Thursday, August 3, 2017

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের মানদণ্ড (১)

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা ও এই নামে

বিশেষায়িত করার প্রেক্ষাপট

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ


আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রথম নীতিঃ কুরআন হাদিসে যেই বিষয়ে সুস্পষ্ট উল্লেখিত, সেগুলোকে দলিল হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত ভিন্ন কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কুরআন হাদিসের যাহেরী অর্থই ধর্তব্য।
(শরহে আকায়েদে নাসাফী পৃষ্ঠাঃ১১৯)

উসুলে ফিকহের পরিভাষায় এইভাবে বলা হয়, যতক্ষন পর্যন্ত হাকিকতের উপর আমল করা অসম্ভব না হয় ততক্ষণ মাজাযী অর্থ গ্রহণ করার দিকে যাওয়া যাবে না।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের এই মূলনীতির বিরোধিতা করে রাফেজীদের উপদল বাতেনীরা।
তারা বলে,
* জান্নাত মানে হচ্ছে দুনিয়াতে শরিয়তের বিধান পালন করার কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার নাম। (এই কারণেই একটা সময় গিয়ে তাদের নামাজ রোজা মাফ হয়ে যায়)
* বাতেনিয়াদের মত আমাদের দেশের ভন্ড পীরেরাও কুরআন হাদিসের মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করে। যেমন দেওয়ানবাগী তাঁর “আল্লাহ কোন পথে” বইতে লিখেছে “কুরআন হাদিসের বাতেনী ব্যাখ্যা আমরা সাধারণ তাফসীরকারকদের কাছ থেকে পাইনি। (তারা সব কিছুতেই বাতেনি ব্যাখ্যা খুজে থাকে, যেটা তাদের মনগড়া হয়ে থাকে।)



আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দ্বিতীয় নীতিঃ যে বিষয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা অস্পষ্ট বা সঠিক উদ্দেশ্য বুঝতে পারা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ, সেক্ষেত্রে রাসূলের সুন্নাত বা সহীহ হাদিস পেশ করতে হবে। যেমন রাসূলের মিরাজ। কুরআনে মিরাজের বিবরণ শুধু বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত উল্লেখ রয়েছে। এবং এরপর ঊর্ধ্বাকাশে যে ভ্রমণ হয়েছিল তা সুস্পষ্ট হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। শুধু মাত্র কুরআনে না থাকার কারণে বাকি অংশকে যদি কেউ অবিশ্বাস করে তাহলে তা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদার পরিপন্থী বলে গণ্য হবে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের তৃতীয় নীতিঃ যে বিষয়ে কুরআন ও হাদিস উভয় জায়গায় অস্পষ্ট বা ব্যাখ্যা ব্যাতিত বুঝা অসম্ভব সেসব বিষয়ে সাহাবাইয়ে কেরামের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত বলে মানতে হবে। যেমন, রাসূলের পর খলিফা কে হবেন সে ব্যাপারে কুরআন হাদিসে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম ঐক্যমতের ভিত্তিতে মেনে নিয়েছিলেন আবু বকর রা. কে। এই মূলনীতিরই অনুসরণ করতে হবে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের চতুর্থ নীতিঃ কুরআনের কোন আয়াতের শাব্দিক অর্থ যদি অন্য কোন নসের বা অকাট্য দলিলের বিপরীত হয় তাহলে অকাট্য দলিলকেই মানা হবে। কারণ শাব্দিক অর্থ ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। এখানে নানান রকম ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে। তাই ইচ্ছেমত যেকোন একটাকে গ্রহণ না করে যে ব্যাখ্যা অকাট্য দলিল অনুযায়ী হবে সেটাকেই গ্রহণ করতে হবে।  
যেমন, কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ আরশের উপর আরোহন করে আছেন বা আল্লাহর হাত পা আছে বা আল্লাহ আসমানে আছেনকিন্তু এর বিপরীতে অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত যে আল্লাহর আকার আকৃতি ইত্যাদি নেই। অতএব এখানে বুঝে নিতে হবে যে শাব্দিক অর্থের যে ভিন্নতা রয়েছে সেই ভিন্নতার মধ্যে গ্রহণ শুধু সেই অর্থটাকেই করা হয়েছে যা নসের বিপরীত না। মাজায বা রুপক অর্থ উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। এখানে শাব্দিক অর্থ না নিয়ে রূপক অর্থ উদ্দেশ্য নেয়ার কারণেই আর সংঘর্ষ হয়নি।




যে কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত নামে বিশুদ্ধ আকিদার ভিন্নতা ও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলঃ


রাসুলুল্লাহ সা বিদায় হজ্জের ভাষণেই এই বিভক্তির ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন এবং এর থেকে উত্তরণের পথও বলে দিয়ে গেছেন। তা হচ্ছে সুন্নত এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত খেলাফতে রাশেদার পথ।রাসুলুল্লাহ সা বিদায় হজ্জের ভাষণেই এই বিভক্তির কথা বলে গিয়েছিলেন এবং এর থেকে উত্তরণের পথও বলে দিয়ে গেছেন। তা হচ্ছে সুন্নত এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত খেলাফতে রাশেদার পথ। 
ইতিহাস দেখলে জানা যাবে রাসুলুল্লাহ সা এর এই মুল্যবান ওসিয়তকে মেনে চলার কারণেই সাহাবায়ে কেরাম সকল প্রকারের মনগড়া ব্যাখ্যা থেকে মুক্ত থেকেছেন যা তিনি বিদায় হজ্জের সময় সকলের উদ্দেশ্যে বলে গিয়েছিলেন। এ কারনেও হযরত ওমরের যুগ পর্যন্ত কোন ধরনের আকিদাগত বিভক্তি দেখা দেয়নি। 

সময় অতবাহিত হয়। চক্রান্তের জাল বিস্তারের সুযোগ সন্ধানীরা সুযোগের খুজতে থাকে। এমন সময় গভীর ষড়যন্ত্রের রূপরেখা নিয়ে ইয়াহূদি আব্দুল্লহা বিন সাবা খলিফা হযরত উসমানের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। এবং এ উদ্দেশ্যে মদিনা সিরিয়া বসরা এমনকি মিসর পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রতি জনগণের নিখাদ ভালবাসাকে পুজি করে অশিক্ষিত মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করে।
আব্দুল্লাহ বিন সাবাড় কথা যুক্তিতে খুব সাজানো গোছানো ছিল। এবং এই যুক্তির ভেতর যেই বিষ মানুষের মগজে সে প্রবেশ করিয়ে দিত সাধারণ মানুষের তা ধরার ক্ষমতা ছিল না। মানুষকে সে বুঝাতো এইসব বলে যে, হযরত আলী রা. আহলে বাইত হিসেবে উসমান রা থেকে বেশী যোগ্য। সাহাবিদের জালিম বলে গালি দেয়। এবং হযরত আবু বকর রা ও ওমর রা কে জালেম বলে আখ্যা দেয়।  এবং এইভাবে চাতুরতার সহিত সে নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি করে। এবং উসমান রা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এবং উসমান রা কে শহিদ করে। জামাল সিফফিনের মত যুদ্ধও এদের এদের চক্রান্তেরই ফসল। সুতরাং আব্দুল্লাহ ইবনে সাবাই ইতিহাসের সর্বপ্রথম ভ্রান্ত মতবাদের জন্মদাতা।  

এত ঘটনার পর যখন আলী রা খলিফা হয় তখন তাঁর বিরুদ্ধে হযরত মুয়াবিয়া রা কে ক্ষেপিয়ে তোলে। এবং উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ বাধায়।

কিন্তু তারা যেহেতু নবীর সাহাবী ছিলেন, একটা সময় গিয়ে তারা এই সাবাঈ চক্রের চক্রান্তগুলো ধরে ফেলেন। এরপর তারা উভয়দল আপোষের প্রস্তাবে একমত হলে সাবাঈ চক্র উভয় পক্ষ ত্যাগ করে খারেজী হয়ে যায়। এই খারেজীদের ভ্রান্ত আকিদার জের ধরে সৃষ্টি হয় মুরজিয়া নামক একটি ভ্রান্ত দল। এবং উভয় দলের মতবাদ খন্ডনে ওয়াসিল ইবনে আতার মতাদর্শে সৃষ্টি হয় প্রতিক্রিয়াশীল মুতাযিলা নামক ফিরকা।

এ পরিস্থিতি মুকাবেলায় এগিয়ে আসেন আবুল হাসান আশআরী ও আবু মানসুর মাতুরিদি। তারা ইসলামের বিশুদ্ধ আকিদাকে রাসূল সা এর সুন্নাত ও জামাতে সাহাবার দলিল দ্বারা প্রমাণ করতে থাকেন। এভাবেই ইসলামের বিশুদ্ধ আকিদা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা হিসেবে অভিহিত হয়।
বিষয়টি আল্লামা তাফতাজানি এইভাবে বলেছেনঃ এদের বিশেষভাবে মুকাবেলা হয়েছিল বাতিল মতবাদে বিশ্বাসী মুসলমানদের সাথে, বিশেষত মুতাযিলাদের সাথে। কারণ মুতাযিলারাই বাতিল মতবাদে বিশ্বাসী প্রথমদল। যারা আকিদার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ও্যাল জামাতের বিপরীতে নীতিমালা প্রণয়ন করে বিরোধিতা শুরু করেছে। (খারেজীরা এদের আগে আসলেও তারা নীতিমালা প্রণয়ন করে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বিরোধিতা শুরু করেনাই।)

আল্লামা তাফতাযানী ইমাম আবুল হাসান আশআরী সম্পর্কে লিখেনঃ এক বিতর্কে যখন জুব্বাই (মুতাযেলী)রা জবাব দিতে ব্যর্থ হল, তখন থেকে আশআরী রহ ও তাঁর অনুসারীরা জুব্বাই মতামত বর্জন করে তা খণ্ডন করা শুরু করলো। যেহেতু তারা রাসূল সা. ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাত প্রমাণের জন্য এই আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাই তাদেরকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বলে অভিহিত করা হয়। (শরহে আকায়েদে নাসাফী পৃ৬ ) 


No comments:

Post a Comment

The word of Shaykhul Azhar about Corona victim

সামর্থ্যবান প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব তাদের কিছু ব্যয়ভার বহন করা যারা এই রোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ লকডাউনে ঘরে আটকা পড়ার কারণে হ...