূর্ব পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেন। এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিচারপতির কাছে এসেম্বলি হলে শপথবাক্য পাঠ করেন। এই শপথ অনুষ্ঠানে উচ্চ পর্যায়ের সরকারী অফিসার ছাড়াও মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা আতহার আলি খান, মাওলানা দ্বীন মুহাম্মদ খান উপস্থিত ছিলেন। 

আল্লামা যফর আহমদ উসমানী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথমদিনই লালবাগ শাহী মসজীদে জুমার খুতবার পূর্বে পাকিস্তান ভাগ হওয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে এক ঐতিহাসিক ভাষন প্রদান করেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নিযামুদ্দিন আল্লামা উসমানীর ভাষনে অভিভূত হয়ে পড়েন।
সেদিন আল্লামা উসমানী তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “এখন পাকিস্তানের শাসকবর্গের অপরিহার্য দায়িত্ব হবে সর্বপ্রথম ইসলামী আইন সম্বলিত সংবিধান রচনা করা। সাধারণ মুসলমানদের নামাজ ও ইসলামের যাবতীয় আহকাম পালন করতে উদ্ধুদ্ধ করা। শরাব, পতিতা, সুদ এবং ঘুষের মহামারি থেকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে পবিত্র করা। সম্প্রীতি ও সংহতির মাধ্যমে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সেনাবাহিনী পুলশসহ সামরিক বাহিনীকে নামাজের পাবন্দ হিসেবে গড়ে তোলা। জাতির সেবা ও ইসলামের সুরক্ষায় তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। কেননা যে সরকারের কাছে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী না থাকে তাদের সহজেই কাবু করা সম্ভব”।

মুজাহিদে আযম আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় শাব্বির আহমদ উসমানী ও সিলেট রেফারেন্ডমের সময় আল্লামা যফর আহমদ উসমানী রহ. এর দক্ষিনহস্ত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।


 ওলামায়ে কেরামকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন নিয়ে শাসকশ্রেণীর টালবাহানাঃ

শামসুল হক ফরিদপুরী সহ দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম বেশ কয়েকবার কায়েদে আযমের সাথে একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হন। পাকিস্তান ঘোষনার পর ওলামায়ে কেরাম এক বৈঠকে কয়েদে আযমকে বলেছিলেন,
-পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে আপনি অঙ্গিকার করেছিলেন আপনার সংবিধান রচিত হবে কুরআন সুন্নাহর বিধান অনুযায়ী। আপনার এই অঙ্গিকার অতিসত্বর বাস্তবায়ন করুন।
কায়েদে আযম উত্তর দিয়েছিলেন, 
-অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু অসুবিধার কারণেই কুরআন সুন্নাহর সংবিধান রচনায় বিলম্ব হচ্ছে। এখন যতদ্রুত সম্ভব তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হবে।


 জিন্নাহর ইন্তেকালের পর সরাসরি ইসলামী আইন বাস্তবায়নে অস্বীকার এবং ওলামাদের ভূমিকাঃ

এই বৈঠকের কিছুদিন পরই কায়েদে আযমের ইন্তেকাল হয়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর পর শাসকরা বলতে শুরু করে এ যুগে ইসলামী আইন অচল। তাদের এই ধরণের কথায় ওলামারা তাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য দেশব্যাপী ঝটিকা সফর শুরু করেন।
১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে শাব্বির আহমদ উসমানী পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন এবং কুরআন সুন্নাহের বিধান মতে সংবিধান প্রণয়নের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। এ সময় ঢাকা মোমেনশাহী চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় লাখ লাখ জনতার বিশাল বিশাল সমাবেশ শাব্বির আহমদ উসমানী আল্লামা যফর আহমদ উসমানী, শামসুল হক ফরিদপুর্‌ মাওলানা আতহার আলী, মুফতি দ্বীন মুহাম্মদ খান ইসলামী আইন ও সংবিধানের পক্ষে জালাময়ী বক্তব্য রাখেন। একটাই দাবী নিয়ে তারা মাঠে নেমেছিলেন, "পাকিস্তানের সংবিধান হবে কুরআন সুন্নাহর বিধান মোতাবেক। ইসলামবিরোধী কোন আইন এদেশের জনগণ গ্রহণ করবেনা।"




 আন্দোলনে ওলামায়ে কেরামের সফলতা ও শাসনতন্ত্রের মূলনীতি হিসেবে কুরআন সুন্নাহের আইন স্বীকৃতি প্রদানঃ

১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী যখন পূর্ব পাকিস্তানের জনমত গঠন শেষে করাচী গিয়ে পৌঁছেন তখন কায়েদে মিল্লাত লিয়াকাত আলি খান  এসেম্বলিতে শাসনতন্ত্রের মূলনীতি হিসেবে কুরআন সুন্নাহয়ের আইনকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেন। আল্লামা শাব্বির আহমদ উসমানী এই প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের ওলামায়ে কেরামের সীমাহীন ত্যাগ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্মরণ করে পত্রের মাধ্যমে তাদের অশেষ শুকরিয়া আদায় করেন।
এর কয়েকমাস পর ১৩ই ডিসেম্বর শাব্বির আহমদ উসমানী ইন্তেকাল করেন।



 দুইবছর পর ওলামায়ে কেরামের ইখতেলাফকে বাহানা বানিয়ে আবারো গড়িমসি শুরু ও ওলামায়ে কেরামের কর্মসূচি গ্রহণঃ অতঃপর সফলতা অতঃপর চক্রান্ত

১৯৫১ সালে এই আন্দোলন আবার দুর্বার হয়ে ওঠে। শাসকগোষ্ঠী ওলামায় কেরামকে দোষারোপ করে বলতে শুরু করে ইসলাম শাসনতন্ত্রের মূলনীতি সব ওলামায় কেরামের ঐক্যমতের ভিত্তিতে আমাদের কাছে পেশ না করা হলে আমরা কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক সংবিধান রচনা করতে পারবোনা। ঠিক এই সময় ওলামাদের বৈঠক ডাকা হয় করাচীতে। হযরত মাওলানা এহতেশামুল হকের বাসভবনে অনুষ্ঠিত দুই পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরামের উপস্থিতিতে ইসলামী রাষ্ট্রের ২২ দফা মূলনীতি প্রণয়ন করা হয়। সেখানে আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ইতিহাসের পাতায় তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই ২২ দফা মূলনীতি পেশ করার পর শাসকগোষ্ঠী নানা অজুহাত দেখিয়ে আবারো সময় ক্ষেপন করতে থাকে। এক পর্যায়ে ওলামায়ে কেরামের চাপের মুখে পড়ে ১৯৫৬ সালে পার্লামেন্টরী সভায় ইসলামী শাসনতন্ত্রের ২২ দফা মূলনীতিএ এই খসড়াটি বিপুল ভোটে পাশ হয়। কিন্তু কতিপয় নেতার চক্রান্তে তা আর বাস্তবায়িত হুতে পারেনি।

 পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মাদরাসা শিক্ষার উপর আঘাত অতঃপর ওলামায়ে কেরামের আন্দোলন ও সফলতাঃ

এরপর আতাউর রহমান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। এই কমিশনে মাদরাসা শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় আখ্যা দিয়ে এই শিক্ষাকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব দিলে সিংহের ন্যায় গর্জে উঠেন শামসুল হক ফরিদপুরী। এবং দেশব্যাপী এর বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুললে সরকার এই কমিশনকে বাতিল করতে বাধ্য হয়।


 জালিম আইয়্যুব খানের বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণঃ

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক আইয়্যুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ ছিলনা। এই সুযোগে সে ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। সদর সাহেব একলাই কড়া প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন।
১৯৬৩ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন নামে ইসলাম বিরোধী আইন জারি করলে তাঁর বিরুদ্ধে সদর সাহেব তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেন। এ আন্দোলনের ফলে আইয়ুব খান সাময়ীকভাবে এই আইন মুলতবী করতে বাধ্য হয়।

উম্মতের দ্বীন ও ঈমান রক্ষায় শামসুল হক ফরিদপুরী রহঃ
খৃষ্টান মিশনারীদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সদা সতর্ক এদের অপতৎপরতা বন্ধের লক্ষ্যে তিনি সারাদেশ সফর করতেন। মিশনারীদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি “আঞ্জুমান তাবলিগুল কুরআন” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এবং “পাদ্রীদের গোমর ফাক” নামক বইসহ আরো বিভিন্নভাবে এর প্রচারণা চালিয়ে মুসলমানদের সতর্ক করতে থাকেন।

চাদ দেখা নিয়ে যদি সরকারী কমিটি কোন উলটপালট করতো তখন সাথে সাথে তিনি এর প্রতিবাদ করতেন এবং জনগণও উনার সিদ্ধান্তের অপেক্ষাতেই থাকতো।   এছাড়াও আইয়ুব খানের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের তিনি কঠোর সমালোচনা করতেন। এই জন্যেই তাকে মুজাহিদে আযম বলা হত।

সমাজ সেবা ও সামাজিক সংস্কারমূলক কাজের জন্য তিনি “খাদেমুল ইসলাম জামায়াত” নামে একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে।

বেহেশতি জেওরের বাংলা তরজমা বাংলার মুসলমানদের জন্য তাঁর অসামান্য খেদমত। থানভী রহ এর আরো কিছু গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেছেন। তাঁর নিজস্ব ও অনূদিত বইয়ের সংখ্যা দুইশতর কাছাকাছি।  হক্কানী তাফসির পনেরো পারা তিনি লিখে গেছেন।
তিনি ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ইন্তেকাল করেছেন।

আমার সাথে হুজুরের একটি স্মৃতিঃ
দীর্ঘ আটবছরের খেদমতে হুজুরের সাথে আমার অনেক স্মৃতি জমা হয়েছে। হুজুর আমাকে কতটা আপন করে নিতেন এটা একটা ঘটনায় আমি বেশ ভালঅভাবে বুঝতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমার দাদা যেদিন মারা যায় পর সদর সাহেবের সাথে সেদিন আমার গওহরডাঙ্গা যাওয়ার কথা ছিল। সেসময় হুজুর কখনোই আমাকে ছাড়া সফর করতেন না। এমনকি ঈদের ছুটিতেই আমি বাড়ি না গিয়ে হুজুরের কাছে থাকতাম। হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি গিয়ে জানাযায় শরিক হতে পারবে আমি জানতাম যে সম্ভব না। হুজুরকে বললাম তাই। হুজুর আমাকে বললেন তাহলে এখানে দুয়া করতে পারো যা তোমার দাদার কাজে আসবে। এরপরও তুমি ভেবে দেখ। তুমি চাইলে আমার সাথেও যেতে পারো চাইলে বাড়িতেও রওনা করতে পারো। আমি হুজুরের সাথেই যাওয়ার ইচ্ছা করলাম।
লালবাগে পড়ালেখা শেষ হলে তিনি আমাকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেন যার ফলে আমার ইন্তেকালের সময় তাঁর পাশে থাকতে পারিনি।
ইউসুফ বিন্নুরী যে সদর সাহেব হুজুরকে কতটা উচু স্তরের মানুষ মনে করতেন এটা উনার কথা থেকে কিছুটা বুঝা যায়। সদর সাহেব হুজুর সম্পর্কে ইউসুফ বিন্নুরী বলেন,

পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় ও শ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়ার লালবাগ ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা শামসুল হক ফরিদপুরি ছিলেন একজন বড় মুখলিস মানুষ। সত্য প্রকাশে কখনো কারো পরোয়া করতেন না। থানা ভবন থেকে ইলমে মারিফতের উচু মাকাম অর্জন করেছেন। অধিকাংশ সময় অসুস্থতার মাঝেও ইসলামের খেদমতে সার্বক্ষণিক নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। 

সূত্রঃ আলোর কাফেলা।
 শামসুল হক ফরিদপুরী রহঃ কে নিয়ে তাঁর একনিষ্ঠ শাগরিদ ও খাদেম মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহঃ এর প্রবন্ধ থেকে।

Monday, August 28, 2017

আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাতের মানদণ্ড (৫) প্রসঙ্গ আহলে হাদিস

আহলে হাদিস বা গাইরে মুকাল্লিদ
মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ
১৮১৮ সালে সর্বপ্রথম আহলে হাদিস নামে একটি দল নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করে। এই দলটির নাম আগে ছিল মুয়াহহিদীন। এরপর তারা মুহাম্মদী নামে পরিচিতি লাভ করে। তাদের অনেকে ওয়াহাবী বলে আখ্যা দেয়ায় তারা ইংরেজ সরকার থেকে নিজেদেরকে আহলে হাদিস নামে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেয়।
শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এদের প্রধান সমস্যা হল, তারা শরিয়তের চার দলিলের মধ্যে ইজমা এবং কিয়াসকে অস্বীকার করে। শুধুমাত্র কুরআন ও হাদিসকে দলিল হিসেবে মানার দাবী করে। কারণ ঈমামদের ইজমা ও কিয়াস মানার অর্থ হল তাদের তাকলীদ করা। আর তাকলীদ করা তাদের দৃষ্টিতে শিরক। মূলত যারা ইজমা কিয়াস মানে না তারা যাহেরীয়া নামে পরিচিত। দাউদে যাহেরী, ইবনে হিশাম, শাওকানী, ইবনে তাইমিয়া এ শ্রেণির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মজার ব্যাপার হল, বর্তমানে আমাদের দেশের আহলে হাদিসরা তাকলীদের বিরুদ্ধে বললেও তারা কার্যত উপরোক্ত আলেমদেরই তাকলীদ করে থাকেন। কুরআন হাদিস থেকে সরাসরি আমল করতে সক্ষম নয় এমন মানুষের ক্ষেত্রে তাকলীদ ওয়াজিব। কুরআনে এসেছে, “ফাসআলু আহলায যিকরি ইন কুন্তুম লা তালামুন, তোমরা না জেনে থাকলে যারা জানে তাদের থেকে জেনে নাও”
সাহাবীদের যুগেও তাকলীদ পাওয়া যায়। যেসব সাহাবিরা ইজতেহাদ করতে সক্ষম  ছিলেন না তারা ফকিহ সাহাবিদের থেকে জেনে নিতেন। মুয়ায রা. কিয়াস ও ইজতেহাদ করে ইয়ামানবাসীর সমস্যা সমাধান করবেন শুনে রাসুলুল্লাহ সা. খুব খুশি হয়েছিলেন। বনু কুরাইযা যাওয়ার পথে ভিন্ন ভিন্ন ইজতেহাদের উভয়টিকে হুজুর সঠিক বলেছেন।
ইবনে আব্বাসের তাকলিদ করতেন মক্কার অধিকাংশ সাহাবী। মদিনার অধিকাংশ সাহাবী যায়েদ ইবনে সাবেত রা. এর তাকলীদ করতেন বলে বুখারী শরীফে এসেছে। কুফাবাসী ইবনে মাসউদ এবং ইয়ামানবাসী মুয়ায রা এর এবং সিরিয়াবাসী আমরুনিল বুকাঈ এর তাকলীদের প্রমাণও হাদিসে আছে। রাসুলের যুগের আরো এমন অনেক ঘটনা তাকলীদের প্রমাণ বহন করে।
তাছাড়া হযরত উমরের জারী করা বিশ রাকাত তারাবীহকে যদি বিদআত বলা হয় তাহলে সাহাবা ও রাসূল উভয়কে বিদাতী বলতে হবে। কেননা রাসুলই তো তাদেরকে মানতে বলে গেছেন।

আহলে হাদিসগণ আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণঃ

১) তাকলীদ প্রসঙ্গঃ তারা চার মাযহাবের তাকলীদকে বিদআত বলে। অথচ আহলে সুন্নাতের নীতি হল, যে ব্যক্তি ইজতিহাদ করার যোগ্যতা রাখে তাঁর জন্য ইজতেহাদ জরুরী। তাকলীদ অবৈধ। আর যার মধ্যে ইজতেহাদের যোগ্যতা নেই তাঁর জন্য কোন এক মুজতাহিদের মাযহাবের তাকলিদ করা ওয়াজিব।

২) আল্লাহর গুণাবলি প্রসঙ্গঃ যে শব্দগুলোতে আল্লাহ তায়ালার আকৃতি বা দেহ প্রমাণিত হয় সেগুলোকে আহলে সুন্নতগণ বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করেন না। কারণ এখানে বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে কুরআনের আরেকটি আয়াতের বিপরীত হয়ে যায়। লাইসা কামিছলিহি শাই, ও্যাহুয়াস সামিউল বাসির।
কিন্তু আহলে হাদিসি গণ এই নীতি মানেন না। তারা আবুল হাসান আশয়ারী ও আবু মানসুর মাতুরিদিদেরকে ভ্রান্ত বলেন।

৩) দোয়ার মধ্যে উসিলা প্রসঙ্গঃ জীবিত ও মৃতব্যক্তি নিজের আমল ও অন্যের আমল দ্বারা উসিলা গ্রহণ সর্বাবস্থায় জায়েজ। কারণ এসবের মূলকথা হল আল্লাহ তায়ালার উসিলা ধারণ। অথচ লা মাযহাবীরা এখানে গোড়ামী করে থাকে। তারা এই উসিলাকে অবৈধ বলে থাকে।

৪) ঝাড়ফুক তাবিজঃ আহলে সুন্নতের নিকট বৈধ। অথচ তারা এটাকে কুফুরী বলে।

৫) রাসুলের রওজা যিয়ারতের নিয়তে মদিনা যাওয়াঃ আমাদের দেশের আহলে হাদিসগণ ইবনে তাইমিয়া ও কাজী ইয়াজের ব্যক্তিগত মতামত, তাফাররুদাতের উপর ভিত্তি করে সাহাবা তাবেঈনদের আমলের বিপরীতে গিয়ে নতুন তর্কের সুত্রপাত ঘটাচ্ছে। তাদের বক্তব্য হল, মদিনাতে যাবে একমাত্র মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে। রওযা যিয়ারতের নিয়তে যাওয়া অবৈধ। তাদের দলিল হল, লা তাশুদ্দুর রিহালা ইল্লা ইলা সালাসাতি মাসাজিদ। মসজীদে নববী, মসজিদে হারাম ও মসজীদে আকসা ছাড়া অন্য কোন কিছুর উদ্দেশ্যে সফর করা যাবেনা।
হাদিসের যেই ব্যাখ্যা আহলে হাদিসরা গ্রহণ করেছে তা নিতান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা। অথচ সকল মুহাদ্দিসগণ এইভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে তিন মসজিদ ছাড়া অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা যাবেনা। এ হাদিসে অন্য কোন স্থানের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এবং আল্লামা আসকালানী ও আইনিসহ সকলেই এই ব্যাখ্যাকে সঠিক বলেছেন।

৬) জুময়ার খুতবা অন্য ভাষায় পড়া যাবে কিনাঃ আহলা হাদিসরা বলে পড়া যাবে। অথচ সাহাবীদের যুগে সাহাবীদের মধ্যে যারা ভিন্নভাষী ছিলেন তারাও মাতৃভাষায় খুতবা পড়েননি। এই মাসলা প্রমাণের জন্য লা মাযহাবীরা ঠিকই আবার যুক্তি কিয়াসের অনুসরণ করে থাকে।


৭) তাসাউফ ও আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে বাড়াবাড়িঃ শরীয়ত ও তরিকত উভয়টিই ইসলামের অঙ্গ। শরীয়তবিহীন তরিকতের যেমন মূল্য নেই তেমনি তরিকতবিহীন শরীয়তেরও মূল্য নেই। মানুষের বিবেক পাহাড়া দিচ্ছে শরিয়তকে তেমনি মানুষের অন্তর পাহাড়া দিচ্ছে তরীকতকে। সাহাবায়ে কেরাম এই আদর্শের উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। “কাদ আফলাহা মান যাক্কাহা, যে তাঁর অন্তরকে পবিত্র করলো সে সফল হল” তাযকিয়ায় নফস অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এবং হাদিসে জিব্রাইলে একেই ইহসান বলা হয়েছে। তাই তাসাউফকে অস্বীকার করার উপায় নেই, যা লা মাযহাবিরা বা গাইরে মুকাল্লেদরা করে থাকেন। 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মানদণ্ড (৪) প্রসঙ্গ ভন্ডপীর

ভন্ডপীরের আকিদার গোড়ার কথা
মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ

১) “পরকালে মুক্তির জন্য ইসলাম জরূরী নয়” উক্তিটি দেওয়ানবাগীর। তিনি আরো বলেন, “সকল ধর্মের লোকেরাই নাজাত পাবে। যদি সে নিজ অবস্থায় থেকে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে তাহলে সে একজন নামধারী মুসলমান থেকেও উত্তম”।
তিনি তাঁর বই “মানতের নির্দেশিকা”তে লিখেছেন, “ভিন্ন ধর্মের অনুসারী আমার এক মুরিদকে তাঁর ধর্ম থেকে অযিফা, আমল দিয়েছি তা পালন করে সে নবিজীর সাথে মুসাফাহা করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর হৃদয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে সংবাদ আসে এবং ভাল মন্দ বাতলায়ে তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করে”।

দেওয়ানবাগীর এই আকিদাটি সম্পূর্ণ কুফুরী। সূরা বাকারার ৬২ নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে খৃষ্টানদের আকিদামত সে এই ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের মতবাদ প্রমাণ করেছে সে। এ কারণেই তাদের দরবারে অমুসলিমদের আগমন দেখা যায়। অথচ সুরা আলে ইমরানের স্পষ্ট আয়াত “ইন্নাদ দিনা ইনদাল্লাহিল ইসলাম, আল্লাহর কাছে ধর্ম শুধু ইসলাম”।

২) ভন্ডপীরদের দ্বিতীয় মৌলিক সমস্যা হচ্ছে, তারা জরুরিয়তে দ্বীনকে অস্বীকার করে। এমন অনেক বিষয়কে অস্বীকার করে যা কুরআন হাদিসের অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। তাদের কতিপয় দাবীঃ
-বেহেশতের হুর বলতে মানুষের আত্মাকে বুঝায়।
-আত্মায় চিরস্থায়ী যন্ত্রণাদায়ক অবস্থাকে জাহান্নাম বুঝায়।
-সূফি সাধকদের দৃষ্টিতে মানুষের হাশর পৃথিবীর বুকে সংগঠিত হয়।
-পুলসিরাত পাড়ি বলতে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ইমানের উপর থাকাকে বুঝায়।
-আল্লাহ ও জিব্রাইল এক ও অভিন্ন। নাউজুবিল্লাহ

৩) অনেক কিছু নিয়েই তাদের বেশ বাড়াবাড়ি আছে। যেমন এক বছর ওরস কাযা করলে এই এক বছর বহু দুর্ভোগ পোহাতে হবে। অথচ ওরস সহীহ হাদিস দ্বারা নাজায়েজ বলে প্রমাণিত।

৪) বুজুর্গ হলে ইবাদাত লাগেনা। চন্দ্রপাড়ার পীর তাঁর বই হাক্কুল ইয়াকীনে এমনই লিখেছেন। এমনকি মাকামে ছুদুর, নাশর, নূরী ও কুরবে মাকিনের মাকার অতিক্রম করার পর ইবাদত করলে নাকি কুফুরী হবার সম্ভাবনাও থাকে। এরপক্ষে আবার তারা আয়াতও পেশ করে।
“ওয়াবুদ রব্বাকা হাত্তা ইয়াতিয়াকাল ইয়াকিন, ইয়াকিন আসা পর্যন্ত ইবাদাত করো”। এখানে তারা ইয়াকীন শব্দের ব্যাখ্যা করে মারেফত দিয়ে। অথচ সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনগণ এই ব্যাপারে একমত যে ইয়াকীন বলতে এখানে মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে।

৫) রাসুল ও আল্লাহর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। দেওয়ানবাগী, মাইজভান্ডারী ও চন্দ্রপুরীর এই আকিদা। এই আকিদা মূলত ওয়াহদাতুল উজুদ অর্থাৎ সর্বেশ্বরবাদের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে আবিষ্কৃত। সম্পূর্ণ শিরক। এ দর্শনেই খৃষ্টানরা বিশ্বাসী। তারা ঈসা আ.কে আল্লাহ তায়ালায় পুত্র মানে।

ভন্ডপীরদের এইসব আকীদা পোষন করলে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত তো দূরের কথা মুসলমান থাকারই সুযোগ নেই।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মানদণ্ড (৩) প্রসঙ্গ বিদাত

বিদাতী কারা
মুফতি মিযানু্র রহমান সাঈদ
শাব্দিক অর্থে যে কোন নতুন কাজই বিদয়াত। শরিয়তের পরিভাষায় ইসলামী শরিয়তের দলিল দ্বারা প্রমাণিত নয় এমন যেকোন আকিদা বা আমলকে বিদআত বলে। (ফাতওয়ায়ে শামীঃ১/৩৭৭)

মিসবাহুল লুগাতে পারিভাষিক অর্থ লেখা হয়েছে যেই আকিদা বা আমলের প্রমাণ অনুসরণীয় তিন যুগ অর্থাৎ সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেঈনদের কোন যুগে পাওয়া যায়না।

ধর্মের নামে কেউ যদি কুসংস্কার বা নব্য সংস্কারের নামে কিছু করে যার প্রমাণ শরিয়তে পাওয়া যায় না তাই বিদআত। কারণ ইসলাম ধর্ম যে পরিপূর্ণ সে ব্যাপারে আল্লাহ স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে বলেছেনঃ “আলইয়াউমা আকমালতু লাকুম দিনাকুম, আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি”।

বিদআত বলা হবে কোন কাজকে?

১) শরীয়তে যে কাজের বৈধতার কোন প্রমাণ বা অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায় না সে কাজ কে ধর্মীয় কাজ বা দ্বীনের অংশ মনে করা।  যেমনঃ জানাজার পর প্রচলিত মুনাজাত, প্রচলিত মিলাদ, মিলাদে কিয়াম করা, জশনে জুলুশ করা, মাইয়েত নামানোর সময় আযান দেওয়া, আযানের পূর্বে সালাত ও সালাম পড়া।

২) শরঈ দলিলের মাধ্যমে কোন কাজ প্রমাণিত থাকার পরও নিজ সুবিধা বা ইচ্ছেমত সে কাজের পরিধি বা পরিমাণ কমানো এবং বাড়ানো। জরুরী মনে করা বা বাড়াবাড়ি করা যতটা বাড়াবাড়ি শরিয়ত করতে বলেনি। যেমন ঈদের সংখ্যা দুইটি, আরো বাড়িয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী করা।
৩) শরঈ দলিল দ্বারা প্রমাণিত তবে স্থান কাল পাত্র বা অনুষ্ঠানের সাথে নির্দিষ্ট না। যেমন মিলাদের আলোচনার জন্য ১২ই রউল আউয়ালকে নির্ধারিত করা।

এসব কাজ বিদাতের অন্তর্ভুক্ত। এসবকে ইহদাস ফিদ্দিন বলা হয়। অর্থাৎ ধর্মে নতুন করে কিছু যোগ করা।

তবে অনেক বিষয় আছে যেগুলো রাসুলের যুগে ছিল না কিন্তু এখন মানুষ করছে। সেগুলোকে ইহদাস ফিদ্দিন বলা হবে না। এগুলো ইহদাস লিদ্দিন। পার্থক্যটা বুঝা জরুরী।
ইহদাস লিদ্দিন হল দ্বীনের জন্য কিছু বৃদ্ধি করা। এটা দ্বীনের স্বার্থে হয়ে থাকে। তাই এতে ইহদাস ফিদ্দিনের বিদয়াতী কাজ বা সেই ধরনের কিছু পাওয়া যায় না। যেমন সাধারণত তিন ধরণের ইহদাস লিদ্দিনের উদাহরণ আমরা দেখতে পাই,  
১) যেসব নব উদ্ভাবিত কাজ মূলত ধমের অংশ নয়, ধর্মীয় বিষয়ও না। যেমন আধুনিক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার। এগুলোর সাথে ধর্মের কোন সম্পৃক্ততা বা সংঘর্ষ নেই।
২) ধর্মের জন্য যেসব নতুন কাজ করা হয়।  যেমন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা শিক্ষা কারিকুলাম, দাওয়াত ও তাবলিগ। এই কাজ শুধুমাত্র দ্বীনের সংরক্ষণের জন্যই করা হয়েছে।
৩) যেসব বিষয় ধর্মের অংশ হিসেবে নয় বরং ধর্ম সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য। যেমন উসুলে ফিকহ, উসুলে হাদিস, উসুলে তাফসির, ইলমে আকায়েদ, ইলমে ফিকহ।


আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সাথে আহলে বিদাতের আকিদাগত পার্থক্যঃ

১) একমাত্র আল্লাহই হাজির নাজিরঃ “তিনি তোমাদের সাথেই আছেন, তোমরা যেখানেই থাকো না কেন তিনি তোমাদের কার্যকলাপ দেখেন। (হাদিদঃ৪)

কুরআনের আরো অনেক আয়াত দ্বারাই এই বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে হাজির নাজির হওয়া একমাত্র আল্লাহ পাকের বিশেষ গুণ। যে কাউকে এই গুনে গুণান্বিত করা শিরক। কিন্তু একদল ভন্ডপীর রাসুলের প্রতি অতি ভক্তি দেখাতে গিয়ে রাসুলকে হাজির নাজির বলে ফেলে। যা সম্পূর্ণ সাহাবা তাবেঈ ও তাবে তাবেয়ীদের ব্যাখ্যার পরিপন্থী।

২) একমাত্র আল্লাহই আলেমুল গাইবঃ “হে নবী, আপনি বলে দিন আসমান জমিনে কেউই গায়েব জানেনা, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া” (আনয়াম ৬৫)

বিদাতীরা এই সিফাতকেও রাসুলের জন্য সাবেত করতে চায়।

৩) রাসুল নূরের তৈরী নন তিনি সমস্ত মানবজাতির মত মাটির তৈরী।


৪) আমলী বেদয়াতঃ যেমন ঈদে মিলাদুন্নবী, জশনে জুলুশ মিলাদ কিয়াম, যিকির মাহফিল, তাবারুক বিতরণ। জানাযা নামাজের পর মুনাজাত। ইকামাতে কাদকা মাতিসসালাহের সময় দাড়ানোকে জরূরী সুন্নত মনে করা। 

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মানদণ্ড (২)

কারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত
মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ

এই আলোচনার আগে কয়েকটি বিষয় বুঝে নেয়া জরুরী।
১) ইমাম ত্বহাভী বলেছেন, হাদিসের উক্ত মতবিরোধটি সম্পূর্ণ আকিদাগত ব্যাপার। কেননা আমলী দিক দিয়ে ভাগ করতে গেলে সংখ্যা তিহাত্তরের বেশী হয়ে যায়।
আল্লামা খলিল আহমদ সাহারানপুরীও এই কথা বলেছেনঃ মতবিরোধ বলতে হাদিসে আকিদাগত মতবিরোধ বুঝানো হয়েছে। কেননা তারাই একে অপরকে তাকফীর করেমাযহাবী ওলামায়ে কেরাম অন্য মাযহাবকে তাকফীর করেনা। বরং তারা বলে সকলেই সঠিক। (আল কাউকাবুদ দুররী পৃ ১২৮)
২) এই ভ্রান্ত মতবাদগুলোর আকিদা যতক্ষণ পর্যন্ত কুফুরী পর্যন্ত না পৌঁছাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এদেরকে ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী মুসলমান বলা হবে।
৩) পূর্বে বাহাত্তর দলের যে পরিচিতি দেয়া হয়েছে তা বিভিন্ন যুগে আবির্ভূত হলেও বর্তমানে এদের অনেক ফেরকার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে তাদের আকিদার অনুসারী হয়ে অনেকে বর্তমানে বহু নতুন নতুন দল আকারে উদ্ভাবিত হয়েছে। যারা সরল মনের মুসলমানদের সুচতুরভাবে ধোকা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাতের ক্ষেত্রে সুন্নাত শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছেঃ
সুন্নাত সাধারণত তিনটি অর্থে ব্যবহার করা হয়।
১) রাসুলের হাদিস।
২) রাসুলের সেই আমল যার গুরুত্ব ফিকহের পরিভাষায় ওয়াজীবের নিচে ও মুস্তাহাবের উপরে। 
৩) নবীর তরিকা, শিক্ষা ও আদর্শ।
আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাতের ক্ষেত্রে তৃতীয় অর্থটিই ব্যবহৃত হয়েছে।
এবং এই তৃতীয় অর্থটিই সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেঈনগণ আকীদা ও আমলই আহলে সুন্নাতের আদর্শের মাপকাঠি হিসেবে প্রমাণিত। এসবই সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। অতএব কেউ যদি সেগুলোকে না মানে তাহলে সে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা থেকে খারেজ হয়ে যাবে।

আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাত প্রসঙ্গে ইবনে তাইমিয়া বলেন, আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, রাফেজীরা নস সুন্নাত ও ইজমা দ্বারা নিজেদের উসুলকে প্রমাণ করার দাবী করে, অথব তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি নস ইজমা এবং তাঁর দ্বারা দলিল পেশ করা থেকে বহু দূরে অবস্থান করে। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত হচ্ছে নস সুন্নাত ও ইজমায়ের পরিপূর্ণ অনুসারী। সুন্নাহ নসকে অন্তর্ভুক্ত করে আর জামাআহ ইজমাকে অন্তর্ভুক্ত করে। 

উপমহাদেশে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ইমামগণঃ
১ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহুলভী রহ.
২ শাহ আব্দুল আযিয রহ.
৩ শাহ সায়্যিয়েদ আহমদ শহিদ রহ.
৪ শাহ ইসমাইল শহিদ রহ.
৫ শাহ ইসহাক রহ.
৬ কাসেম নানতুবী রহ.
৭ রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ.
৮ আব্দুল হাই লাখনোভী রহ.
৯ সায়্যিয়েদ আহমদ সিরহিন্দি রহ. (মুজাদ্দেদে আলফে সানী)
১০ শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ.
১১ আশরাফ আলী থানভী রহ.
১২ আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ.
১৩ হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.
১৪ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.
১৫ শায়খুল হাদিস হযরত যাকারিয়া রহ.
১৬ মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ.
১৭ মুফতি ফয়জুল্লাহ রহ.
১৮ ইমামে তরিকত মুফতি আযিযুল হক রহ.
১৯ মুজাহিদে আযম শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.
২০ ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম রহ.
২১ মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ.
২২ ইমামে তরিকত কারী ইব্রাহিম সাহেব উজানী রহ.

২৩ পীরে তরিকত শাহ মুহাম্মদ ইসহাক চরমোনাই রহ.

Saturday, August 12, 2017

জীহাদ নিয়ে আল্লামা তাক্বী উসমানীর "সংশয়ে"র জবাব দিলেন কথিত জীহাদী মুফতি


নেট ব্রাউজ করতে করতে এক মুফতি সাহেবের প্রলাপ সামনে এসে পড়লো। তিনি তক্বী উসমানী সাহেবের জীহাদের ব্যাখ্যার মধ্যে ভুল খুজে পেয়েছে। এবং দলিলের মাধ্যমে এর শক্ত জবাব দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য শুনে মনে হল কিছু নোট তুলে রাখা উচিৎ। কারণ এই কথিত মুফতি সাহেবদের অনুসারী শুনেছি দিনদিন বাড়ছে। কোনদিন যদি আমাদের আকাবিরদের সিলসিলায় শিখে আসা দ্বীনকে দ্বীন বলতেই অস্বীকার করে বসে তাহলে তো এদের মুকাবেলা করার মত দুঃখজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার প্রয়োজন পড়লেও পড়তে পারে।

লোকটার নাম মুফতি জামিল মাহমুদ। সে তাঁর বক্তব্যের শিরোনাম দিয়েছে, জিহাদ নিয়ে মুফতি তকি উসমানীর সংশয়। তাঁর কথাগুলো ছিল এরকম,

“তক্বী উসমানী সাহেব তাঁর কুরআন তাফসির গ্রন্থ তাওজিহুল কুরআনের বাংলা অনুবাদ যেটি মাক্তাবাতুল আশরাফ থেকে ছাপা হয়েছে, সেখানে এক আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “দ্বীনের পথের যেকোন মেহনত বা প্রচেষ্টাকেই জীহাদ বলা হবে। সশস্ত্র প্রচেষ্টাও এর অন্তর্ভুক্ত। তবে শান্তিপূর্ণ যেকোন মুজাহাদাও জীহাদ”।

‘ওয়াজাহিদু ফিল্লাহি হাক্কা জিহাদিহ’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তকি সাহেব এই কথা লিখেন।
এখন সেই পন্ডিত মুফতি সাহেবের কথা হল, মূলত এই ধরণের ব্যাখ্যার মাধ্যমেই তাক্বী উসমানী সাহেবরা বর্তমান যুগের বিভিন্ন শ্রেনীর আলেমদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। যার কারণে জীহাদের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়কে অনেকে ভুল বুঝছেন।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির আলেমগণ তাদের গণতান্ত্রিক কার্যক্রমকে, তাবলিগীরা তাদের মেহনতকে, পীর মুরিদরা তাদের পীর মুরিদিকে, দরস ও তাদরীস নিয়ে মেহনত করা উস্তাদগণ তাদের মেহনতকে জীহাদ মনে করছেন। তাঁর নিজেদের মনমত চেষ্টা প্রচেষ্টাকে জীহাদ বলে মূল জীহাদকে বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবেই জীহাদ সকল নিজ নিজ কর্মের মাঝে একাকার হয়ে গেছে।
জীহাদের প্রকৃত সংজ্ঞা কি?
হানাফি মাযহাবের ইমাম আল বাহরুর রায়েকের মুসান্নেফ বলেছেন, জীহাদ হল সত্য দ্বীনের দিকে আহ্বান করা, এবং তারা তা অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
ফাতহুল কাদিরের মুসান্নেফ ইবনুল হুমাম ও দুররুল মুসান্নেফের মুসান্নেফও এই সংজ্ঞা দেন। শরহে বেকায়ার মুসান্নেফও এই সংজ্ঞা দেন”।

এই ছিল সেই মুফতি সাহেবের বক্তব্য। এবং শেষ পর্যায়ে গিয়ে তিনি তকি উসমানী সাহেবের এই ব্যাখ্যাকে কাদিয়ানী মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত বলতেও ছাড়েননি। মুফতি সাহেবের বক্তব্য হল, উপমহাদেশে ওলামায়ে কেরামের ইংরেজবিরোধী আন্দোলনকে বানচাল করার লক্ষ্যে তখনকার মানুষকে কাদিয়ানীরা যেমন জীহাদের অপব্যাখ্যা বুঝানো শুরু করেছিল আজকেও অনেক ওলামায়ে কেরাম তাদের সেই কাদিয়ানী মতবাদের সুরে কুরআনের ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। এইভাবে ব্যাখ্যা দিলে জীহাদ যে শরিয়তের একটি স্বতন্ত্র বিধান সেটাই নাকি অস্বীকার করা হয়।

আসলে এই মুফতি সাহেবদের মত অতি উৎসাহী লোকদের এইসব কথাবার্তা শুনে যাচাইবাছাই না করেই অনেকে অনুসরণীয় ওলামাদের অতিরিক্ত উদারমনা ভাবতে শুরু করেন। এবং তখন এই অতি উৎসাহীদেরকেই একান্ত মুখলিস মনে হতে থাকে। কিন্তু এইসব অতি উৎসাহীদের আবেগের উপর শরিয়তের আহকামের ভিত্তি না এ কথাও মনে রাখতে হবে। এ ধরণের চিন্তা আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাওয়ার কারণ হচ্ছে অনেকক্ষেত্রেই আমাদের মধ্যে এসব বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকে না। যার ফলে তাদের এইসব অতিআবেগী বক্তব্যকে কখনো কখনো যৌক্তিক মনে হতে থাকে। এবং এতে উলামায় কেরামের উপর থেকে আস্থা উঠে যাওয়া সহ আরো মারাত্মক কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়।

 আপাতত অত্র মুফতি সাহেবের এই কথাগুলোর কিছু পয়েন্ট নিয়ে পর্যালোচনা করা যাক।

তকী উসমানী সাহেবের ভুল ধরতে গিয়ে প্রথমেই তিনি নিজে যেই ভুলটা করেছেন, উনি কুরআন তাফসীরের মূলনীতি বিবেচনায় রাখেননি। মূলনীতি হল, কুরআনের একটি আয়াত বিভিন্ন অর্থ এবং ব্যাখ্যার সুযোগ রাখে। এবং মুফাসসিরিনে কেরামের দায়িত্ব হল কুরআনের অত্র আয়াতের পূর্বাপরের সারমর্ম অনুধাবন করে অন্যান্য আয়াত হাদিস ও শরিয়তের প্রাসঙ্গিক সমস্ত বিষোয়ের আলোকে আয়াতের ব্যাখ্যা পেশ করা। এই মূলনীতি অনুযায়ী এখানে এক শব্দের একাধিক ব্যাখ্যা আসাটা মোটেও ভুল কোন সিদ্ধান্ত না। মুফতি সাহেব এ মূলনীতিটাকে এড়িয়ে গেছেন। এড়িয়ে না গেলে অবশ্য এমন "ভুল" ধরাও সম্ভব হতোনা।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে ভুল ধরতে গিয়ে তিনি শুধু মাত্র একটি ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। সেটা হচ্ছে জীহাদ। বাকিগুলোকে অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে সেসব গ্রহণ করলে নাকি এখানে জীহাদের অপব্যাখ্যা হয়। পরবর্তীতে তিনি এটাও বলেছেন যে, তকী উসমানী সাহেব অন্য ব্যাখ্যাগুলোকে উল্লেখ করার কারণেই জীহাদকে ছোট করে দেখা হয়েছে। এবং মানুষ এর থেকে শরীয়তের বিধান জীহাদকে ভুল বুঝছে। অথচ রেফারেন্স দেয়ার সময় এই লোকই স্বীকার করেছে যে তকী সাহেব ব্যাখ্যায় এটাও লিখেছেন যে, "সশস্ত্র প্রচেষ্টাও জীহাদের অন্তর্ভুক্ত"। তো এরপরও মুফতি সাহেব কিভাবে বলেন যে এখানে তিনি জীহাদকে অস্পষ্ট করছেন। বরং আরো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা উল্লেখ করে এখানে তাক্বী উসমানী সাহেব আরো স্পষ্ট ব্যাখ্যাই করেছেন।

মুফতি সাহেবের বিভিন্ন কথাবার্তা নিতান্তই তাঁর কম জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে । এবং তাঁর আরবি ও উর্দু শব্দের ভুলভাল উচ্চারণে বুঝা যাচ্ছিল তিনি আরবি পড়ুয়া না। রেফারেন্সও দিয়েছেন তাওযিহুল কুরআনের বাংলা অনুবাদ থেকে। মানে হচ্ছে, যেই লোক আরবি তো দূরের কথা তকী উসমানী সাহেবের কিতাব উর্দুতে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি সে এসেছে তকী সাহেবের ভুল ধরতে। ব্যাপারটা হাস্যকর বটে।


শেষ কথা বলি, দ্বীনকে বুঝতে হলে তাফাক্কুহ ফিন দ্বীন খুবই জরূরী। এবং এই তাফাক্কুহের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের অনুসরণের পাশাপাশি উলুল আমরের অনুসরণের কথা কিন্তু আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছেন। প্রত্যেকযুগে উলুল আমর ছিল, এখনও আছে, কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। এই ধারাবাহিকতার মধ্যেই আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে সংরক্ষন করবেন। শরিয়তে আউট অফ কন্টেক্সট কোন দাবীর সুযোগ নেই। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে নিকট অতীত পর্যন্ত ইসলাম টিকে থাকার ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সব কিছুই একটা ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে আসছে। যে ধারাবাহিকতায় একটা দল খোদায়ী বিধান অনুযায়ী সবসময় হকের উপর ছিল, আছে এবং থাকবে। এবং বাস্তবিক অর্থে শরিয়তকে বুঝতে হলে তাদের তাফাক্কুহকে গভীরভাবে পড়তে হবে। অর্থাৎ দ্বীনকে তারা কিভাবে বুঝেছেন এটা আমাদের লক্ষ্য করতে হবে এবং সাথে সাথে পূর্ণ আস্থার সাথে তাদের অনুসরনও জরূরী। অন্যথায় এই মুফতি সাহেবের মত আউট অফ কনটেক্সট দলিল বিভিন্ন জায়গা থেকে এনে যোগ করে নিজের আবেগী মতকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। এবং কোনসময় তা রূপ নিতে পারে উগ্রপন্থায়।


এর একটা উদাহরণ এই মুফতি সাহেবের চিন্তাটাকে সূক্ষভাবে ধরার চেষ্টা করলে বুঝা যাবে। তিনি জীহাদকে না বুঝে আয়াতের ব্যাখ্যাকে বাতিল প্রমাণ করার জন্য দলিল দিতে গিয়ে অনেক সংজ্ঞাও এনেছেন জীহাদের। আয়াতের ব্যাখ্যার আলোচনায় যাওয়া উদ্দেশ্য না, এখানে মুফতি সাহেবের আবেগ থেকে জন্ম নেয়া অন্ধত্ব নিয়ে বলতে চাচ্ছি। তিনি যদি জীহাদের এই সংজ্ঞাগুলো থেকেও  নিজে একটু বুঝতে চেষ্টা করতেন তাহলে তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত ইসলামে জীহাদের বিধানটাও কত হিকমতপূর্ণ। খেয়াল করে দেখবেন প্রত্যেকটা সংজ্ঞায় জীহাদের আগে দাওয়াতের কথা বলা আছে। এবং হাদিসেও জীহাদের পূর্বে সাহাবায়ে কেরামকে দাওয়াত দেয়ার কথা নবীজি বিশেষভাবে বলে দিতেন। সাথে তাগিদ দিয়ে একথাও বলতেন, "যদি একজনও তোমার জীহাদপূর্ব দাওয়াতে মুসলমান হয় তাহলে খাউরুন লাকা মিন হুমুরিন নায়াম, তাহলে সেটা তোমার জন্য একটি লাল উট সদকা করা থেকেও উত্তম কর্ম বলে বিবেচিত হবে।"
এই হল ইসলাম, যা জীহাদের ময়দানেও জীহাদ শুরু করার পূর্বে দাওয়াতের কথা বলে। জীহাদের মাধ্যমে কিতাল কখনোই ইসলামের মৌলিক উদ্দেশ্য না। এই কারণেই জীহাদকে শরিয়তে হাসান লিগাইরিহি বলা হয়েছে। জীহাদকে ফরজ হিসেবে রাখা হয়েছে একটি ডিফেন্স হিসেবে। আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার লক্ষ্যে। যারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে বাঁধা দেয় তাদেরকে দমন করার লক্ষ্যে। এত মহান একটা বিধান যার সাথে ইসলামের স্বার্থ জড়িত সেটাকেই যখন কেউ উগ্রপন্থার মোড়কে উপস্থাপন করতে আসে তখন তাঁর প্রতি ক্ষোভ এবং করুণা সমানভাবে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। আল্লাহ এদের সঠিক বুঝ দান করুক। 

পূর্ব তুর্কিস্তান যেভাবে জিনজিয়াং হল


চীনের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের একটি প্রদেশ জিনজিয়াং। আয়তন ৬ লাখ ৪০ হাজার ৯৩০ বর্গমাইল।মধ্য এশিয়ার এই প্রদেশটি  আয়তনের দিক থেকে পুরো চীনের ৬ ভাগের এক ভাগ। এটি চীনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ।

প্রায় দেড় হাজার বছর যাবত এখানে মুসলিমরা স্বাধীনভাবে বাস করে আসছে। কিন্তু বিশ শতকের মধ্যভাগে এসে কমিউনিস্ট চীন এ অঞ্চলকে নিজেদের করায়ত্ব করে নেয়। মূলত ১৯২১ সালে চীনে   কমিউনিস্ট পার্টি গঠন হয়। এবং ১৯২৭ পর্যন্ত মাও সেতুংয়ের হাত ধরে এর বিকাশ ঘটতে থাকে। এবং ১৯৪৭ সালে তারা ক্ষমতায় আসে। 

কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসার পরই চীনের মুসলমানদের উপর শুরু হয় অকথ্য নির্যাতন। ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ করে তারা ইসলামের ঐতিহ্য ও প্রাচীন নিদর্শনাবলী একের পর এক ধ্বংস করে দিতে থাকে। বিশেষ করে চীনের হান সম্প্রদায়ের অত্যাচার ওখানকার মুসলিমদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এ সমস্ত কর্মকাণ্ড বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে আড়াল করে রাখতে তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। যেহেতু সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে চীনের মুসলমানদের নির্যাতনের এই অধ্যায় অনেকটাই অজানা সে হিসেবে বলাই যায় যে কমিউনিস্ট সরকার তার সেই  চেষ্টায় অনেকাংশেই সফল হয়েছে।

বলছিলাম জিনজিয়াংয়ের কথা। অঞ্চলটির নাম আসলে ছিল তুর্কিস্তান। কমিউনিস্ট সরকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ অঞ্চলটির নাম পরিবর্তন করে রেখেছে জিনজিয়াং।

অবস্থান ও পরিচিতিঃ
বর্তমানে মধ্য এশিয়ায় তুর্কি জাতিসমূহ অধ্যুষিত অঞ্চলকে তুর্কিস্তান বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে আধুনিক তুর্কমেনিস্তান , কাজাকিস্তান , উজবেকিস্তান , কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান ও চীনের জিনজিয়াং (চীনা তুর্কিস্তান)। অনেকে রাশিয়ার তুর্কি অঞ্চলসমূহ তুর্কিস্তানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। তার মধ্যে রয়েছে তাতারস্তান ও সাইবেরিয়ার কিছু অংশ।

যেহেতু অঞ্চলটির পরিধি অনেক ব্যাপক তাই একে পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ করে পূূর্ব তুর্কিস্তান ও পশ্চিম তুর্কিস্তান নামে অভিহিত করা হয়। চীন যে অংশটি দখল করে রেখেছে, তা হলো পূর্ব তুর্কিস্তান। আর পশ্চিম তুর্কিস্তান অতীতে স্বাধীন থাকলেও একসময় তা সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে ছিলো। ৯০ এর দশকে রাশিয়ার পরাজয়ের পর দখলকৃত অধিকাংশ ভূখণ্ড পুনরায় স্বাধীনতা লাভ করলেও তুর্কিস্তানীরা লাভ করে নামমাত্র স্বাধীনতা । সেই রাষ্ট্রগুলোকেই এখন স্বাধীন বলে ধরা হয়।

তুরকিস্তানের মুসলমানদের পরিচিতিঃ
তুর্কিস্তানের মুসলিমরা 'উইঘুর' নামে পরিচিত। উইঘুর হচ্ছে তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলিমদের একটি শাখা। পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এদের বসবাস। উইঘুর মুসলিমদের মোট সংখ্যা প্রায় এক কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশেই বাস করে ৮৫ লাখের মতো। রাজধানী বেইজিং ছাড়াও বিভিন্ন নগরীতেও অল্পসংখ্যক উইঘুর বাস করে। আর কিছু আছে হুনান ও চীনের অন্যান্য প্রদেশে। এ ছাড়াও কাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক, রাশিয়া, তাজিকিস্তান, পাকিস্তান ও মঙ্গোলিয়াতে উইঘুরদের বসবাস রয়েছে। এরা সুন্নি মুসলমান এবং অনেকেই সুফিবাদের চর্চা করে।

উইঘুর শব্দের অর্থ হচ্ছে নয়টি গোত্রের সমষ্টি বা সমন্বয়। তুর্কি ভাষায় এ জন্য উইঘুর শব্দকে বলা হয় 'টকুজ-ওগুজ'। টকুজ অর্থ নয় এবং গুর অর্থ উপজাতি। ওগুজ থেকে গুর শব্দটি এসেছে।
প্রাচীন আমলে আলতাই পর্বতমালার পাদদেশে তুর্কিভাষী বিভিন্ন গোত্র বা উপজাতি বাস করত। এদের মধ্যে নয়টি উপজাতিকে নিয়ে উইঘুর সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। উইঘুরদের কখনো কখনো ‘গাউচি’ এবং পরে ‘তিয়েলে’ জনগোষ্ঠী হিসেবেও ডাকা হতো। তুর্কি শব্দ তিয়েলে বা তেলে এর অর্থ হচ্ছে নয়টি পরিবার। বৈকাল হ্রদের আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী সিয়র তারদুস, বাসমিল, ওগুজ, খাজার, আলানস, কিরগিজসহ মোট নয়টি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে উইঘুর নামের জনগোষ্ঠী বা জাতি গড়ে ওঠে।

উত্তরাঞ্চলীয় ওয়েই রাজবংশের শাসনামলে উইঘুর জাতির অস্তিত্বের দলিলপত্র পাওয়া গেছে।এক সময় তারিম অববাহিকা থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত উইঘুর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। যুদ্ধবিগ্রহ, বন্যা, খরাসহ নানা কারণে এই সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে মঙ্গোলিয়ার উইঘুররা তারিম অববাহিকা এলাকায় চলে গিয়ে সেখানে ছোট ছোট কয়েকটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এ সময়ই বর্তমান জিনজিয়াং এলাকাটি কখনো 'উইঘুরিস্তান' আবার কখনো 'পূর্ব তুর্কিস্তান' নামে উইঘুর মুসলিমদের শাসনে ছিলো।

এই অঞ্চলে ইসলামের আগমনঃ
হিজরী প্রথম শতকেই তুর্কিস্তান অঞ্চলে মুসলিম বিজয়ীদের মাধ্যমে ইসলামের আগমণ ঘটে। ২য় খলীফা উমার রা. এর যুগে সর্ব প্রথম পশ্চিম তুর্কিস্তানের দক্ষিণ অঞ্চল বিজয় হয়। তারপর ক্রমান্বয়ে এর সীমানা বাড়তে থাকে।
৯৬ হিজরী সনে 'উমাইয়া' বংশীয় শাসক ওয়ালীদ বিন আবদুল মালিকের যুগে বিখ্যাত মুসলিম বীর, সেনাপতি কুতাইবাহ বিন মুসলিমের হাতে পূর্ব তুর্কিস্তানের ঐতিহাসিক শহর 'কাশগড়' বিজয় হয়।
বিজয়ের পর কুতাইবাহ্ বিন মুসলিম চীন সম্রাটের দরবারে হুবাইরার নেতৃত্বে ৩০০ জনের এক প্রতিনিধিদল পাঠান। তারা সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে বলেন "হয়তো ইসলাম গ্রহণ করো, নতুবা কর প্রদান করো, অন্যথায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকো"।

চীনের সম্রাট সমঝোতায় আসতে রাজী হলে কুতাইবাহ চীন বিজয়ের ঘোষণা দিয়ে দেন। তাদের দুঃসাহসিকতাপূর্ণ কথা ও কাজে চীন সম্রাট ভীত হয়ে যায় এবং নিজ দেশের কিছু মাটি, প্রচুর পরিমাণ সোনা-রূপা এবং রাজ পরিবার ও অন্যান্য শাহজাদাদের মধ্য হতে ৪০০ জনের একটি দল কুতাইবাহর খিদমাতে প্রেরণ করে। এর বিস্তারিত বিবরণ ইবনে কাছিরের সুবিখ্যাত ইতিহাসগ্রন্থ 'আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ'তে উল্লেখ আছে।

তারপর থেকে পূর্ব তুর্কিস্তান মুসলিমদের শাসনেই ছিলো। ব্যতিক্রম ঘটে, ১৬৬৪ সালে যখন বর্তমান চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মাঞ্চু শাসকরা এক রাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তারা মঙ্গোলিয়ার অধিকাংশ এলাকা, পূর্ব তুর্কিস্তান ও তিব্বত দখল করে এবং ২০০ বছর পর্যন্ত এই এলাকা তারা দখল করে রাখে। এই সময়কালে মাঞ্চু সম্রাটদের বিরুদ্ধে উইঘুররা অন্তত ৪২ বার বিদ্রোহ করেছে।
শেষ পর্যন্ত ১৮৬৪ সালে উইঘুররা পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে ওদেরকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন এবং কাশগড়কেন্দ্রিক এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। এটাকে 'ইয়েতিসার' বা সাত নগরীর দেশও বলা হত। কারণ কাশগড়, ইয়ারখন্ড, হোতান, আকসু, কুচা, কোরলা ও তুরফান নামে সাতটি নগরী এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তখন উইঘুরদের নতুন এই রাজ্য পূর্ব তুর্কিস্তান স্বাধীন রাজ্য হিসেবে তিন পরাশক্তি স্বীকৃতি দিয়েছিল।
১ উসমানী সালতানাত ১৮৭৩ সালে 
২ জার শাসিত রাশিয়া ১৮৭২ সালে  
৩ গ্রেট ব্রিটেন ১৮৭৪ সালে ।
এমনকি রাজধানী কাশগড়ে এই তিনটি দেশ তাদের কূটনৈতিক মিশনও খুলেছিল। কিন্তু রাশিয়ার জার পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করে নিতে পারে এমন আশঙ্কায় মাঞ্চু শাসকরা ১৮৭৬ সালে আবার হামলা করে পূর্ব তুর্কিস্তানে।

জিনজিয়াং নামকরণঃ
জেনারেল ঝু জংতাংয়ের নেতৃত্বে এক বাহিনীর হামলা করে তুর্কিদের উপর। এবং এই হামলায় নগ্ন সমর্থন জানায় ব্রিটেন। দখলের পর ১৮৮৪ সালের ১৮ নভেম্বর পূর্ব তুর্কিস্তানের নাম পাল্টে রাখা হয় 'জিনজিয়াং' বা 'সিনকিয়াং' যার অর্থ ‘নতুন ভূখণ্ড’। কিন্তু মুসলিম বিশ্ব এখনো এই এলাকাকে মোগলিস্তান বা তুর্কিস্তানের পূর্ব অংশ হিসেবেই জানে। জিনজিয়াং নামকরণের আগে এই ভূখণ্ড মাঞ্চু চীনাদের কাছে 'হুইজিয়াং' বা মুসলিমদের ভূখণ্ড হিসেবে পরিচিত ছিল।

পুনরায় স্বাধীনতাঃ
পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার পর উইঘুর স্বাধীনতাকামীরা তাদের মুক্তির লড়াই অব্যাহত রাখে। ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে তারা দুইবার বিদ্রোহ করেছে এবং শেষবার তারা সফলও হয়। তারা আবার পূর্ব তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। চীনের জাতীয়তাবাদী সরকার স্বাধীন তুর্কিস্তানকে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং জোসেফ স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নও নতুন এই রাষ্ট্রকে সমর্থন জানায়। কিন্তু চীনের গৃহযুদ্ধে জাতীয়তাবাদীরা হেরে যাওয়ার পর 'মাও সে তুংয়ের' নেতৃত্বে বিজয়ী কমিউনিস্টরা তুর্কিস্তানকে চীনের সাথে কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এতে উইঘুর নেতারা রাজি হননি। এর পর এক রহস্যঘেরা বিমান দুর্ঘটনায় পূর্ব তুর্কিস্তানের সব শীর্ষ উইঘুর নেতা প্রাণ হারান। প্রচলিত আছে যে, মাও সে তুংয়ের চক্রান্তেই ওই বিমান দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছিল।

কমিউনিস্ট চীনের দখলে পূর্ব তুর্কিস্তানঃ
ওই বিমান দুর্ঘটনার পরপরই জেনারেল ওয়াং ঝেনের নেতৃত্বে বিশাল এক চীনা বাহিনী মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পূর্ব তুর্কিস্তানে হামলা চালিয়ে সেটি দখল করে। এরপর ওই ভূখণ্ডের নাম পরিবর্তন করে আবার জিনজিয়াং রাখা হয়। চীনা দখলের পর অনেক স্বাধীনতাকামী উইঘুর নেতা পালিয়ে তুরস্কে ও বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে চলে যান। তখন থেকেই জিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনা কমিউনিস্ট সরকার নানাভাবে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে।

চীন সরকার মুসলিমদের ইতিহাস ও কাশগড় নগরীর প্রাচীন ভবনগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। এমনকি এখান থেকে প্রাদেশিক রাজধানী সরিয়ে হাজার মাইল দূরের 'উরুমচি' বা 'উরুমকি'কে জিনজিয়াংয়ের রাজধানী বানিয়েছে। তাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিচিতি ও স্বার্থের প্রতি সরকারের ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ নেই। উইঘুর শিশুরা স্কুলে তাদের নিজস্ব ভাষা ও ধর্ম শিক্ষা করতে পারে না। স্কুলে কেবল চীনা ভাষাতেই শিক্ষা দেয়া হয়। হান চীনারা তাদেরকে আবর্জনার মতো গণ্য করে। সরকার উইঘুরদের প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দেয়ার জন্য বিগত বছরগুলোতে উরুমচিসহ জিনজিয়াংয়ের অন্যান্য স্থানে লাখ লাখ হানকে এনে বসতি গড়ে দিয়েছে। রাজধানী উরুমচির প্রায় ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে ৭৫ শতাংশের বেশি হচ্ছে হান। এটি এখন হানদের নগরীতে পরিণত হয়েছে।

হান পরিচিতিঃ
চীনের অধিকাংশ অধিবাসীকে বলা হয় ‘হান’। কিন্তু এই হান ছাড়াও চীনে বাস করে একাধিক জাতি। যে অঞ্চলে হান চীনাদের বাস, তাকে বলা হয় খাস চীন।
চীনা বলতে প্রধানত আমাদের মনে আসে এই হান চীনাদের কথা। চীনের ইতিহাস ও সভ্যতা বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি, তা হলো এই হান চীনাদেরই সৃষ্টি।
চীনের যে অঞ্চল মাঞ্চুরিয়া নামে পরিচিত, সেখানে বাস করত মাঞ্চুরা। নৃজাতিক দিক থেকে এরা হলো হান চীনাদের থেকে ভিন্ন। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মাঞ্চুদের এক রাজা খাস চীন দখল করে সপ্তদশ শতাব্দীতে এবং মাঞ্চু রাজবংশ মহাচীন শাসন করে ১৯১২ সাল পর্যন্ত। মাঞ্চুরা আর হান চীনারা এখন প্রায় এক হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। মাঞ্চু রাজারা এক পর্যায়ে চীনের সভ্যতাকেই নিজেদের করে নিয়েছে। কিন্তু মাঞ্চু ও হানদের মধ্যে যে রকম সদ্ভাব গড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে, মহাচীনে বসবাসকারী অন্যান্য নৃজাতি ও ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের সাথে হান চীনাদের একই রকম সদ্ভাব গড়ে উঠতে পারেনি। যেমন তিব্বতী ও তুর্কিস্তানীদের সাথে ওদের বৈষম্যমূলক আচরণ।

মুসলিমদের উপর কঠোরতাঃ
জিনজিয়াংয়ে চীন সরকারের অনুসৃত কঠোর নীতির কারণে খুব সামান্যসংখ্যক উইঘুর মুসলিমই হজ্জে যাওয়ার সুযোগ পান। রমজান মাসে উইঘুর সরকারি কর্মচারীরা রূযা রাখতে পারেন না কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞার কারণে। জুমার নামাজের খুৎবায় কী কথা বলা হবে সেটাও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আগেই ইমামকে বলে দেয়। উইঘুরদের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত কাশগড় নগরীর অনেক মসজিদ ও ভবন ভেঙে ফেলে সেখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। নগরীর অনেক এলাকার মুসলিমদের উচ্ছেদ করে কাশগড় থেকে শত মাইল দূরে নির্মিত আবাসিক কমপ্লেক্সে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের কোনো অনুমতি নেয়া কিংবা জিজ্ঞাসা করারও প্রয়োজন মনে করেনি সরকার।

পূর্ব তুর্কিস্তান সম্পর্কিত কিছু বাস্তব তথ্যঃ
(১) ঐতিহাসিকভাবে পূর্ব তুর্কিস্তান কখনোই চীনের অংশ ছিল না। বরং এই ভূমিকে 'হান' চীনারা উপনিবেশে পরিণত করেছে, যেমন ভাবে ব্রিটিশরা আমাদের উপমহাদেশকে উপনিবেশে পরিণত করেছিল। এই ভূমির অবস্থান চীনের মহা প্রাচীরের বাইরে। আমরা জানি, চীনের মহা প্রাচীর ছিল চীনের সীমানা নির্ধারক স্থাপনা যা বহিঃশত্রুদের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে চীনারা নির্মাণ করেছিল। পূর্ব তুর্কিস্তান যেমনি চীনের প্রাচীরের বাইরে, ঠিক তেমনি Jade Gate (জেড ফটক) এর পশ্চিমে। সুতরাং ইতিহাস সাক্ষী, কস্মিনকালেও পূর্ব তুর্কিস্তান চীনের অংশ ছিল না। তাই, শুধুমাত্র পূর্ব তুর্কিস্তান নাম পরিবর্তন করে জিনজিয়াং/ সিংকিয়াং (অর্থ- নতুন রাজ্য) রাখলেই অতীত ইতিহাস বদলে যাবে না।
(২) বিগত দুই সহস্রাব্দের মধ্যে ১৮০০ বছরই পূর্ব তুর্কিস্তান চীনের কবল থেকে মুক্ত ছিল। আর ১০০০ বছর পুরনো ইসলামী ইতিহাসের কথা হিসাব করলে, দীর্ঘ ৭৬৩ বছর পূর্ব তুর্কিস্তানের মুসলিমরা স্বাধীন থাকলেও, বর্তমানে ও অতীতের বিভিন্ন সময় মিলিয়ে মোট ২৩৭ বছর তারা চীনের কাছে পরাধীন আছে।
(৩) ১৯৪৯ সালের হিসাব অনুযায়ী পূর্ব তুর্কিস্তানের ৯৩% জনসংখ্যা ছিল উইঘুর বা তুর্কি মুসলিম। কিন্তু এ সংখ্যা কমে ৯৩ % থেকে বর্তমানে ৫৫% এ নেমে এসেছে। কারণ, বিগত ৬০ বছর যাবত চীনা কমিউনিস্ট সরকার মুসলিমদেরকে পূর্ব তুর্কিস্তান থেকে চীনের অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করেছে। বর্তমানে এখানে হান চীনাদের সংখ্যা ৪৫%, যেখানে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখলের আগে অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে যা ছিল মাত্র ৭%।
(৪) ১৯৪৯ সালে চীনের ক্ষমতা দখলের পর থেকে কমিউনিস্ট সরকার বেশ কয়েকবার পূর্ব তুর্কিস্তানে চৈনিক জাতিশুদ্ধি অভিযান চালায়। যাতে প্রাণ হারায় প্রায় ৪৫ লক্ষ মুসলিম।
(৫) চীনা সরকার এ পর্যন্ত নিজেদের নাগালে যতগুলো কুরআনের কপি কিংবা দ্বীনী কিতাব পেয়েছে, প্রত্যেকটাকে বাজেয়াপ্ত করেছে। ওরা এ পর্যন্ত মোট ত্রিশ হাজার সাতশ টি (৩০,৭০০) মুদ্রিত আধুনিক ও হাতে লেখা প্রাচীন ইসলামী কিতাব আগুনে ভস্ম করেছে, আটাশ হাজার (২৮,০০০) মসজিদ বন্ধ করে দিয়ে সেগুলোকে বারে (মদের আড্ডা) পরিণত করেছে, আঠারো হাজার (১৮,০০০) মাদ্রাসা গুদামঘরে পরিণত করেছে, এক লক্ষ বিশ হাজার (১,২০,০০০) আলেমে দ্বীনকে হত্যা করেছে এবং চুয়ান্ন হাজার (৫৪,০০০) জনকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে লেবার ক্যাম্পের শ্রমিক-মজুর বানিয়েছে।
(৬) চীনে কোন মুসলিমকে কুরআন শিক্ষা দেয়ার শাস্তি: ১০ বছরের কারাদণ্ড!
(৭) মুসলিম মহিলাদের হিজাব পরিধান আইনত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ! কোন মুসলিমা বোন হিজাব পড়ে যদি ধরা পড়েন, তাকে ৫০০০ ডলার জরিমানা দিতে হয়। অথচ পূর্ব তুর্কিস্তানের একজন মুসলিমের সারা বছরের গড় আয়ই কিনা কেবলমাত্র ১০০০ ডলার!
(৮) চীন পূর্ব তুর্কিস্তানকে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করার জায়গা বানিয়েছে। এ পর্যন্ত তারা সেখানে মোট ৩৫ টি পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করেছে, যার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে দুই লক্ষ (২,০০,০০০) মুসলিম প্রাণ হারিয়েছে। অনবরত পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার কারণে পূর্ব তুর্কিস্তানে তেজস্ক্রিয়তার এমন প্রভাব পড়েছে যে এক বছরেই (১৯৯৮ সাল) সেখানে বিশ হাজারের (২০,০০০) উপর বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। আর বিগত বছরগুলোতে পূর্ব তুর্কিস্তানে ক্যান্সার, প্যারালাইসিস এবং বেশ কিছু জীবন নাশক অজানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছে।
(৯) বিশ এর কম বয়সী তরুণদের কুরআন শেখা, মসজিদে আসা, এমনকি জুমার নামায পড়াও নিষিদ্ধ!!! আর যাদের বয়স ২০ এর উপর তাদেরকে যদিও জুমা পড়ার সুযোগ দেয়া হয়, কিন্তু তাদেরকে নামায পড়ার জন্য মাত্র ২০ মিনিট সময় দেয়া হয়। ২০ মিনিটের চেয়ে ১ সেকেন্ড বেশী সময় মসজিদে থাকা আইনত নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয়!!!
(১০) পূর্ব তুর্কিস্তানকে সদা 'শান্ত' রাখতে চীনা সরকার সেখানে সেনা ও পুলিশবাহিনীর ১০ লক্ষ সদস্যকে সর্বদা মোতায়েন করে রাখে।

সূত্র: উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন ওয়েব সাইট ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থ সমূহ।

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...