আহলে হাদিস বা গাইরে মুকাল্লিদ
মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ
১৮১৮ সালে সর্বপ্রথম আহলে হাদিস নামে
একটি দল নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করে। এই দলটির নাম আগে ছিল মুয়াহহিদীন। এরপর তারা
মুহাম্মদী নামে পরিচিতি লাভ করে। তাদের অনেকে ওয়াহাবী বলে আখ্যা দেয়ায় তারা ইংরেজ
সরকার থেকে নিজেদেরকে আহলে হাদিস নামে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেয়।
শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এদের প্রধান
সমস্যা হল, তারা শরিয়তের চার দলিলের মধ্যে ইজমা এবং কিয়াসকে অস্বীকার করে।
শুধুমাত্র কুরআন ও হাদিসকে দলিল হিসেবে মানার দাবী করে। কারণ ঈমামদের ইজমা ও কিয়াস
মানার অর্থ হল তাদের তাকলীদ করা। আর তাকলীদ করা তাদের দৃষ্টিতে শিরক। মূলত যারা
ইজমা কিয়াস মানে না তারা যাহেরীয়া নামে পরিচিত। দাউদে যাহেরী, ইবনে হিশাম,
শাওকানী, ইবনে তাইমিয়া এ শ্রেণির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মজার ব্যাপার হল, বর্তমানে আমাদের
দেশের আহলে হাদিসরা তাকলীদের বিরুদ্ধে বললেও তারা কার্যত উপরোক্ত আলেমদেরই তাকলীদ
করে থাকেন। কুরআন হাদিস থেকে সরাসরি আমল করতে সক্ষম নয় এমন মানুষের ক্ষেত্রে তাকলীদ
ওয়াজিব। কুরআনে এসেছে, “ফাসআলু আহলায যিকরি ইন কুন্তুম লা তালামুন, তোমরা না জেনে
থাকলে যারা জানে তাদের থেকে জেনে নাও”
সাহাবীদের যুগেও তাকলীদ পাওয়া যায়। যেসব
সাহাবিরা ইজতেহাদ করতে সক্ষম ছিলেন না
তারা ফকিহ সাহাবিদের থেকে জেনে নিতেন। মুয়ায রা. কিয়াস ও ইজতেহাদ করে ইয়ামানবাসীর
সমস্যা সমাধান করবেন শুনে রাসুলুল্লাহ সা. খুব খুশি হয়েছিলেন। বনু কুরাইযা যাওয়ার
পথে ভিন্ন ভিন্ন ইজতেহাদের উভয়টিকে হুজুর সঠিক বলেছেন।
ইবনে আব্বাসের তাকলিদ করতেন মক্কার
অধিকাংশ সাহাবী। মদিনার অধিকাংশ সাহাবী যায়েদ ইবনে সাবেত রা. এর তাকলীদ করতেন বলে
বুখারী শরীফে এসেছে। কুফাবাসী ইবনে মাসউদ এবং ইয়ামানবাসী মুয়ায রা এর এবং
সিরিয়াবাসী আমরুনিল বুকাঈ এর তাকলীদের প্রমাণও হাদিসে আছে। রাসুলের যুগের আরো এমন অনেক
ঘটনা তাকলীদের প্রমাণ বহন করে।
তাছাড়া হযরত উমরের জারী করা বিশ
রাকাত তারাবীহকে যদি বিদআত বলা হয় তাহলে সাহাবা ও রাসূল উভয়কে বিদাতী বলতে হবে। কেননা
রাসুলই তো তাদেরকে মানতে বলে গেছেন।
আহলে হাদিসগণ আহলে সুন্নাতের
অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার কারণঃ
১) তাকলীদ প্রসঙ্গঃ তারা চার
মাযহাবের তাকলীদকে বিদআত বলে। অথচ আহলে সুন্নাতের নীতি হল, যে ব্যক্তি ইজতিহাদ
করার যোগ্যতা রাখে তাঁর জন্য ইজতেহাদ জরুরী। তাকলীদ অবৈধ। আর যার মধ্যে ইজতেহাদের
যোগ্যতা নেই তাঁর জন্য কোন এক মুজতাহিদের মাযহাবের তাকলিদ করা ওয়াজিব।
২) আল্লাহর গুণাবলি প্রসঙ্গঃ যে
শব্দগুলোতে আল্লাহ তায়ালার আকৃতি বা দেহ প্রমাণিত হয় সেগুলোকে আহলে সুন্নতগণ
বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করেন না। কারণ এখানে বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে কুরআনের আরেকটি
আয়াতের বিপরীত হয়ে যায়। লাইসা কামিছলিহি শাই, ও্যাহুয়াস সামিউল বাসির।
কিন্তু আহলে হাদিসি গণ এই নীতি মানেন
না। তারা আবুল হাসান আশয়ারী ও আবু মানসুর মাতুরিদিদেরকে ভ্রান্ত বলেন।
৩) দোয়ার মধ্যে উসিলা প্রসঙ্গঃ জীবিত
ও মৃতব্যক্তি নিজের আমল ও অন্যের আমল দ্বারা উসিলা গ্রহণ সর্বাবস্থায় জায়েজ। কারণ
এসবের মূলকথা হল আল্লাহ তায়ালার উসিলা ধারণ। অথচ লা মাযহাবীরা এখানে গোড়ামী করে
থাকে। তারা এই উসিলাকে অবৈধ বলে থাকে।
৪) ঝাড়ফুক তাবিজঃ আহলে সুন্নতের নিকট
বৈধ। অথচ তারা এটাকে কুফুরী বলে।
৫) রাসুলের রওজা যিয়ারতের নিয়তে
মদিনা যাওয়াঃ আমাদের দেশের আহলে হাদিসগণ ইবনে তাইমিয়া ও কাজী ইয়াজের ব্যক্তিগত
মতামত, তাফাররুদাতের উপর ভিত্তি করে সাহাবা তাবেঈনদের আমলের বিপরীতে গিয়ে নতুন
তর্কের সুত্রপাত ঘটাচ্ছে। তাদের বক্তব্য হল, মদিনাতে যাবে একমাত্র মসজিদে নববীতে
নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে। রওযা যিয়ারতের নিয়তে যাওয়া অবৈধ। তাদের দলিল হল, লা
তাশুদ্দুর রিহালা ইল্লা ইলা সালাসাতি মাসাজিদ। মসজীদে নববী, মসজিদে হারাম ও মসজীদে
আকসা ছাড়া অন্য কোন কিছুর উদ্দেশ্যে সফর করা যাবেনা।
হাদিসের যেই ব্যাখ্যা আহলে হাদিসরা
গ্রহণ করেছে তা নিতান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা। অথচ সকল মুহাদ্দিসগণ এইভাবে
ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে তিন মসজিদ ছাড়া অন্য কোন মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা যাবেনা। এ
হাদিসে অন্য কোন স্থানের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এবং আল্লামা আসকালানী ও আইনিসহ
সকলেই এই ব্যাখ্যাকে সঠিক বলেছেন।
৬) জুময়ার খুতবা অন্য ভাষায় পড়া যাবে
কিনাঃ আহলা হাদিসরা বলে পড়া যাবে। অথচ সাহাবীদের যুগে সাহাবীদের মধ্যে যারা
ভিন্নভাষী ছিলেন তারাও মাতৃভাষায় খুতবা পড়েননি। এই মাসলা প্রমাণের জন্য লা
মাযহাবীরা ঠিকই আবার যুক্তি কিয়াসের অনুসরণ করে থাকে।
৭) তাসাউফ ও আত্মশুদ্ধির ব্যাপারে
বাড়াবাড়িঃ শরীয়ত ও তরিকত উভয়টিই ইসলামের অঙ্গ। শরীয়তবিহীন তরিকতের যেমন মূল্য নেই
তেমনি তরিকতবিহীন শরীয়তেরও মূল্য নেই। মানুষের বিবেক পাহাড়া দিচ্ছে শরিয়তকে তেমনি
মানুষের অন্তর পাহাড়া দিচ্ছে তরীকতকে। সাহাবায়ে কেরাম এই আদর্শের উপরই প্রতিষ্ঠিত
ছিলেন। “কাদ আফলাহা মান যাক্কাহা, যে তাঁর অন্তরকে পবিত্র করলো সে সফল হল”
তাযকিয়ায় নফস অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এবং হাদিসে জিব্রাইলে একেই ইহসান বলা হয়েছে।
তাই তাসাউফকে অস্বীকার করার উপায় নেই, যা লা মাযহাবিরা বা গাইরে মুকাল্লেদরা করে
থাকেন।
No comments:
Post a Comment