নাফ নদির ওপাড় থেকে আসা শিশুদের লাশের মিছিল নিয়ে আসা হচ্ছে। ছবিটা দেখার পর কেন যেন মনে হচ্ছে এই শিশুদের আল্লাহর কাছে যেতে অন্য রোহিঙ্গা শিশুদের তুলনায় কষ্ট কিছুটা হলেও কম হয়েছে।
গত বছর অক্টোবরের গণহত্যায় বর্ডার পার হয়ে টেকনাফে যেই শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিল তাদেরকে যে কতটা নির্মমভাবে আহত করা হয়েছিল টেকনাফে ত্রাণ দিতে গিয়ে তার কিছু চিত্র নিজ চোখে দেখে এসেছিলাম। ঢাকা ফেরার পথে টেকনাফ হসপিটালে যাওয়া হয়। সেখানে মারাত্মকভাবে আহত শিশুর সংখ্যা তখন অনেক। বেশিরভাগ শিশুর বয়স পাচ থেকে সাতের ভেতর হবে। কারো পুরো শরীরে ব্যান্ডেজ করা। কারো কোমর পর্যন্ত। বেডে জায়গা নেই বলে অধিকাংশই মেঝেতে শুয়ে বসে চিকিৎসা নিচ্ছে। কারো মা কোলে নিয়ে বসে আছেন। আর যাদের মাকে মেরে ফেলা হয়েছে বা ওপাড় থেকে আসতে দেয়া হয়নি বা পথে হারিয়ে ফেলেছেন নিজের সন্তানকে সেইসব শিশুর অন্য কোন আত্মীয় পাশে বসে আছে। ব্যান্ডেজের কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম, এই ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর পুরো শরীর পলিথিন দিয়ে পেচিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে মানুষরূপী হায়নাগুলো। অপলক দৃষ্টিতে আমাদের চোখের পানির দিকে বাচ্চাগুলো তাকিয়ে ছিল সেদিন। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমরা কি এদের জন্য কিছু করতে পেরেছি? এখনো তো পারছিনা।
সেখানেই একটা বাচ্চা দূর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বয়স দুইবছর। তার শরিরে কোন ক্ষত দেখা যাচ্ছেনা। সামনে গিয়ে পাশের জনকে জিজ্ঞেস করতেই উনি বাচ্চাটাকে দাড় করালেন। এসব দেখে চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব না। একপাশের কোমর পাথর মেরে নামিয়ে দেয়া হয়েছে এইটুকুন বাচ্চাটার। কোমরের হাড্ডিটা জায়গা থেকে সরে যাওয়ায় সে আর দাঁড়াতে পারবেনা।
এইতো গেল হাসপাতালের ভেতরের অবস্থা। কিন্তু আহতদের অর্ধেকও এখানে নেই। বাইরের একটা বাচ্চার অবস্থা বলি। যেই বাচ্চাটি তার শরীরের পোড়া চামড়াগুলোর যন্ত্রণায় ঠিক ততক্ষণ কাদতে থাকে যতক্ষণ যে জেগে থাকে। এরপর যখন সে ঘুমায় তখনই দুঃস্বপ্ন দেখে আতকে উঠে। কারণ তার চোখের সামনে তার নিজের বাবা মাকে জবাই করার পর যখন তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তখন তার দাদী তাকে নিয়ে পালিয়ে এসে জান বাচিয়েছে। এসব নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হতে চাইবেনা। এমন আরো অনেকেই ধরা পড়ার ভয়ে চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় ভয়াবহ যন্ত্রণা সয়ে দিন পার করছে।
এক বছর শেষ হতে না হতেই আবার শুরু হল মুসলমানদের রক্ত নিয়ে রক্তপিপাসুদের হলিখেলা। অর্ধশতাব্দির ধারাবাহিকতায় এইবারও আমরা নিরবে সয়ে যাচ্ছি সবকিছু। এখন দুঃখ প্রকাশের একটা জায়গা আছে আমাদের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সেই অসহায় নির্যাতিত শিশুদেরই লাশের মিছিলের ছবি দেখে যাচ্ছি। সমবেদনা জানাচ্ছি। পোষ্ট লিখছি। ধিক্কার জানাচ্ছি। অনেক করে ফেলছি আসলেই।
ছবিতে বড় দেখালেও নদিটা আসলে অনেক ছোট। মিছিলটা সে তুলনায় একটু বড় হয়ে যাওয়ার কারণে পথেই হয়তো আটকে যাচ্ছে লাশগুলো। তাই আইলানদের মত পাড়ে এসে পৌছানো সম্ভব হচ্ছেনা রোহিঙ্গা শিশুদের। বাবা মাকেই হয়তো নিজেদের সন্তানদের লাশ এভাবে মাথায় করে পাড়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে। আমরা জানিনা লাশের মিছিলের আয়তন আর কতটা বড় হলে বিশ্ববাসীর বিবেক জাগ্রত হবে!


No comments:
Post a Comment