Friday, August 11, 2017

আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহঃ শিক্ষা ও তরবিয়্যত (১)

আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.

-মুফতি ফযলুল হক আমিনী

জীবনের শেষ আট বছরের অভিজ্ঞতায় যে বিষয়গুলো আমি তাঁর কাছে থেকে উপলব্ধি করেছি তা হল, তাঁর ইখলাস, দ্বীনের জন্য দরদ, আন্তরিকতা, মানুষ গড়ার সার্বক্ষণিক চিন্তা ও উম্মতের কল্যাণ কামনায় ব্যাকুলতা।

১৮৯৮ সালে গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা গ্রামে এই মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম। তাঁর পিতা-মাতার নাম ছিল যথাক্রমে আব্দুল্লাহ এবং আমিনা। তাঁর প্রপিতামহ বালাকোটের শহিদ সৈয়দ আহমদ বেরলভী রহ. এর বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়ে "গাজি" উপাধী লাভ করেছিলেন।

ছোটোবেলা থেকেই আরবি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। পিতার অজান্তে তিনি আরবি শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। এক সময় স্কুল ফাকি দিয়ে আরবি শেখার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠলেন। ছদর সাহেব তাঁর শৈশবের কথা স্মরণ করে বলতেন, "সে সময় কুরআন হাদিস বুঝার জন্য আমার অন্তর ব্যকুল হয়ে উঠত।" 

অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে হইয়েছিল। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্কুলের হিন্দু হেডমাস্টার তাঁর সততায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। এবং তাঁর প্রতি এতটাই আস্থা ও বিশ্বাস জন্মেছিল যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে গিয়ে একবার বলেই ফেলেছিলেন, "শামসুল হককে যদি পরিক্ষার আগে প্রশ্ন তুলে দেওয়া হয় তাহলেও আমার কোন চিন্তা থাকবেনা। কারণ আমি নিশ্চিত যে সে নিজেও দেখবেনা এবং কাউকে দেখাবেওনা।"
১৯১৫ সালে তিনি সেই স্কুল থেকেই  প্রথম স্থান অধিকার করেন।

ছদর সাহেব হুজুর আরেকটি ঘটনা বলতেন, একদিন ভাল জামাকাপড় পড়ে আত্মীয়র বাড়ি রওনা করেছি। পথে এক দরিদ্র কৃষককে কাদতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হয়েছে। 
কৃষক বলল,
-মাছ ধরার জন্য ক্ষেতের আইলে একটা চাই পেতেছিলাম। বৃষ্টিতে তা গভীর পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন সেটা উঠাতেও পারছিনা। 
এরপর আমি তাকে আঙ্গুলের ইশারায় দেখিয়ে দিতে বললাম যে ঠিক কোথায় পড়েছে। এবং এই ভাল জামা কাপড় নিয়ে কাদা পানিতে ঝাপ দিয়ে তুলে নিয়ে এলাম। সেদিনের পর থেকে আমার এখনো মনে হয়, আজ সেই বৃদ্ধের দুয়াতেই হয়তো দ্বীনের লাইনে আসতে পেরেছি।

প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ায় সদর সাহেবের রেজাল্ট ভাল দেখে তাঁর পিতা তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেন উচ্চশিক্ষার জন্য। প্রথমে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। কিন্তু এখানকার শিক্ষা উনার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যথার্থ ছিলনা। তিনি প্রাইভেটভাবে অনেকের কাছে দ্বীনী ইলম শিখতে থাকলেন। সীরাতের উপর লেখা আসাহহুস সিয়ারের লেখক মাওলানা আব্দুর রউফ দানপুরীর নিকট তিনি বিশেষ শিক্ষা অর্জন করেন। এরপর তিনি পিতার নির্দেশ রক্ষায় কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। 

১৯১৯ সাল। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তির জন্য অনেক ছাত্রের ভীড়। পাকিস্তানের মুনঈম খানসহ পরবর্তীকালে গণ্যমান্য হয়ে ওঠা আরো অনেকেই সেখানে ভর্তির জন্য আবেদন করেছিল। সদর সাহেব শুধুমাত্র পিতার আদেশ পালন করার জন্য সেখানে আবেদন করেন। তিনঘন্টার পরিক্ষায় এক ঘন্টা কোনভাবে লিখেই খাতা জমা দিয়ে এসে পড়েন। কিন্তু সেবার মুনঈম খানের মত লোকেরা চান্স না পেলেও সদর সাহেব প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে যান। এবং বাধ্য হয়েই তাকে সেখানে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হয়।

এখানে লেখা পড়ার সময় থানভী রহ এর কলকাতায় আগমন ঘটে। সদর সাহেব থানভী রহ. এর দরবারে গিয়ে দুয়ার দরখাস্ত করে একটি প্রশ্ন করলেন,
- হযরত, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পদ্ধতি কি?
থানভী রহ. তাঁর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন তুমি কিসে পড়ো বাবা?
-প্রেসিডেন্সি কলেজে।
-ইলমে দ্বীন কেন পড়ছো না?
প্রশ্নটা শুনে সদর সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। তিনি বললেন,
- আমি তো পড়ার জন্যে প্রস্তুত, কিন্তু আমার বাবা রাজি হচ্ছেন না।
থানভী র. খুব আফসোস করে বললেন,
-এমন জমানা এসে গেছে! ছেলে পড়তে চাচ্ছে, অথচ বাবা পড়তে দিচ্ছেন না!

ছদর সাহেব বলেন, থানভী রহ. এর সাথে সাক্ষাত করার পর ইলমে দ্বীন শেখার আগ্রহ এত বেড়ে গেল যে আমি প্রতিদিন কুরআন নিয়ে গভীর জঙ্গলে চলে যেতাম। দীর্ঘক্ষণ কুরআন মাথায় রেখে বুকে চেপে ধরে কান্নাকাটি করতাম আর আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বলতাম, হে আল্লাহ! এই অধমকে কি তুমি কুরআন পড়া থেকে বঞ্চিত রাখবে? আমাকে কি তুমি তোমার ছায়াতলে আশ্রয় দিবেনা? এরপর এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি হত যে জোরে কাদতে কাদতে আমি মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকতাম।

আল্লাহ তায়ালা আমার এই দুয়া কবুল করেছিলেন। ১৯২০ সালে ভারতে ইংরেজবিরোধী অসহযোগ অন্দোলন শুরু হলে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ সময় বাবার কাছে আমি এই মর্মে চিঠি লিখি যে, এই শিক্ষার আর প্রয়োজন নেই। এই পত্র লিখে দারুল উলুম দেওবন্দের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আমি তখন ভাবতাম মাদরাসা শিক্ষায় ব্যয়ও বুঝি ইংরেজী শিক্ষার মত এত বেশী। তাই ঠিক করে রেখেছিলাম কুলিগিরি করে মাদরাসায় পড়ার খরচ চালাবো। 

সদর সাহেব রজব মাসে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময় মাদরাসা নতুন বছরের ভর্তির আরো মাসখানেক ছিল। তিনি সময় নষ্ট না করে থানভী রহ. এর দরবারে চলে যান। ৮০ দিন খানকায় অবস্থান করেন। তারপর থানভী রহ. এর পরামর্শে মুজাহিরুল উলুম সাহারানপুরে ভর্তি হন। সেখানে চার বছর প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের জ্ঞানার্জন শেষে থানভী রহ. এর পরামর্শে দেওবন্দে ভর্তি হন। আরো চার বছর পড়েন দেওবন্দে। এই চার বছর তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার থানভী রহ. এর দরবারে যেতেন।  সাহারানপুর থেকে থানাভবন ৩৫ মাইল আর দেওবন্দ আরো আঠারো মাইল। কিন্তু তিনি সপ্তাহে একবার অবশ্যই যেতেন। প্রতি বছর রমজানের ছুটিতে তিনি খানকায় এমদাদিয়ায় চলে আসতেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষে থানভী রহ. এর দরবারে আরো চল্লিশদিন ছিলেন ইলমে মারেফত হাসিলের জন্য। 

একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন, সদর সাহেব এত দীর্ঘ অধ্যবসায়ের পরও কেন থানভী রহ. এর থেকে খেলাফত পাননি। আসলে সদর সাহেব তাঁর শায়েখের কাছে কখনো নিজের অবস্থার কথা বুঝতে দিতেন না বা প্রকাশ করতেন না। তাই থানভী রহ. তাকে খেলাফত দেননি। কিন্তু বাংলাদেশে থানভী রহ. এর খেলাফত প্রাপ্ত অনেকেই এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে শামসুল হকের মুজাহাদা ও রিয়াযাতের আসন আমাদের থেকেও অনেক ঊর্ধ্বে। যদি তিনি তা শায়েখের কাছে প্রকাশ করতেন তাহলে আমাদের অনেক আগেই তিনি খেলাফত পেয়ে যেতেন।

সূত্রঃ আলোর কাফেলা

No comments:

Post a Comment

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...