Saturday, August 12, 2017

জীহাদ নিয়ে আল্লামা তাক্বী উসমানীর "সংশয়ে"র জবাব দিলেন কথিত জীহাদী মুফতি


নেট ব্রাউজ করতে করতে এক মুফতি সাহেবের প্রলাপ সামনে এসে পড়লো। তিনি তক্বী উসমানী সাহেবের জীহাদের ব্যাখ্যার মধ্যে ভুল খুজে পেয়েছে। এবং দলিলের মাধ্যমে এর শক্ত জবাব দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য শুনে মনে হল কিছু নোট তুলে রাখা উচিৎ। কারণ এই কথিত মুফতি সাহেবদের অনুসারী শুনেছি দিনদিন বাড়ছে। কোনদিন যদি আমাদের আকাবিরদের সিলসিলায় শিখে আসা দ্বীনকে দ্বীন বলতেই অস্বীকার করে বসে তাহলে তো এদের মুকাবেলা করার মত দুঃখজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার প্রয়োজন পড়লেও পড়তে পারে।

লোকটার নাম মুফতি জামিল মাহমুদ। সে তাঁর বক্তব্যের শিরোনাম দিয়েছে, জিহাদ নিয়ে মুফতি তকি উসমানীর সংশয়। তাঁর কথাগুলো ছিল এরকম,

“তক্বী উসমানী সাহেব তাঁর কুরআন তাফসির গ্রন্থ তাওজিহুল কুরআনের বাংলা অনুবাদ যেটি মাক্তাবাতুল আশরাফ থেকে ছাপা হয়েছে, সেখানে এক আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “দ্বীনের পথের যেকোন মেহনত বা প্রচেষ্টাকেই জীহাদ বলা হবে। সশস্ত্র প্রচেষ্টাও এর অন্তর্ভুক্ত। তবে শান্তিপূর্ণ যেকোন মুজাহাদাও জীহাদ”।

‘ওয়াজাহিদু ফিল্লাহি হাক্কা জিহাদিহ’ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় তকি সাহেব এই কথা লিখেন।
এখন সেই পন্ডিত মুফতি সাহেবের কথা হল, মূলত এই ধরণের ব্যাখ্যার মাধ্যমেই তাক্বী উসমানী সাহেবরা বর্তমান যুগের বিভিন্ন শ্রেনীর আলেমদের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। যার কারণে জীহাদের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়কে অনেকে ভুল বুঝছেন।
গণতান্ত্রিক রাজনীতির আলেমগণ তাদের গণতান্ত্রিক কার্যক্রমকে, তাবলিগীরা তাদের মেহনতকে, পীর মুরিদরা তাদের পীর মুরিদিকে, দরস ও তাদরীস নিয়ে মেহনত করা উস্তাদগণ তাদের মেহনতকে জীহাদ মনে করছেন। তাঁর নিজেদের মনমত চেষ্টা প্রচেষ্টাকে জীহাদ বলে মূল জীহাদকে বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবেই জীহাদ সকল নিজ নিজ কর্মের মাঝে একাকার হয়ে গেছে।
জীহাদের প্রকৃত সংজ্ঞা কি?
হানাফি মাযহাবের ইমাম আল বাহরুর রায়েকের মুসান্নেফ বলেছেন, জীহাদ হল সত্য দ্বীনের দিকে আহ্বান করা, এবং তারা তা অস্বীকার করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা।
ফাতহুল কাদিরের মুসান্নেফ ইবনুল হুমাম ও দুররুল মুসান্নেফের মুসান্নেফও এই সংজ্ঞা দেন। শরহে বেকায়ার মুসান্নেফও এই সংজ্ঞা দেন”।

এই ছিল সেই মুফতি সাহেবের বক্তব্য। এবং শেষ পর্যায়ে গিয়ে তিনি তকি উসমানী সাহেবের এই ব্যাখ্যাকে কাদিয়ানী মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত বলতেও ছাড়েননি। মুফতি সাহেবের বক্তব্য হল, উপমহাদেশে ওলামায়ে কেরামের ইংরেজবিরোধী আন্দোলনকে বানচাল করার লক্ষ্যে তখনকার মানুষকে কাদিয়ানীরা যেমন জীহাদের অপব্যাখ্যা বুঝানো শুরু করেছিল আজকেও অনেক ওলামায়ে কেরাম তাদের সেই কাদিয়ানী মতবাদের সুরে কুরআনের ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন। এইভাবে ব্যাখ্যা দিলে জীহাদ যে শরিয়তের একটি স্বতন্ত্র বিধান সেটাই নাকি অস্বীকার করা হয়।

আসলে এই মুফতি সাহেবদের মত অতি উৎসাহী লোকদের এইসব কথাবার্তা শুনে যাচাইবাছাই না করেই অনেকে অনুসরণীয় ওলামাদের অতিরিক্ত উদারমনা ভাবতে শুরু করেন। এবং তখন এই অতি উৎসাহীদেরকেই একান্ত মুখলিস মনে হতে থাকে। কিন্তু এইসব অতি উৎসাহীদের আবেগের উপর শরিয়তের আহকামের ভিত্তি না এ কথাও মনে রাখতে হবে। এ ধরণের চিন্তা আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাওয়ার কারণ হচ্ছে অনেকক্ষেত্রেই আমাদের মধ্যে এসব বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকে না। যার ফলে তাদের এইসব অতিআবেগী বক্তব্যকে কখনো কখনো যৌক্তিক মনে হতে থাকে। এবং এতে উলামায় কেরামের উপর থেকে আস্থা উঠে যাওয়া সহ আরো মারাত্মক কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়।

 আপাতত অত্র মুফতি সাহেবের এই কথাগুলোর কিছু পয়েন্ট নিয়ে পর্যালোচনা করা যাক।

তকী উসমানী সাহেবের ভুল ধরতে গিয়ে প্রথমেই তিনি নিজে যেই ভুলটা করেছেন, উনি কুরআন তাফসীরের মূলনীতি বিবেচনায় রাখেননি। মূলনীতি হল, কুরআনের একটি আয়াত বিভিন্ন অর্থ এবং ব্যাখ্যার সুযোগ রাখে। এবং মুফাসসিরিনে কেরামের দায়িত্ব হল কুরআনের অত্র আয়াতের পূর্বাপরের সারমর্ম অনুধাবন করে অন্যান্য আয়াত হাদিস ও শরিয়তের প্রাসঙ্গিক সমস্ত বিষোয়ের আলোকে আয়াতের ব্যাখ্যা পেশ করা। এই মূলনীতি অনুযায়ী এখানে এক শব্দের একাধিক ব্যাখ্যা আসাটা মোটেও ভুল কোন সিদ্ধান্ত না। মুফতি সাহেব এ মূলনীতিটাকে এড়িয়ে গেছেন। এড়িয়ে না গেলে অবশ্য এমন "ভুল" ধরাও সম্ভব হতোনা।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে ভুল ধরতে গিয়ে তিনি শুধু মাত্র একটি ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন। সেটা হচ্ছে জীহাদ। বাকিগুলোকে অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে সেসব গ্রহণ করলে নাকি এখানে জীহাদের অপব্যাখ্যা হয়। পরবর্তীতে তিনি এটাও বলেছেন যে, তকী উসমানী সাহেব অন্য ব্যাখ্যাগুলোকে উল্লেখ করার কারণেই জীহাদকে ছোট করে দেখা হয়েছে। এবং মানুষ এর থেকে শরীয়তের বিধান জীহাদকে ভুল বুঝছে। অথচ রেফারেন্স দেয়ার সময় এই লোকই স্বীকার করেছে যে তকী সাহেব ব্যাখ্যায় এটাও লিখেছেন যে, "সশস্ত্র প্রচেষ্টাও জীহাদের অন্তর্ভুক্ত"। তো এরপরও মুফতি সাহেব কিভাবে বলেন যে এখানে তিনি জীহাদকে অস্পষ্ট করছেন। বরং আরো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা উল্লেখ করে এখানে তাক্বী উসমানী সাহেব আরো স্পষ্ট ব্যাখ্যাই করেছেন।

মুফতি সাহেবের বিভিন্ন কথাবার্তা নিতান্তই তাঁর কম জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে । এবং তাঁর আরবি ও উর্দু শব্দের ভুলভাল উচ্চারণে বুঝা যাচ্ছিল তিনি আরবি পড়ুয়া না। রেফারেন্সও দিয়েছেন তাওযিহুল কুরআনের বাংলা অনুবাদ থেকে। মানে হচ্ছে, যেই লোক আরবি তো দূরের কথা তকী উসমানী সাহেবের কিতাব উর্দুতে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি সে এসেছে তকী সাহেবের ভুল ধরতে। ব্যাপারটা হাস্যকর বটে।


শেষ কথা বলি, দ্বীনকে বুঝতে হলে তাফাক্কুহ ফিন দ্বীন খুবই জরূরী। এবং এই তাফাক্কুহের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের অনুসরণের পাশাপাশি উলুল আমরের অনুসরণের কথা কিন্তু আল্লাহ নিজেই বলে দিয়েছেন। প্রত্যেকযুগে উলুল আমর ছিল, এখনও আছে, কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। এই ধারাবাহিকতার মধ্যেই আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে সংরক্ষন করবেন। শরিয়তে আউট অফ কন্টেক্সট কোন দাবীর সুযোগ নেই। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে নিকট অতীত পর্যন্ত ইসলাম টিকে থাকার ইতিহাস লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সব কিছুই একটা ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে আসছে। যে ধারাবাহিকতায় একটা দল খোদায়ী বিধান অনুযায়ী সবসময় হকের উপর ছিল, আছে এবং থাকবে। এবং বাস্তবিক অর্থে শরিয়তকে বুঝতে হলে তাদের তাফাক্কুহকে গভীরভাবে পড়তে হবে। অর্থাৎ দ্বীনকে তারা কিভাবে বুঝেছেন এটা আমাদের লক্ষ্য করতে হবে এবং সাথে সাথে পূর্ণ আস্থার সাথে তাদের অনুসরনও জরূরী। অন্যথায় এই মুফতি সাহেবের মত আউট অফ কনটেক্সট দলিল বিভিন্ন জায়গা থেকে এনে যোগ করে নিজের আবেগী মতকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। এবং কোনসময় তা রূপ নিতে পারে উগ্রপন্থায়।


এর একটা উদাহরণ এই মুফতি সাহেবের চিন্তাটাকে সূক্ষভাবে ধরার চেষ্টা করলে বুঝা যাবে। তিনি জীহাদকে না বুঝে আয়াতের ব্যাখ্যাকে বাতিল প্রমাণ করার জন্য দলিল দিতে গিয়ে অনেক সংজ্ঞাও এনেছেন জীহাদের। আয়াতের ব্যাখ্যার আলোচনায় যাওয়া উদ্দেশ্য না, এখানে মুফতি সাহেবের আবেগ থেকে জন্ম নেয়া অন্ধত্ব নিয়ে বলতে চাচ্ছি। তিনি যদি জীহাদের এই সংজ্ঞাগুলো থেকেও  নিজে একটু বুঝতে চেষ্টা করতেন তাহলে তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যেত ইসলামে জীহাদের বিধানটাও কত হিকমতপূর্ণ। খেয়াল করে দেখবেন প্রত্যেকটা সংজ্ঞায় জীহাদের আগে দাওয়াতের কথা বলা আছে। এবং হাদিসেও জীহাদের পূর্বে সাহাবায়ে কেরামকে দাওয়াত দেয়ার কথা নবীজি বিশেষভাবে বলে দিতেন। সাথে তাগিদ দিয়ে একথাও বলতেন, "যদি একজনও তোমার জীহাদপূর্ব দাওয়াতে মুসলমান হয় তাহলে খাউরুন লাকা মিন হুমুরিন নায়াম, তাহলে সেটা তোমার জন্য একটি লাল উট সদকা করা থেকেও উত্তম কর্ম বলে বিবেচিত হবে।"
এই হল ইসলাম, যা জীহাদের ময়দানেও জীহাদ শুরু করার পূর্বে দাওয়াতের কথা বলে। জীহাদের মাধ্যমে কিতাল কখনোই ইসলামের মৌলিক উদ্দেশ্য না। এই কারণেই জীহাদকে শরিয়তে হাসান লিগাইরিহি বলা হয়েছে। জীহাদকে ফরজ হিসেবে রাখা হয়েছে একটি ডিফেন্স হিসেবে। আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করার লক্ষ্যে। যারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে বাঁধা দেয় তাদেরকে দমন করার লক্ষ্যে। এত মহান একটা বিধান যার সাথে ইসলামের স্বার্থ জড়িত সেটাকেই যখন কেউ উগ্রপন্থার মোড়কে উপস্থাপন করতে আসে তখন তাঁর প্রতি ক্ষোভ এবং করুণা সমানভাবে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। আল্লাহ এদের সঠিক বুঝ দান করুক। 

No comments:

Post a Comment

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...